যাবো না শহরের যান্ত্রিক জীবনে ফিরে। মনে পড়লো, কয়েকদিন আগে শিলং থেকে দেখে আসা এলিফ্যান্ট ফলস এর কথা।
দুপুর গড়িয়ে বিকেলের আভা দেখা দিতে শুর“ করেছে চারিদিকে। পাহাড়গুলো নীলচে একটা আভা ধারণ করেছে। দলের সবাই মিলে একটা পাহাড়ের চুড়ার একটু নিচে দাঁড়িয়ে পড়লাম। দৃষ্টিসীমার একপাশে উড়ন্ত মেঘগুলো পাহাড়ের চুড়ায় এসে আছড়ে আছড়ে পড়ছিল। অন্যপাশে অস্তগামী সূর্যের শেষ আলোকচ্ছটা এসে পড়েছে পাহাড়ের গায়ে আর মেঘের ওপর। সে সৌন্দর্য্যকে ভাষায় প্রকাশ করার কোনো শব্দ আমার কাছে নেই। আবার মনে হলো, কত সুন্দর এই দেশ, কতকিছু দেখার বাকি, বাকি কতকিছু আবিস্কারের। উঁচু উঁচু পাহাড় আর সূর্যের শেষ আলোয় ঝলসে উঠা মেঘগুলো নিচের দিকে ফেলে আমরা তখনো উর্ধ্বগামী।
আশপাশের অনেক পাহাড়ের গায়ে দেখলাম জুম চাষ করেছে আদিবাসীরা। আর যেখানটাতে জুম চাষ করা হয়েছে সেখানকার রং অন্যরকম। কালচে সবুজ বৃক্ষগুলো কেটে সেখানে সমতল একটা করে ঢাল তৈরি করেছে তারা, যার ফলে অন্যান্য পাহাড়ের চেহারার সাথে জুম চাষের পাহাড়ের সুস্পষ্ট পার্থক্য দেখা যায়। মনে হয়, কোন এক মনোযোগী শিল্পী তার নিপুন হাতে খুব যতœ নিয়ে পাহাড়কে সাজিয়েছে। রাস্তার ঠিক পাশেই দেখা মিললো একজন জুম চাষীর। সে তার আদাক্ষেতের পরিচর্যা করছিল। তার নাম রবার্ট। রবার্ট জানালো, তারা শুধু আদা নয় হলুদের চাষও করছে ইদানিং। আর রবার্টের যে আদাক্ষেত তার অনেক নিচে পাহাড়ের দুটি সাড়ি প্রায় একই উচ্চতায় চলে গেছে বহুদুর। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে আমরা পৌছলাম দার্জিলিং পাড়ায়। একটা দোকান পাওয়া গেল। প্রচন্ড ক্ষুধার্ত আমরা দোকানের বিস্কুটগুলো দ্র“ত সাবার করতে শুরু করলাম। এখানে চা পাওয়া গেল। দোকানের সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়া দুজন আদিবাসীর ছবি তুললো আমাদের দলে একজন। কিন্তু এর ফল ভালো হলো না। যাদের ছবি তোলা হলো তারা অনেক রেগে গেল।
বুঝলাম, এসব এলাকায় মানুষের যাতায়াত যত বাড়ছে ততই চলাফেরায় আর জীবনযাপনের স্বাভাবিকতা ব্যাহত হচ্ছে এখানকার বাসিন্দাদের। দার্জিলিং পাড়া থেকেই দেখা গেল কেওক্রাডং এর চুড়া। স্থানীয় লোকজন বললো, আমরা কাছাকাছি এসে গেছি। কেওক্রাডং এর একদম পায়ের কাছেই এই দার্জিলিং পাড়া। কিš‘ গত দুই দিনের অভিজ্ঞতা বলে, এসব কথা বিশ্বাস করা কোন কারণ নেই। পাহাড়কে যত কাছে দেখা যায় আসলে তা ততটাই দুরে। আর এখানকার আদিবাসীরা যেখানে যেতে ১ ঘণ্টার কথা বলে সেখানে যেতে আমাদের লাগে ৩ ঘণ্টার মতো। তারা বলে, এই তো কাছেই। আর আমাদের কাছে সে পথ শেষই হতে চায় না। পরে, আমরা বুঝতে পেরেছি বেশিরভাগ আদিবাসীর কাছেই ঘড়ি থাকে না তাই অনুমান নির্ভর সময়ের কথা বলে তারা। দার্জিলিং পাড়ায় ১০/১৫ মিনিটি বিশ্রাম নিয়ে দেখা যাওয়া সেই কেওক্রাডং এর চুড়ার দিকে ওঠা শুরু করলাম। সূর্য্য তখন খুব দ্রুত গতিতে পাহাড়ের আড়ালে চলে যাচ্ছে, রেখে যাচ্ছে তার আভা। সে আভায় নীলচে আর সোনালী আভায় বর্ণিল হয়ে উঠছে দিগন্তরেখা।
কাছাকছি এসে গেছি, বিজয়ের আনন্দ হৃদয়কে স্পর্শ করতে শুরু করেছে। আর একটু, আর একটু। এসে গেছি প্রায়। হঠাৎ একটা পাকা সিড়ি দেখে অবাক হলাম। এটাই কেওক্রাডং এর চুড়ায় ওঠার সর্বশেষ প্রক্রিয়া। হাতে গোনা ২৫/৩০ টি ধাপ পেরোলেই যেখানে পৌঁছাবো সেটাই কেওক্রাডং এর চুড়া। কিন্তু মনটা খারাপ হয়ে গেল কিছুটা। সারাটা পথ এত কষ্ট করে এসে এই সিঁড়ি দিয়ে আরামে উঠতে গিয়ে মনে হলো এই রোমাঞ্চকর যাত্রার ছন্দ অনেকটাই ব্যাহত হলো। এতকিছু ভেবে লাভ নেই।
এর আগে কত রোমাঞ্চপ্রিয় মানুষ এই জায়গাটা স্পর্শ করে বিজয়ের আনন্দ পেয়েছে! কত মানুষ নিজেকে সবার ওপরে ভেবেছে! সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা তখন। সেই কেওক্রাডং এর চুড়ায় আমি। সমুদ্র সমতল থেকে ৩২০০ ফিট ওপরে। টিপু আর তানিম চুড়ায় স্বাগত জানালো আমাকে। ততক্ষণে, অন্ধকার নেমে এসেছে কিন্তু সে চুড়া থেকে চারিদিকে তাকিয়ে মনে হলো, একটা মেঘের রাজ্যে একখণ্ড মাটির ওপর ভাসছি। মনে হলো, কেওক্রাডং বিজয়ের জন্য আমাদের শুভেচ্ছা জানাতেই বুঝি মেঘের ভেলা ভাসানো হয়েছে চারিদিকে...