ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইসলাম

বাড়িওয়ালা-ভাড়াটিয়া সম্পর্ক ও দায়িত্ব

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০৯ ঘণ্টা, জুলাই ৭, ২০২০
বাড়িওয়ালা-ভাড়াটিয়া সম্পর্ক ও দায়িত্ব

শহরে বসবাসকারীদের একটি বড় অংশ ভাড়াটিয়া। জীবন-জীবিকা, সন্তানের লেখাপড়াসহ বিভিন্ন কাজে নিজের বাড়িঘর ছেড়ে বাধ্য হয়েই অন্যের বাড়ি ভাড়া নিয়ে বসবাস করতে হয়। বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়া উভয়ের দায়িত্ববোধ ও সুন্দর আচরণের কারণে উভয়ের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। কেটে যায় দীর্ঘসময়। এভাবে এক বাড়িতে ভাড়া থেকে জীবন পার করারও অনেক নজির রয়েছে। এর বিপরীতে বাড়ির মালিকের আচরণে ভাড়াটিয়া অথবা ভাড়াটিয়ার আচরণে বাড়ির মালিকের অতিষ্ঠ হওয়ার ঘটনাও কম নয়। এ জন্য প্রয়োজন উভয় পক্ষের আন্তরিকতা ও দায়িত্বসচেতনতা। এ বিষয়ে কোরআন-সুন্নাহর দৃষ্টিভঙ্গি দেখে নেওয়া যাক।

আসলে বিনিময়ের ভিত্তিতে উপকৃত হওয়ার চুক্তির নাম হলো ইজারা। বাড়ি ভাড়া নেওয়া ও দেওয়া এরই অন্তর্ভুক্ত।

ইজারা বৈধ হওয়ার জন্য দু’টি জিনিস স্পষ্ট থাকতে হয়—এক. ভাড়ার পরিমাণ জানা থাকা। দুই. উপকৃত হওয়ার মেয়াদ জানা থাকা। বাড়িভাড়া নেওয়া ও দেওয়ার ক্ষেত্রে কত সময়ের জন্য কত ভাড়া, তা স্পষ্ট থাকতে হয়। সাধারণত আমাদের দেশে মাসভিত্তিক ভাড়া নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ এক মাস বাড়ির উপস্বত্ব ভোগ বা উপকৃত হওয়ার বিনিময়ে এত টাকা ভাড়া দিতে হবে মর্মে চুক্তি করা হয়। বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়ার পারস্পরিক দ্বন্দ্ব এড়িয়ে সুসস্পর্ক বজায় রাখতে কিছু বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা দরকার।

এক. উভয়পক্ষ আলোচনার মাধ্যমে পরস্পরের চাওয়া-পাওয়ায় একমত হয়ে চুক্তি আকারে তা লিপিবদ্ধ করে রাখা। এরপর যথাসাধ্য তা মেনে চলা। সবধরনের চুক্তি ও লেনদেনের ক্ষেত্রে লিখিত থাকা উত্তম। আল্লাহ বলেন, ‘...তা (চুক্তি) ছোট হোক বা বড় হোক, মেয়াদসহ লিখতে তোমরা কোনো ধরনের বিরক্ত হয়ো না। আল্লাহর কাছে তা ন্যায্যতার ও প্রমাণের জন্য দৃঢ়তর এবং তোমাদের মধ্যে সন্দেহের উদ্রেক না হওয়ার নিকটতর...। ’ (সুরা: বাকারা, আয়াত: ২৮২)

দুই. অনেক সময় একই বাড়ির অন্য ইউনিটে বাড়ির মালিকও বাস করেন। সে ক্ষেত্রে মালিক ও ভাড়াটিয়া প্রতিবেশীও বটে। শুধু প্রতিবেশীই নয়, বরং কাছের প্রতিবেশী। প্রতিবেশীর প্রতি ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘জিবরাইল (আ.) আমাকে প্রতিবেশী সম্পর্কে অবিরত উপদেশ দিচ্ছিলেন, এমনকি আমি ধারণা করলাম যে, আল্লাহ তাদের আমার ওয়ারিশ বানিয়ে দেবেন। ’ (বুখারি, হাদিস: ৫৬৬৮; মুসলিম, হাদিস: ৬৮৫৪)। যেকোনো ধর্মের মানুষই প্রতিবেশী হতে পারে। আর সবমানুষের প্রতি উদার মনোভাব পোষণ ও মানবীয় সদাচরণ ইসলামের শিক্ষা।

তিন. অনেক সময় যৌক্তিক কারণে ভাড়াটিয়ার ভাড়া পরিশোধ করতে বিলম্ব হতে পারে। বাড়ির মালিকের জন্য বিষয়টি মানবিকভাবে বিবেচনা করা উচিত। পরিমাণে ছাড় বা পরিশোধে সময় দেওয়া উচিত। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘যদি অভাবগ্রস্ত হয়, তাহলে সচ্ছলতা পর্যন্ত তাকে অবকাশ দেওয়া বিধেয়। আর যদি তোমরা ছেড়ে দাও, তাহলে তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর—যদি তোমরা জানতে। ’ (সুরা: বাকারা, আয়াত: ২৮০)

চার. ভাড়াটিয়া চুক্তি অনুযায়ী বাড়ির ভাড়া যথাসময়ে পরিশোধ করবে। এ ব্যাপারে গড়িমসি গ্রহণযোগ্য নয়। সামর্থ্য না থাকলে বাড়ি ছেড়ে দেবে। সামর্থ্য থাকার পরও পাওনা পরিশোধে গড়িমসি করাকে নবী (সা.) জুলুম আখ্যায়িত করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সামর্থ্যবানদের পাওনা পরিশোধে গড়িমসি করা জুলুম। ’ (মুসলিম, হাদিস: ৪০৮৫)

পাঁচ. ভাড়াটিয়া উপকৃত হওয়ার বিনিময়ে বাড়িভাড়া পরিশোধ করে। ইচ্ছাকৃত হস্তক্ষেপ ছাড়া বাড়ির উপস্বত্ব ভোগ বা উপকৃত হওয়ার কারণে বাড়ির কোনো কিছু ক্ষতিগ্রস্ত হলে ভাড়াটিয়াকে দায়ী করা যাবে না। কারণ ভাড়াটিয়া ব্যবহারের বিনিময়ে ভাড়া দেয়। ব্যবহারের অনুপযোগী হলে বাড়ির মালিককে তা ব্যবহারের উপযোগী করে দিতে হবে। আবার ভাড়াটিয়ারও খেয়াল রাখতে হবে, যেন কোনোভাবেই ভাড়া বাড়ির অপব্যবহার না হয়। এ ক্ষেত্রে মুহাদ্দিস আলী ইবনে মাবাদ (রহ.)-এর একটি ঘটনা স্মরণীয়। তিনি বলেন, ‘আমি একটি ভাড়া বাড়িতে বাস করতাম। একবার আমার কিছু লিখে তা শুকানোর জন্য মাটির প্রয়োজন হলো। কাঁচা দেয়াল ছিল। ভাবলাম, সেখান থেকে কিছু মাটি ঘষে নিয়ে লেখার ওপর ছিটিয়ে দিই। পরে মনে হলো, এ তো ভাড়া বাড়ি। আমি বসবাসের জন্য এটি ভাড়া নিয়েছি—দেয়ালের মাটি ব্যবহারের জন্য নয়। আবার মনে হলো, সামান্য একটু মাটি; এতে অসুবিধার কী আছে? এসব ভাবনার পর আমি মাটি ব্যবহার করলাম। রাতে স্বপ্নে দেখলাম, এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলছে, কাল কিয়ামতের দিন বোঝা যাবে, সামান্য মাটি কী জিনিস?’ (হেকায়েতে সাহাবা)

কারো স্বপ্ন শরিয়তের প্রমাণ নয়। এটি সত্য, কিন্তু বিষয়টি তো বাস্তব। ক্ষুদ্র হলেও মানুষের হক মেরে খাওয়ার পরিণতি ভয়াবহ। মহান আল্লাহ বলেন, ‘কিয়ামতের দিন আমি স্থাপন করবো ন্যায়বিচারের মানদণ্ড। সুতরাং কারও প্রতি কোনো অবিচার করা হবে না এবং কর্ম যদি তিল পরিমাণ ওজনেরও হয়, তবু তা আমি উপস্থিত করবো। হিসাব গ্রহণকারীরূপে আমিই যথেষ্ট। ’ (সুরা: আম্বিয়া, আয়াত: ৪৭)। উল্লিখিত পন্থায় বাড়িওয়ালা-ভাড়াটিয়া সম্পর্ক স্থাপিত হলে প্রতিটি ঘর, প্রতিটি বাড়ি কল্যাণে ভরে উঠবে, ইনশাআল্লাহ।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, আরবী বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশ সময়: ১১৩৫ ঘণ্টা, জুলাই ০৭, ২০২০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।