ইন্ডিয়ার বিখ্যাত পুনে ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের ডিরেকশন ফ্যাকাল্টিতে শিক্ষকতা করছেন গায়ত্রী চ্যাটার্জি। আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, শ্রীলংকা, ইন্ডিয়াসহ বিভিন্ন দেশে ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স পরিচালনা করেছেন তিনি ।
চলচ্চিত্র নিয়ে এ সময় বাংলানিউজের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট সোহেল রহমানের সঙ্গে কথা হয় অধ্যাপক গায়ত্রী চ্যাটার্জির। আলাপচারিতার চুম্বক অংশ ও ওয়ার্কশপের ফোকাল পয়েন্টগুলো তুলে ধরা হলো।
তরুণ নিমার্তাদের উদ্দেশ্যে গায়ত্রী চ্যাটার্জি বলেন, টেলিভিশনের নাটকের সিরিয়াল দেখা ও ফিল্ম রিভিউ পড়া বন্ধ করে প্রচন্ড অনুশীলন, একটু একটু করে ছবি নির্মাণ, এডিটিং ও ক্যামেরার কাজ, পেইন্টিং দেখা ,গান শোনা, ইতিহাস পড়াসহ প্রচুর সংখ্যক ভাল চলচ্চিত্র দেখতে হবে। আগামী ২ বছরের জন্য টেলিভিশন দেখা ও ফিল্ম রিভিউ পড়া বন্ধ করুক। তারপরেই তাদের পক্ষে সম্ভব ভাল চলচ্চিত্র নির্মাণ করা।
অধ্যাপক চ্যাটার্জি বলেন, খুব দু:খ লাগে যখন শুনি সিনেমার মান কমে গেছে। সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, অভিরাম সেনদের পর এ উপমহাদেশে ভালো নির্মাতা বলতে গেলে এখন আর বেরিয়ে আসছে না। তবে অনেকের কাজ ভালো হচ্ছে । কিন্তু এ সংখ্যাও হাতে গোনা। বাংলাদেশে তানভীর মোকাম্মেল, তারেক মাসুদরা ভাল কাজ করছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউশন, ফিল্ম এক্সিবিশন ইত্যাদি সমস্যা এক্ষেত্রে বড় অন্তরায় হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, নির্মাতারা সব ধরনের ছবি বানাবে। সরকারকে তা দেখে রিলিজ দিতে হবে। ছবির ভাল খারাপ বেছে নেওয়ার দায়িত্ব দর্শকের। তারাই বলবে কোন ছবিটা ভাল আর কোনটা খারাপ? কিন্তু দর্শককে তা দেখতে দেওয়া হচ্ছে না। একধরনের মেকি ফিল্ম দর্শকের জন্য রিলিজ দিচ্ছে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
গায়ত্রী চ্যাটার্জি বলেন, ধীরে ধীরে অবশ্য এ সংকট সমাধান হচ্ছে। সচেতনতা আসছে। কিন্তু এতে চেয়ে থাকলে চলবে না। আমাদেন আরো বেশি সক্রিয় হতে হবে। ছবির জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, প্রাইভেট সেক্টর, থিয়েটার মালিকদের চাপ দিতে হবে। তারা এগিয়ে এলে সংকট কাটবে।
গায়ত্রী জানান, এশিয়ায় বর্তমানে চীন,থাইল্যান্ড, ইন্ডিয়া, তাইওয়ান, শ্রীলংকার কিছু নির্মাতা ভাল ছবি বানাচ্ছেন।
বাংলানিউজকে গায়ত্রী বলেন, সিনেমার ফর্ম , স্ট্রাকচার ও রিয়েলিজমের উপরই মূলত পাচঁ দিনের ওয়ার্কশপটা করিয়েছি।
পাচঁদিনের ওয়ার্কশপের সারাংশ :
সত্যজিৎ রায়ের অস্কারজয়ী চলচ্চিত্র পথের পাচাঁলী দিয়ে শুরু হয় ওয়ার্কশপ। একটি ফিল্মের শুরু, মধ্যভাগ এবং শেষ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত একটি সময়কে ধারন করে ফিল্ম এগিয়ে যায়। একটি ফিল্ম ওয়েল স্ট্রাকচার্ড কিনা-তাও বোঝা যায় এই তিনটি বিষয় থেকে।
এরপর কনটেম্পরারি ট্রেন্ড এর ছবি উরুগুয়ের গুইলম রোকেমোরা’র শর্ট ফিল্ম ‘গুড ট্রিপ’ এবং কান পুরস্কার পাওয়া ইসরাইলের শর্ট ফিল্ম ‘এনথেম’ ছবি প্রদর্শন করা হয়। প্রদর্শন শেষে ছবি দুটির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে গায়ত্রী বলেন, স্বল্প সময়ের ছবি গুড ট্রিপ। এ ছবির শুরুটা হয় একটা ফোরগ্রাউন্ড শটের মধ্য দিয়ে। তারপর ধীর গতিতে এগুতে থাকে ছবিটি। অসম্ভব রিয়েলিস্টিক এই ছবিটিতে দর্শকের অনুভুতিও বাড়তে থাকে ক্রমান্বয়ে। ‘এনথেম’ এর শুরুটা ধরতে দর্শককে একটু অপেক্ষা করতে হয়। মানুষের সততা, ভালবাসা ও সুকুমার অনুভুতির প্রকাশ এ ছবিটি। সহজ-সরল উদাসীন এক ব্যক্তি মানুষের কাজে নিজেকে নিবেদন করতে ভালবাসে। সব পর্যায়ে সে থাকে সৎ। ছবির শেষ দিকে দেখা যায় লোকটা আরেকটি জীবনের দায়িত্ব নিতেও তৈরি। ছবিটাতে পরিচালক যেন দর্শককে নির্দেশ করছেন, এই দিকে তাকাও। এ বিষয়টি দেখো। ছবি দুটির শট ডিউরেশন, স্লো স্পিড, সাউন্ড এবং থিমের উপর গুরুত্বারোপ করেন গায়ত্রী।
ফিল্মের ফর্ম ও স্ট্রাকচার নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে গায়ত্রী বলেন, এ দুটি বিষয়ে ৩০, ৫০ ও ৬০ এর দশকে ইউরোপ আমেরিকার নির্মাতারা বেশ ভেবেছেন। তিন ভাগে একটি ফিল্মের স্ট্রাকচার থাকলেও ফিল্মের ন্যারেটিভ স্ট্রাকচার হয় সাধারণত ৫ ভাগে।
এগুলো হচ্ছে যথাক্রমে ইন্ট্রুডাকশন, এক্সপোজিশন, ক্রাইসিস, ক্লাইমেক্স ও রিজলিউশন। প্রথম অংশে নায়ক-নায়িকার সামাজিক প্রেক্ষাপট, অবস্থান, সাইকোলজিক্যাল মেক-আপ ইত্যাদি উপস্থাপন করা হয়। পরের অংশে তারা কি করতে চায়। অর্থাৎ এ অংশটি হয়তো গোল ওরিয়েন্টেড হবে নয়তো হবে অবস্ট্রাকশন ওরিয়েন্টেড। তৃতীয় অংশে লক্ষ্যটা একটা বার্ধাঁ হয়ে দাড়াবে আর দর্শকরা তা ভাঙতে শুরু করবে। এর পরেই দেখা যাবে ক্লাইমেক্স। শেষের অংশে দেখা যাবে সংকটের সমাধান হবে, ঘটনার জট খুলবে। আলোচনার এ পর্যায়ে আসে ফ্রান্সের নির্মাতা পিয়েরে এতাক্স এর কথা।
১৯৬৩ সালে শর্ট ফিল্ম সেকশনে অস্কার পাওয়া তার চলচ্চিত্র ‘হ্যাপি এনিভার্সারি’ প্রর্দশন করা হয়। যে ছবিটির স্ক্রিপ্ট করেছিলেন জ্যঁ ক্লদ ক্যারিয়ে,অভিনয় করেছিলেন এতাক্স নিজেই। ফিল্ম শেষে গায়ত্রী বলেন, এখানে ফিল্মের গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় ‘বাইনারি’ বা দুটি চরিত্রের মধ্যে দু‘য়ের খেলা উপস্থাপান করা হয়েছে নিখুঁতভাবে। স্বামী-স্ত্রীর বিবাহবার্ষিকী উদযাপন নিয়ে ছবিটির গল্প। ক্যামেরা এঙ্গেলে বুঝিয়ে দেওয়া হয় বাইনারির বিষয়টি। ছবিটির ক্লোজ এনালাইসিস শেষে
গায়ত্রী বলেন, ফর্মাল স্ট্রাকচার তথা একটি ফিল্মের অন্যতম অপরিহার্য অংশ হচ্ছে মিজোসিন। যতটা নিখুঁতভাবে মিজোসিন তৈরি করা হবে, ফিল্মটি তত বেশি ভাল মানের হবে।
এরপরে দেখানো হয় ফিনল্যান্ডের ছবি আকি কাউরিসমাকি’র পরিচালিত ‘টেন মিনিটস ওল্ডার’ । এ ছবিতে তিনি রিয়েলিজম থেকে হঠাৎ করে অ্যাবসার্ড এর দিকে চলে যাওয়ার বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন। ছবিটির পরে প্রদর্শন করা হয়, স্পেনের নির্মাতা ভিক্টর এরিকের দশ মিনিটের ফিল্ম ‘লাইফটাইম’। ছবিটিতে রিয়েলিজম কে খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বলে গায়ত্রী ব্যাখ্যা দেন। পর্যায়ক্রমে দেখানো হয় আমেরিকান পরিচালক জিম জারমুশের ছবি ‘ইন্টেরিয়র ট্রেলার নাইট’ এবং জার্মান নির্মাতা ওয়ার্নার হেরজগের ছবি ‘টেন থাউজেন্ডস ইয়ার ওল্ডার’ ।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ভাল ভাল নির্মাতাদের বিভন্ন ছবি দেখিয়ে রিয়েলিজম, ফিল্ম ফর্ম ও স্ট্রাকচার বুঝিয়ে দেন।
অধ্যাপক গায়ত্রী বলেন, একটি ফিল্মকে বেধেঁ রাখে তার সাউন্ড। এজন্য ফিল্ম দেখার সময় খুব সতর্কভাবে সাউন্ড শুনতে হবে। ঋত্বিক ঘটকের ‘যুক্তি তক্ক গপ্পো’র উদাহরণ টেনে গায়ত্রী জানান, কারণ, যুক্তি ও গল্প নিয়ে একটি ফিল্ম এগিয়ে যায়।
স্পেনিশ ফিল্ম মেকার আলমাদুভারের প্রসঙ্গ এনে তিনি বলেন, বিচিত্র,অদ্ভুত, বিভৎস, বিস্ময়কর বিভিন্ন বিষয় তার ফিল্মে তুলে ধরেন এই নির্মাতা। তার নির্মিত ‘ভলবার’ ছবিটি এ পর্যায়ে প্রদর্শন করা হয়। ছবিটির প্রধান সব চরিত্রই মেয়ে। রিয়েলিস্টিক এ পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবিটি সবাই উপভোগ করেন।
নেদারল্যন্ডের স্বল্পদৈর্ঘ ছবি ‘গ্লাস’ প্রদর্শন করে গায়ত্রী বোঝান থিসিস,অ্যান্টি থিসিস এবং সিনথিসিস।
ছবি দেখা ও নির্মাণের সময় ইমেজ সাইজ, ক্যামেরা পজিশন, এঙ্গেল, কালার, পারস্পেকটিভ, ক্যামেরা মুভমেন্ট ও মিউজিকের উপর সবিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেন।
ফিল্মে নিউ রিয়েলিজম এসেছে ইতালীয় পরিচালকদের মাধ্যমে। তবে বিশ্বের অনেক জায়গায় এখন রিয়েলিস্টিক ফিল্ম নির্মিত হচ্ছে। রিয়েলিজম জানতে রসেলিনি, ফেলিনি, আব্বাস কিয়েরোস্তমি প্রমুখ চলচ্চিত্রকারদের ছবি দেখা ও তাদের নিয়ে পড়ার জন্য পরামর্শ দেন।
ইরানি চলচ্চিত্রকার আব্বাস কিয়েরোস্তমির বিখ্যাত ডকুমেন্টারি ফিল্ম ‘এবিসি আফ্রিকা’ প্রদর্শন করে গায়ত্রী বুঝিয়ে দেন ডকুমেন্টারি ফিল্ম , রিয়েলিজম,মানবতাবোধ ইত্যাদি বিষয়।
ওয়ার্কশপে সবশেষে দেখানো হয় এই দশকের সেরা দশটি ছবির একটি চীনের বিখ্যাত ছবি ‘স্টিল লাইফ’। ফিচার ফিল্মের ভেতর কিছুটা ডকুমেন্টারি স্টাইলের এই ছবিটি বানান চীনের পরিচালক জিয়া ঝাংকে।
একনজরে গায়ত্রী চ্যাটার্জি :
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি শেষ করে অধ্যাপক গায়ত্রী পড়াশুনা করেছেন ফিল্ম ও ফরাসী সাহিত্য নিয়ে। তিনি পুনে ইউনিভার্সিটির ফ্রেন্স সিনেমা ইনস্ট্রাকটর, ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিস,ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা, সফিয়া কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গেস্ট ফ্যাকাল্টি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি ইন্ডিয়ার বিখ্যাত পুনে ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের ফ্যাকাল্টি, ডিরেকশন হিসেবে শিক্ষকতা করছেন। এছাড়া তিনি আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, শ্রীলংকা,ইন্ডিয়াসহ বিভিন্ন দেশে ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স পরিচালনা করেছেন। ফিল্ম নিয়ে তিনি লিখেছেন বেশ কিছু মূল্যবান গ্রন্থ । যা চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কাছে খুবই সমাদৃত।