হাদিসে রাসূল, সাহাবাদের আমল এবং পূর্ববর্তী ইসলামি স্কলারদের লিখিত প্রায় গ্রন্থেই কোরবানির ফজিলত ও বিধি-বিধানের খুঁটিনাটি বিস্তারিতভাবে স্থান পেয়েছে। একজন ব্যক্তির ওপর কখন কোরবানি ওয়াজিব হয়, কখন ওয়াজিব হয় না তা পরিষ্কারভাবে ইসলামের প্রামাণ্য গ্রন্থাবলীতে উল্লেখ আছে।
সর্বোপরি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগ থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত উম্মতের সকল দল ও মাজহাব নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রতি বছর ঈদুল আজহাতে কোরবানি করে আসছে। এটা সকল সংশয় মুক্ত ও সুস্পষ্ট একটি বিধান।
কোরবানি যদিও একটি ধর্মীয় বিধান এবং যারা কোরবানি করেন তারা সবাই নিছক আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে, সওয়াব লাভের আশায় তা করে থাকেন। তবুও এর রয়েছে অপরিসীম আর্থসামাজিক অবদান।
চামড়া শিল্প থেকে দেশের আয়ের সিংহভাগ নির্ভর করে কোরবানির ওপর। প্রান্তিক গ্রাম্য জনগোষ্ঠীর লাখ লাখ পরিবারের বছরের মোটা অংকের বড়ো আয়ের একমাত্র উৎস কোরবানির হাটে পশু বিক্রি। কোরবানিতে চামড়ার টাকা নামে ধনীদের কোটি কোটি টাকা দুঃস্থ, দরিদ্র, অসহায়দের মাঝে বিতরণ হয়। দেশের এমন অনেক পরিবার আছে- যারা তৃপ্তির সঙ্গে উদরপূর্তি করে গোশত খাওয়ার জন্য কোরবানির দিনের অপেক্ষায় থাকেন। এ দিন ধনীরা পশুর গোশতে এক তৃতীয়াংশ মুক্তহাতে দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করেন।
এ বছর কোরবানির প্রাক্কালে দেশের বিরাট অংশ বন্যা কবলিত হয়েছে। কোটি মানুষ পানিবন্দী হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। খাবারের অভাব, চিকিৎসার অভাব ও বাসস্থানের কষ্ট তাদেরকে দগ্ধ করছে। সারা বছরের সংরক্ষিত ধান-চাল নষ্ট হয়ে গেছে। এমন দুর্দিন ও দুর্যোগে বন্যামুক্ত অঞ্চলের মানুষের মন কেঁদে উঠবে, মানবসেবা করার জন্য তাদের আবেগ উথলে উঠবে, সাধ্যমতো কিছু করার জন্য বিবেক তাদের তাড়িত করবে এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু সবসময় আবেগের সঙ্গে হুঁশ রেখে কাজ করতে হয়। হুঁশ ছেড়ে দিয়ে নিছক আবেগ তাড়িত হয়ে কাজ করলে ঘটে পদস্খলন।
কোরবানি না করে কোরবানির টাকা দিয়ে বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণের ঘোষণাটাও হুঁশ বিবর্জিত এমনই আবেগী একটি কথা। এমন ঘোষণা দেওয়ার দ্বারা ইসলাম সম্পর্কে ঘোষকের জ্ঞানের দৈন্যদশা ও ইসলামের প্রতি তার আনুগত্যের অভাব নগ্নভাবে প্রকাশ পায়।
নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকানা থাকা সাপেক্ষে যার ওপর কোরবানি ওয়াজিব সে যদি ঈদুল আজহাতে কোরবানি না করে অন্য যে কোনো সৎ ও মহৎ কাজে অর্থ ব্যয় করে তবে সে কোরবানি না করার অপরাধে অপরাধী হবে। সে আল্লাহর কাছে পাপী হবে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভাষ্যমতে, কোরবানির দিনগুলোতে অন্যকোনো পূণ্যের কাজ কোরবানি চেয়ে বেশি মহৎ নয়।
যে ব্যক্তি নিজস্ব যুক্তি ও বিবেচনা দ্বারা ইসলামের সুস্পষ্ট কোনো বিধানকে স্থগিত করবে সে ইসলামের মধ্যে থাকার নৈতিক অধিকার হারিয়ে ফেলবে। যে বা যারা কোরবানি না করে ত্রাণ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন, অন্যকে উদ্বুদ্ধ করছেন যুক্তির বিচারেই তারা ইসলাম থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন। নিজের অজ্ঞাতসারেই তারা ইসলাম ত্যাগ করছেন। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করো। ’ নিজের যুক্তি ও বিবেচনার মাপকাঠিতে তুলনা করে ইসলামের কিছু মানার, আর নিজের কাছে যুক্তিসঙ্গত ও বিবেকসম্মত মনে না হওয়ায় ইসলামের কিছু না মানার সুযোগ ইসলামে নেই। মুসলিম পরিচয়ে থাকতে হলে পূর্ণাঙ্গ ইসলাম মেনেই থাকতে হবে। কোরবানি না করে ত্রাণ দেওয়ার ঘোষণা শুধুমাত্র ইসলাম না মানা নয় বরং রীতিমতো ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঘোষণা।
ইসলামের কোনো বিধান স্থগিত করার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর। যারা মানবধর্মের ঠুনকো দোহাই দিয়ে কোরবানি না দিতে মানুষকে উস্কানি দিচ্ছেন- তারা ইসলামের বিধানের বিরোধীতা করছেন। এটা অনেক বড় পাপের কাজ। ওই ঘোষণার মতো তাদের তওবাও হতে হবে প্রকাশ্য।
বন্যার্তদের কাছে পর্যাপ্ত ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া ইসলামের দৃষ্টিতে ফরজে কেফায়া। পবিত্র কোরআন ও হাদিসের অসংখ্য স্থানে অন্নহীনকে অন্ন দিতে, বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দিতে আদেশ করা হয়েছে। যারা সামর্থ্য থাকার পরেও অভাবী মানুষের সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানায়- তাদেরকে জাহান্নামি বলা হয়েছে। বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানো সকল নবীর সুন্নত। বন্যা কবলিত অঞ্চলের একজন মানুষও যদি খাদ্যের অভাবে মারা যায়, তাহলে আল্লাহর কাছে এর কৈফিয়ত দিতে হবে বন্যমুক্ত অঞ্চলের সকল সামর্থবানকে।
বন্যার্ত মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করা এবং বন্যা পরবর্তী সময়ে তাদের পুনর্বাসনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা ইসলামের নির্দেশ। আবার ঈদুল আজহার দিন কোরবানি করা এটাও ইসলামের নির্দেশ। আপনি একজন মুসলমান হিসেবে আপনার দায়িত্ব আল্লাহর উভয় নির্দেশ পালন করা। এক নির্দেশ দেখিয়ে আরেক নির্দেশকে স্থগিত করার অধিকার আপনার নেই।
তাই, যাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয় তারা সাধ্যের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে ত্রাণ ও পুনর্বাসনে অংশগ্রহণ করুন। আর যাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব তারা কোরবানিও দিন আবার ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজেও শরিক হোন।
কোরবানির অজুহাতে ত্রাণ ও পুনর্বাসন থেকে নির্লিপ্ত থাকা অন্যায়। আবার ত্রাণ ও পুনর্বাসনের নামে কোরবানি থেকে বিরত থাকাও অপরাধ।
ত্রাণের অর্থ সংগ্রহ করার জন্য কোরবানি বন্ধ রাখা যাবে না। কেননা, কোরবানি একটি আবশ্যকীয় কাজ। তাই একে বন্ধ রাখার কোনো সুযোগ নেই। ত্রাণের বাড়তি অর্থ সংগ্রহ করার জন্য জীবনের অনাবশ্যক ও ঐচ্ছিক কাজগুলো বন্ধ করে দিন।
অনাবশ্যক ও ঐচ্ছিক কাজের বিবরণ দিতে গেলে লেখার কলেবর বেড়ে যাবে, তাই আর সেদিকে যাচ্ছি না।
ত্রাণ অবশ্যই একটি আবশ্যকীয় কাজ। কিন্তু এ বছর কোরবানি না দিয়ে ত্রাণ দেব- এ ঘোষণা যতটা না ত্রাণের প্রতি মমত্ববোধ থেকে এসেছে তার চেয়েও বেশি অন্য চিন্তা থেকে। যারা এমন প্রচারণা চালাচ্ছেন, তাদের জীবনের খুটিঁনাটি দিকগুলোও গণমাধ্যমে গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হতে দেখা যায়। কিন্তু ইসলামের সেবায়, ইসলামের প্রচারে কিংবা ইসলামের কোনো কাজে সহযোগিতা করার বা অংশগ্রহণ করার কোনো খবর তাদের নিয়ে প্রচার হতে কখনও দেখিনি। ত্রাণের মতো ইসলামের প্রতিও মমত্ববোধ থাকলে কোরবানি বন্ধ রাখার কুচিন্তা মাথায় না এনে, অন্য কোনো সুচিন্তা তাদের মাথায় আসত। সেটা যেহেতু আসেনি, তাই ভিন্ন কথা বলার অবকাশ থাকছে।
ইসলাম বিভাগে লেখা পাঠাতে মেইল করুন: bn24.islam@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১৪২০ ঘণ্টা, আগস্ট ২১, ২০১৭
এমএইউ/