২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়। এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ০৫ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের নয় আইনজীবী হাইকোর্টে রিট করেন।
এর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করেন। এরপর আপিল বিভাগ ১২ জন অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ দেন।
গত ০৮ মে থেকে ২৪ মে পর্যন্ত আপিল শুনানির ৬ কার্যদিবসে যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) উপস্থাপন করেন আপিল আবেদনের পক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা এবং রিট আবেদনের পক্ষে মনজিল মোরসেদ। পরে ১০ জন অ্যামিকাস কিউরি এবং স্বেচ্ছায় সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু তার মতামত উপস্থাপন করেন।
মতামতে জ্যেষ্ঠতম আইনজীবী টিএইচ খানের লিখিত বক্তব্য তুলে ধরে তার ছেলে আফজাল এইচ খান সাংবাদিকদের বলেন, উনি (টিএইচ খান) যে সাবমিশন দিয়েছেন সেটি হলো, হাইকোর্টের যে রায় সেটা বহাল রাখার জন্য। ওই রায়ে বলা হয়েছে ১৬তম সংশোধনী বাতিল ও সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংবিধানের সংঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
সংবিধান প্রণেতা ড.কামাল হোসেন বলেন , হাইকোর্ট বিভাগ অলরেডি এটাকে (ষোড়শ সংশোধনী) অবৈধ ঘোষণা করে দিয়েছে। ষোড়শ সংশোধনী মৌলিক কাঠামোয় আঘাত করেছে। এটা বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে খর্ব করেছে।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া বলেন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের ক্ষমতা প্রধান বিচারপতির হাতে থাকতে হবে। যদি এটা সংসদের হাতে দিয়ে দেওয়া হয় তাহলে ভারসাম্য নষ্ট হবে।
অপর সংবিধান প্রণেতা ব্যারিস্টার এম আমীর–উল-ইসলাম বলেন, কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে যদি কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হয়, তাহলে জুডিশিয়ারির তদন্ত হবে এবং সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেবেন। সারা দুনিয়া জুড়ে আমরা যে অবস্থা দেখছি, তাতে বিচারকদের অসদাচারণের কোনো ঘটনা ঘটে, তাহলে সেটি জুডিশিয়ারি ঠিক করবেন। সেটিই হবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী রোকনউদ্দিন মাহমুদ বলেন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল না থাকলে এখানে অরাজকতা হবে। আর এটি (ষোড়শ সংশোধনী) যদি হয়ে যায়, তাহলে হাইকোর্টের জজদের তো আপনি (প্রধান বিচারপতি) কিছু বলতে পারবেন না।
সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদ রয়েছে। এটা কারণে দলের বিপক্ষে ভোট দিলে সংসদ সদস্য পদ চলে যায়। এটা থাকার কারণে ইচ্ছা থাকার পরও স্বাধীনভাবে নিজ দলের বিরুদ্ধে মতামত দিতে পারেন না। এক্ষেত্রে কি জনগণের মতামত প্রতিফলিত হবে? হবে না। বিচারক অপসারণের বিষয়েও সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে মতামত দিতে পারবেন না। ফলে জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটবে না।
সেনা নিয়ন্ত্রিত সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইন উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ বলেন, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী ইন্ডিপেন্ডেন্ট অব জুডিশিয়ারির ওপর হস্তক্ষেপ। কারণ, এর মাধ্যমে জুডিশিয়ারিকে পার্লামেন্টের কাছে জবাবদিহিতা দিতে হয়। পার্লামেন্ট ও সরকার এক।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম আই ফারুকী বলেন,এই ষোড়শ সংশোধনী স্বাধীন বিচার বিভাগ ও গণতন্ত্রের মৌলিক কাঠামোর লঙ্ঘন। বিচারকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তা তদন্ত হতে হবে বিচারকদের দিয়েই, রাজনীতিবিদদের দিয়ে নয়।
সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ফিদা এম কামাল বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোরই অংশ। সুপ্রিম কোর্টের একাধিক রায়ে এটা বলা হয়েছে। এছাড়া এই সুপ্রিম কোর্টই রায় দিয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে রেখে দিয়েছে। এ ব্যবস্থাকে আদালত স্বচ্ছ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার রক্ষাকবচ হিসেবে উল্লেখ করেছে। এ অবস্থায় ১৬তম সংশোধনীর মাধ্যমে তা বাতিল করতে পারে না।
রিট আবেদনকারীদের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, মনে হয় অপর দুই অ্যামিকাস কিউরি রফিক-উল হক ও শফিক আহমেদ অসুস্থ। তাই তারা মতামত দিতে পারেন নি।
বাকী একজন ব্যারিস্টার আজমালুল হোসন কিউসি সংশোধনীর পক্ষে মতামত তুলে ধরে বলেন, ষোড়শ সংশোধনী বৈধ, এটা সংসদের এখতিয়ারের মধ্যে। সেজন্য এখানে কোনো ভুল ত্রুটি নাই। আর এটাকে স্ট্রাইকডাউন (বাতিল) করতে পারবে না।
আদালতের অনুমতি নিয়ে মতামত উপস্থাপনকারী আব্দুল মতিন খসরু বলেন, ৭২ সালের আদি সংবিধানে ফিরে যেতেই এ (১৬তম) সংশোধনী আনা হয়েছে। এ সংশোধনীর মাধ্যমে ৭২ এর ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন করা হয়েছে। আদি সংবিধানে হাত দেওয়া যাবে না। পরিবর্তন করা যাবে না’।
বাংলাদেশ সময়: ০১০৮ ঘণ্টা, মে ৩০,২০১৭
ইএস/বিএস