ঢাকা: কানায় কানায় পূর্ণ গোটা মিলনায়তন। ছবি দেখতে এসেছে সবাই।
শনিবার কেন্দ্রীয় লাইব্রেরী মিলনায়তনে এ আয়োজন। স্মরণসভা ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনী। বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরাম, প্রামাণ্যচিত্র পর্ষদ ও ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ এ অনুষ্ঠানের আয়োজক।
‘দেশের দ্রব্যমূল্য থেকে শুরু করে সব কিছুর দাম বেড়েছে। বাড়েনি শুধু মানুষের জীবনের দাম। দিন দিন এটি আরো সস্তা হচ্ছে। মৃত্যুকে একসময় ধরে নিতাম নিয়তি নির্ধারিত। কিন্তু এখন মৃত্যুর জন্য দায়ী ক্ষমতাসীনদের লোভ, দূর্নীতি ও অসাধুতা। দূর্নীতির জন্য মহাসড়কটি ঠিক হয়নি। এই সড়কের ফলেই ঘটেছে দূর্ঘটনা। চলে গেছে তারেক ও মিশুক। শোকের চেয়েও বেশি ক্ষোভ ও ক্রোধ প্রকাশ করতে আমরা এখানে এসেছি। ’ বললেন প্রখ্যাত কথাশিল্পী হাসনাত আবদুল হাই।
তারেক মাসুদ পরিচালিত রানওয়ে ও নরসুন্দর ছবির প্রদর্শনী হয়েছে এর একটু আগে। বিকেল সাড়ে তিনটা থেকে শুরু হয় স্মরণসভা।
‘যে স্থানে এতদিন চলচ্চিত্র নিয়ে আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছি, সেখানে আজ শোকগাথাঁ। ভাবিনি কোনদিন এমন হবে। ’ মঞ্চে ওঠে বললেন চলচ্চিত্রকার ও লেখক মানজারে হাসিন মুরাদ।
এরপর একে একে শোকের মঞ্চে আসেন চলচ্চিত্র নির্মাতা তানভীর মোকাম্মেল, মোরশেদুল ইসলাম, নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, পররাষ্ট্র সচিব ও শিল্প সমালোচক মিজানুল কায়েস,অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচী, অভিনেতা জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, চলচ্চিত্রের শিক্ষক সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকী, সুজাউদ্দিন আহমেদ, মুক্তিযোদ্ধা মফিদুল হক, জাহিদুর রহমান অঞ্জন, শিশির ভট্টচার্য, তন্ময় মুনীর, সাজ্জাদ শরীফ, ড.জাহাঙ্গীর হোসেন,শবনম পারভীন, নাসির আলী মামুনসহ আরো অনেকে।
নিছক সুগন্ধীমাখা শোক কিংবা গৎবাঁধা স্মৃতিচারনা নয়, প্রতিবাদের উচ্চারনই ছিল সবার মুখে। শোক কে শক্তিতে পরিণত করে তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের জীবন আদর্শ ও স্বপ্নকে ধারণ করে কাজ করার প্রত্যয় ঝরে পড়ছিল তাদের কথায়। দেশের সেরা সন্তানদের এমন মৃত্যুর মিছিল যেন আর না ঘটে এ আহবান সবার। সড়ক দূর্ঘটনারোধে অব্যাহত আন্দোলনের কথাও জানান তারা।
‘অসাম্প্রদায়িক,গণতান্ত্রিক সুসভ্য দেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন ছিল তারেকের। দেশের বাইরে বিশ্ব চলচ্চিত্রে স্থান করে নিয়েছিল তার ছবি। কারিগরি ও শিল্পবোধ উভয়ক্ষেত্রেই ছিল তার সমান দক্ষতা। বিশ্বের যেকোন দেশ,যে কোন সমাজ তাকে পেলে গর্ববোধ করত। তারেককে আমরা হারিয়েছি। এমন মৃত্যু আর দেখতে চাই না। ’ ৪০ বছরের চলচ্চিত্র আন্দোলনের সহযোদ্ধা, বন্ধু তানভীর মোকাম্মেল বললেন একথাগুলো।
একই সুরে বললেন আরেক সহযোদ্ধা মোরশেদুল ইসলাম। সুস্থধারার চলচ্চিত্র আন্দোলন ও প্ল্যাটফর্ম গড়তে তারেকের অবদান ছিল অনস্বীকার্য। চলচ্চিত্রকে কেন্দ্র করেই ছিল তার সব স্বপ্ন। তরুনরা আবার প্রাণবন্ত হয়ে কাজ করলে তার সে সব স্বপ্ন পূরণ হবে।
নাসির উদ্দিন ইউসুফ জানান, দেশকে ভালবেসে মানুষের মুক্তির অন্বেষা ও মানুষের প্রতি বিশ্বাস রেখে মানুষের ভাষায় রূপান্তরিত করেছিল চলচ্চিত্রকে তারেক মাসুদ। শুধু দেশের নয়, তার মৃত্যু বিশ্বচলচ্চিত্রের জন্য অনেক বড় এক অপঘাত।
জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় শোকার্ত উচ্চারণে পাঠ করলেন তারেককে নিয়ে কবিতা ‘শূন্যতার মধ্যে আমি একা’।
রোকেয় প্রাচী বললেন, তারেক মাসুদ একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরী করে দিয়েছিলেন। নিজেকে এখন সবচেয়ে দূর্ভাগা লাগে। স্মরণসভায় আর যেতে চাই না। তারেকের স্বপ্নের জায়গায় পৌঁছুনোই হবে আমাদের কাজ। সারা জীবন তাদের বহন করব।
সন্ধ্যায় আবার শুরু হয় রানওয়ে’র প্রদর্শনী। চলচ্চিত্রপ্রেমী হাজারো দর্শকের উপচে পড়া ভীড়। তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরকে ভালবেসে তারা জড়ো হয়েছে।
সবার হাতে হাতে কালো ছোট্ট কাগজ। তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের জন্য শোকগাথা। তাতে লেখা: বন্ধু, আমরা তোমাদের কবর দিইনি, আমরা তোমাদের রোপন করেছি ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে।
বাংলাদেশ সময়: ২১৪০ ঘণ্টা,আগষ্ট ১৯, ২০১১