ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইসলাম

হারানো ঐতিহ্য

স্পেনে মুসলিমদের হারানো ‘আল-হামরা’

ইসলাম ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১০৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০১৮
স্পেনে মুসলিমদের হারানো ‘আল-হামরা’ স্পেনে মুসলিমদের হারানো ‘আল-হামরা’। ছবি : সংগৃহীত

ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি-সভ্যতার অনন্য অধ্যায় স্পেনের ‘আন্দালুস’। এ নগরীর গর্ব আল-হামরা। আরবি ‘কিলআতু আল হামরা’—অর্থাৎ লালকেল্লা বা বহুল প্রচলিত ‘আল-হামরা প্যালেস’। সৌন্দর্য-সুষমায় আল্লাহ তাআলা ‘আল-হামরা’কে অতুলনীয় করে রেখেছেন। বিশ্ববাসীর কাছে তা আজও অপার বিস্ময় ও সৃজনসম্ভার হিসেবে পরিচিত।

১২৩৮ সালে মুহাম্মদ ইবনে নাসর (১২৩৮-১২৭৩ খ্রিস্টাব্দ) গ্রানাডা জয় করেন। তিনি তার আবাসন ও প্রশাসনিক প্রয়োজনে প্রাসাদটি নির্মাণ করেন।

পরবর্তী ৩০০ বছরে বিভিন্ন মুসলিম শাসকের পরিকল্পনা ও পরিচর্যায় আল-হামরার নান্দনিকতা ও পরিব্যাপ্তি বৃদ্ধি পেয়ে যশ-খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়।

মাদ্রিদের ৪৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে দারু নদীর তীরে সবুজ-শ্যামল এক পাহাড়ে অবস্থিত ‘আল-হামরা’ প্যালেস। মুহাম্মদ ইবনে নাসর প্রাসাদটির নাম দেন আল-হামরা—অর্থাৎ লাল প্রাসাদ। কেননা তিনি যখন ওই প্রাসাদে প্রবেশ করেন, তখন তার দাড়ির রং ছিল লাল।

স্পেনে মুসলিমদের হারানো ‘আল-হামরা’র স্বর্ণখচিত নান্দনিক কারুকার্য।  ছবি : সংগৃহীত

মুহাম্মদ ইবনে নাসর যখন বিজয়ীর বেশে গ্রানাডায় প্রবেশ করেন, তখন তাকে স্বাগত জানিয়ে সমবেত জনতার উল্লাসধ্বনি ছিল মারহাবান লিন-নাসর—অর্থাৎ ‘আল্লাহর কৃপায় বিজয়ীকে সুস্বাগত’। জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘লা গালিবা ইল্লাল্লাহ’—অর্থাৎ ‘অন্য কেউ বিজয়ী নয়, যদি না আল্লাহ চান। পরবর্তী সময়ে ‘লা গালিবা ইল্লাল্লাহ’ বাক্যটি নাসরি বংশের স্লোগান হয়ে যায়। আল-হামরার অলংকরণে এ বাক্যটি বিভিন্নভাবে ব্যবহৃত হয়েছে।

মুহাম্মদ ইবনে নাসরের বিজয় নিয়ে দেশে দেশে প্রচলিত হয় অসংখ্য গীতিকবিতা ও গল্পগাথা। আল-হামরার দেয়ালে দেয়ালে স্বর্ণ ও পাথরে খোদাই করা আরবি ক্যালিগ্রাফির অনুপম শিল্পনিদর্শন অত্যন্ত বিস্ময়কর ও দৃষ্টিনন্দন। পবিত্র কোরআন, হাদিস, আরবি কবিতা ও উপদেশাবলি আল-হামরার কক্ষ, খুঁটি, মিনার ইত্যাদিকে সুশোভিত করেছে। এ কাজে ব্যবহৃত হয়েছে শত শত মণ স্বর্ণ, মূল্যবান হীরকখণ্ড ও মণি-মুক্তা। যে মালভূমিতে আল হামরা অবস্থিত, তার দৈর্ঘ্য ৭৪০ মিটার (দুই হাজার ৪৩০ ফুট), প্রস্থ ২০৫ মিটার (৬৭০ ফুট)। প্রাসাদটি পশ্চিমে উত্তর-পশ্চিম থেকে পূর্বে দক্ষিণ-পূর্বে প্রসারিত এবং প্রায় এক লাখ ৪২ হাজার বর্গমিটার (১৫ লাখ ৩০ হাজার ফুট) এলাকাজুড়ে অবস্থিত।

স্পেনে মুসলিমদের হারানো ‘আল-হামরা’র কারুকার্যমণ্ডিত সুবিশাল হলরুম।  ছবি : সংগৃহীত

মধ্যযুগের আরব সাহিত্য-সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, শাসনের সুদৃঢ় ভিত্তি ও সৌন্দর্যের স্মারক হিসেবে ২ নভেম্বর ১৯৮৪ সালে আল হামরাকে ইউনেসকো মানবতার সাংস্কৃতিক বিশ্ব-ঐতিহ্য ঘোষণা করেছে।

স্পেনে মুসলিম ঐতিহ্যের রয়েছে সোনালি অতীত। মহাকালের স্রোতে হারিয়ে গেছে ৭১১ থেকে ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মোট ৭৮০ বছরের মুসলিম শাসনের গৌরবগাথা।

স্পেনে মুসলিমদের হারানো ‘আল-হামরা’র স্বর্ণখচিত নান্দনিক কারুকার্য।  ছবি : সংগৃহীত

৭১১ খ্রিস্টাব্দের ৩০ এপ্রিল সেনাপতি তারিক বিন জিয়াদ তার সেনাবাহিনী নিয়ে স্পেন উপকূলের এক পাহাড়ে ঘাঁটি গাড়েন। পরে ওই পাহাড়ই জাবাল তারিক বা তারিকের পাহাড় নামে বিখ্যাত হয়, যার শাব্দিক রূপান্তর জিব্রাল্টা। পাহাড়ে অবস্থান নিয়ে সেনাপতি তার নৌকা পুড়িয়ে দেন। এতে অবাক সৈন্যদের জিজ্ঞাসায় তারিক বলেছিলেন—‘আমরা ফিরে যাওয়ার জন্য আসিনি। হয় বিজয়, নতুবা মৃত্যু। ’ 

প্রসঙ্গত, সৈন্যদের উদ্দেশে তারিকের বক্তব্য উদ্ধৃত করা হলো—‘হে আমার যোদ্ধারা! কোথায় তোমরা পালাবে? তোমাদের পেছনে সাগর, সামনে শত্রু। তোমাদের আছে শুধু সাহস ও ধীশক্তি। মনে রেখো, এ দেশে তোমরা সেই এতিমদের চেয়েও হতভাগা, যাদের লোভী মালিকদের সঙ্গে টেবিলে বসতে হয়। তোমাদের সামনে শত্রু, যাদের সংখ্যা অগণ্য। কিন্তু তোমাদের তলোয়ার ছাড়া কিছুই নেই। তোমরা বেঁচে থাকতে পারবে, যদি শত্রুর হাত থেকে নিজেদের জীবনকে ছিনিয়ে আনতে পারো। ভেবো না, আমি তোমাদের সঙ্গে থাকব না। আমিই সবার সামনে থাকব এবং আমার বাঁচার সম্ভাবনাই সবচেয়ে ক্ষীণ। ’

স্পেনে মুসলিমদের হারানো ‘আল-হামরা’র গম্বুজের স্বর্ণখচিত নান্দনিক কারুকার্য।  ছবি : সংগৃহীত

তারিকের এমন মর্মস্পর্শী বক্তব্য মুসলমানদের স্পেন বিজয় সহজতর করে। তারা স্পেনের নামকরণ করে আন্দালুসিয়া। স্পেনে মুসলিম শাসনে কর্ডোভা হয়ে ওঠে ইউরোপের সবচেয়ে মনোরম ও উন্নত জনপদ।

প্রায় পাঁচ হাজার মিল-কারখানা ছিল শুধু কর্ডোভায়ই; অথচ তখন ইউরোপে একটিও ছিল না। তখন ইউরোপের ৯৯ শতাংশ লোক অশিক্ষিত ছিল। পক্ষান্তরে শুধু কর্ডোভায়ই ছিল ৮০০টি পাবলিক স্কুল।

তৎকালের ইউরোপে গোসলখানার ধারণাই ছিল না। অথচ তখন মুসলমানরা কর্ডোভায় ৯০০ হামামখানা বা গণগোসলখানা বানিয়েছিলেন।

 ‘আল-হামরা’র স্বর্ণখচিত নান্দনিক ও দ্যুতিময় কারুকার্য।  ছবি : সংগৃহীত

দশম শতকে কর্ডোভায় ছিল ৭০০ মসজিদ, ৬০ হাজার প্রাসাদতুল্য বাড়ি। ছিল ৭০টি লাইব্রেরি, যার সবচেয়ে বড়টিতে ছিল ছয় লাখ গ্রন্থ। সে সময় আন্দালুসিয়ায় বছরে ৬০ হাজার বইপত্র ও পুস্তিকা প্রকাশিত হতো। অথচ ইতিহাসের নির্মম সত্য হলো, আজ স্পেনে মুসলমানদের অস্তিত্ব-সংকট বিদ্যমান।

বেদনাবিধুর ২ জানুয়ারি, ১৪৯২। এই দিনে স্পেনে মুসলমানদের পরাজয়ের বেদনালেখ্য রচিত হয়। আন্দালুসিয়া ও কর্ডোভাসহ গুরুত্বপূর্ণ এলাকার পতনের পর গ্রানাডার পতন ঘটে। ২ জানুয়ারি ১৪৯২ তৎকালীন শাসক আবু আবদুল্লাহ ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলার কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। এতে স্পেনে ৭৮০ বছরের মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। আমেরিকা বিজয়ী ক্রিস্টোফার কলম্বাস এ আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করেন।

‘আল-হামরা’র মনোমুগ্ধকর ও চোখধাঁধানো সৌন্দর্য-মহিমা।  ছবি : সংগৃহীত

এরপরই নেমে আসে স্পেনে মুসলিম নিধনের কালো অধ্যায়। শর্ত দেওয়া হয়, ধর্মান্তর নয়তো মৃত্যু। ঘোষণা করা হয়, যারা মসজিদে আশ্রয় নেবে, যারা জাহাজে আশ্রয় নেবে, তারা নিরাপদ। এতে সরল বিশ্বাসে নিরীহ মুসলমানরা মসজিদে ও জাহাজে আশ্রয় নেন। তখনই ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলার সৈন্যরা মসজিদের চারপাশে আগুন লাগিয়ে এবং জাহাজ ডুবিয়ে দিয়ে এক পৈশাচিক উল্লাসে মেতে ওঠে। আর এতে শহীদ হন নিরপরাধ অসংখ্য মুসলিম নর-নারী।

পরাজয়ের ধারায় মুসলিম শাসক আবু আবদুল্লাহ যখন বিজয়ীদের হাতে আল হামরার চাবি তুলে দেন, তখন তিনি অঝোরে কাঁদছিলেন। এ কান্না দেখে আবদুল্লাহর মা বলেছিলেন ‘পুরুষের মতো যা রক্ষা করতে পারোনি তুমি, তার জন্য নারীর মতো কাঁদতে পারো না। ’

‘আল-হামরা’র মনোমুগ্ধকর ও চোখধাঁধানো শিল্প-মাধুর্য।  ছবি : সংগৃহীত

আজকের স্পেন সব ঘটনার নীরব সাক্ষী। শুধু আল-হামরার দেয়াল ও মসজিদের গম্বুজে আল্লাহর নাম চিত্রিত করলেই তার সন্তুষ্টি অর্জন করা যায় না। প্রায় ৮০০ বছরের শাসনাবসানে আজ স্পেনের বুকে জ্বলজ্বল করছে শুধু মুসলিম শাসকদের পরাজয় ও পরাধীনতার দুর্ভাগ্যরেখা, গ্লানি ও কলঙ্কের দাগ।

হারিয়ে গেছে আল হামরার ধ্রুপদি দ্যুতি ও সম্মান-বিভা। নেই স্পেনের বুকে দাপিয়ে বেড়ানো মুসলমান। আছে শুধু স্মৃতিময় গ্রানাডা ও কর্ডোভা।

বিশ্বমানচিত্রে অঙ্কিত ইউরোপীয় দেশ স্পেন ছিল মুসলমানদের গর্বের আন্দালুস (হারানো ‘ফিরদাউস’)। এখন যা শুধুই অতীতের স্মৃতিমেদুর দীর্ঘশ্বাস।

ইসলাম বিভাগে লেখা পাঠাতে মেইল করুন: bn24.islam@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ২০০৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৮
এমএমইউ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।