ঢাকা, শুক্রবার, ২৪ আশ্বিন ১৪৩২, ১০ অক্টোবর ২০২৫, ১৭ রবিউস সানি ১৪৪৭

আইন ও আদালত

হত্যার নির্দেশনা ও বাঁচিয়ে রাখার বিষয়ে জবানবন্দিতে যা বললেন আসিফ

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:৩২, অক্টোবর ৯, ২০২৫
হত্যার নির্দেশনা ও বাঁচিয়ে রাখার বিষয়ে জবানবন্দিতে যা বললেন আসিফ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি দেওয়ার পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া | ছবি: শাকিল আহমেদ

‘তৎকালীন ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ এবং রমনা জোনের ডিসি হুমায়ুন কবীর আন্দোলন প্রত্যাহারে চাপ ও হুমকি প্রদান করতে থাকে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আন্দোলন প্রত্যাহারের জন্য চাপ ও হুমকি প্রদান করতে থাকে।

আমাদের বার বার বলা হয় যে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশেই আমাদের তুলে আনা হয়েছে এবং আন্দোলন প্রত্যাহারে চাপ দেওয়া হচ্ছে। আন্দোলন প্রত্যাহারে রাজি না হলে আমাদের হত্যা করা হবে মর্মে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশ ছিল। তারা আরও বলে যে, তারা দয়া করে আমাদের এখনো বাঁচিয়ে রেখেছে। ’

জুলাই আন্দোলনে ডিবি কার্যালয়ে বন্দি অবস্থার কথা তুলে ধরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এমন জবানবন্দি দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।

রাজধানীর চানখারপুলে পুলিশের গুলিতে ৬ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বৃহস্পতিবার (০৯ অক্টোবর) প্রসিকিউশনের ১৯ নম্বর সাক্ষী হিসেবে বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ এ জবানবন্দি দেন তিনি। তার এই জবানবন্দি শেষ না হওয়া পুনরায় জবানবন্দি গ্রহণের জন্য আগামী বৃহস্পতিবার নতুন দিন রেখেছেন ট্রাইব্যুনাল।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ পুলিশের সাবেক ৮ সদস্য এই মামলার আসামি। তাদের মধ্যে চারজন পলাতক। তারা হলেন—সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, রমনা অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহ্ আলম মো. আখতারুল ইসলাম ও রমনা অঞ্চলের সাবেক সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ ইমরুল। গ্রেপ্তার আসামিরা হলেন—শাহবাগ থানার সাবেক পরিদর্শক (অপারেশন) মো. আরশাদ হোসেন, কনস্টেবল মো. সুজন হোসেন, ইমাজ হোসেন ও মো. নাসিরুল ইসলাম। মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের সময় তারা ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় ছিলেন। এ সময় প্রসিকিউশনপক্ষে উপস্থিত ছিলেন, চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম, গাজী এম এইচ তামীম, ফারুক আহমদ, আবদুস সাত্তার পালোয়ান ও তারেক আবদুল্লাহ প্রমুখ।

আসামিপক্ষে আইনজীবী সাদ্দাম হোসেন অভি, জিয়াউর রশিদ টিটো, আবুল হোসেন ও কুতুব উদ্দিন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

২০১৮ সাল থেকে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকা এবং ২০২৪ সালে কোটা বহালে হাইকোর্টের রায়ের পরবর্তী ইতিহাস তুলে ধরে জবানবন্দিতে আসিফ মাহমুদ বলেন, ১৪ জুলাই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারীদের রাজাকারের নাতিপুতি বলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন।

এর প্রতিবাদে ওই দিন রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যলায়ে প্রতিবাদ শুরু হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, তখন থেকে আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হয়। পরদিন ১৫ জুলাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আন্দোলন দমাতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট মর্মে উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদানের পর পরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগসহ বহিরাগত ছাত্রলীগ ক্যাডাররা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায়। তাদের হামলায় শতাধিক ছাত্র-ছাত্রী গুরুতর রক্তাক্ত আহত হয়। আহত ছাত্র-ছাত্রীরা ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসার জন্য গেলে সেখানেও ছাত্রলীগ তাদের ওপর হামলা করে।

১৬ জুলাই পুলিশের গুলিতে রংপুরে আবু সাঈদ ও চট্টগ্রামে ওয়াসিমসহ ৬ জন নিহত হওয়ার বর্ণনা দিয়ে আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘১৭ জুলাই এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে কফিন মিছিল ও গায়েবানা জানাজা কর্মসূচি পালন করি। তখন আর এ আন্দোলন শুধুমাত্র কোটা সংস্কার দাবিতে সীমাবদ্ধ ছিল না। গায়েবানা জানাজা থেকে ডাকসুর সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেনসহ দুজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। ’

১৮ জুলাই সারা দেশে কমপ্লিট শাডাউন কর্মসূচি পালন করার কথা জানিয়ে জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘সেদিন সারা দেশব্যাপী পুলিশ, আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের ওপর ব্যাপকভাবে গুলিবর্ষণ করে। সেদিন সারা দেশে কমপক্ষে ২৯ জন আন্দোলনকারী নিহত হওয়ার খবর পাই। ’

জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘আন্দোলনের এ পর্যায়ে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন আমাদের সাথে আন্দোলন প্রত্যাহার করার জন্য যোগাযোগ শুরু করে। আমরা কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি অব্যাহত রাখি। সেদিন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়ে তার দায় আন্দোলনকারীদের ওপর চাপানো হয়। আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে অনেকগুলো মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয় এবং ব্লক রেইড দিয়ে ব্যাপক মাত্রায় ধরপাকড় শুরু করা হয়। সেদিন রাতে সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। ’

১৯ জুলাই আন্দোলনকারীদের ওপর হেলিকপ্টার থেকে গুলি ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করা হয়। আন্দোলন দমনে ব্যাপকমাত্রায় নির্বিচারে গুলি করা হয়। যার ফলশ্রুতিতে সেদিন সারা দেশে শতাধিক নিহত হওয়ার খবর পাওয়ার কথা জানিয়ে জবানবন্দিতে আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘সেদিন রাতে ঢাকার গুলশান নিকেতন এলাকা থেকে একটি মাইক্রোবাসে করে ডিবি পরিচয়ে সাদা পোশাকধারী কিছু লোকজন আমাকে মাথায় কালো টুপি পরিয়ে তুলে নিয়ে যায়। ওই রাতে সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকেও তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমাকে আন্দোলন প্রত্যাহারে একটি ভিডিও বার্তা প্রদানের জন্য চাপ দেওয়া হয়। আমি রাজি না হলে আমাকে ইনজেকশন পুশ করে অজ্ঞান করে ফেলা হয়। ২৪ জুলাই সকালে আমাকে নিকেতনস্থ সেই স্থানে রেখে যায়। আমাকে তুলে নিয়ে যে রুমে রাখা হয়, ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় আয়নাঘর পরিদর্শনে গিয়ে বুঝতে পারি এটি সেই জায়গা। ’

জবানবন্দিতে আসিফ আরও বলেন, ‘২৬ জুলাই গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় আমি, নাহিদ ইসলাম ও আবু বাকের মজুমদারকে হাসপাতাল থেকে তুলে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ২৭ জুলাই সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলমকে ডিবি কার্যালয়ে তুলে আনা হয়। ২৮ জুলাই সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুমকেও ডিবি কার্যালয়ে তুলে আনা হয়। সেখানে আমাদের আন্দোলন প্রত্যাহার করার জন্য চাপ দিতে থাকে। এক পর্যায়ে আমাদের পরিবারের সদস্যদেরও ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়। তাদের দিয়ে আমরা সুস্থ আছি মর্মে মিডিয়ায় বক্তব্য প্রচারে বাধ্য করা হয়। তৎকালীন ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ এবং রমনা জোনের ডিসি হুমায়ুন কবীর আন্দোলন প্রত্যাহারে চাপ ও হুমকি প্রদান করতে থাকে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আন্দোলন প্রত্যাহারের জন্য চাপ ও হুমকি প্রদান করতে থাকে। আমাদের বার বার বলা হয় যে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশেই আমাদের তুলে আনা হয়েছে এবং আন্দোলন প্রত্যাহারে চাপ দেওয়া হচ্ছে। আন্দোলন প্রত্যাহারে রাজি না হলে আমাদের হত্যা করা হবে মর্মে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশ ছিল। তারা আরও বলে যে, তারা দয়া করে আমাদের এখনো বাঁচিয়ে রেখেছে। ’

’ডিবিতে জোরপূর্বক আন্দোলন প্রত্যাহারের ভিডিও বার্তা রেকর্ড করে গণমাধ্যমে প্রচার করার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ডিবি অফিসে বন্দি অবস্থায় আমরা আমরণ অনশন শুরু করি। টানা ৩২ ঘণ্টা অনশনে থাকার পর আমাদের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ১ আগস্ট আমাদের মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তি পাওয়ার পর আমরা আন্দোলন প্রত্যাহারের ওই ভিডিও বার্তা জোরপূর্বক গ্রহণ করা হয়েছিল মর্মে জাতির উদ্দেশে বক্তব্য প্রদান করি এবং আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেই। ’

জবানবন্দিতে আসিফ মাহমুদ আরও বলেন, ‘৫ আগস্ট ভোর থেকে মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি পালনের জন্য সারা দেশ থেকে সাধারণ জনগণ ঢাকা অভিমুখে আসতে শুরু করে। আমি, সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার ও সমন্বয়ক মোয়াজ্জেম হোসেন চানখারপুল হয়ে শহীদ মিনারের দিকে আসার চেষ্টা করি। আনুমানিক সকাল ১১টার দিকে আমরা দেখতে পাই, পুলিশ ও এপিবিএন সদস্যরা নাজিম উদ্দিন রোডসহ চানখারপুল এলাকায় অবস্থানরত আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ছে। ওই সময় আমরা ৪০০ থেকে ৫০০ আন্দোলনকারী চানখারপুল এলাকায় অবস্থান করছিলাম। এ সময় পুলিশের গুলিতে একের পর এক আন্দোলনকারীদের আহত হতে দেখতে পাই। আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করি। ’

জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘সেখানে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ এবং শর্টগান ও চাইনিজ রাইফেল ব্যবহার করে গুলি করে। আমার সামনে পুলিশের গুলিতে ২ জন আন্দোলনকারী নিহত হয়। পরবর্তীতে জানতে পারি যে, ওই দিন চানখারপুল এলাকায় পুলিশের গুলিতে আনাস, ইসমামুল ও ইয়াকুবসহ ৬ জন আন্দোলনকারী নিহত হয়েছে। যাত্রাবাড়ী থেকে একটি বড় মিছিল চানখারপুলে আসে। আনুমানিক দুপুর ২টার দিকে সেখান থেকে পুলিশ চলে যায়। ’

আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘আনুমানিক দেড়টার দিকে জানতে পারি শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পলিয়ে গেছে। আমরা মিছিল নিয়ে গণভবনের উদ্দেশে রওনা হই। চারটার দিকে আমরা সংসদ ভবন এলাকায় যাই। ’

ইএস/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।