আন্তর্জাতিক নারী দিবস ৮মার্চ । হাজার বছরের নারী আন্দোলনের একটি মাইলফলক।
১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেন হেগেনে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলনে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নারী ক্লারা জেটকিন এর প্রস্তাবে সর্বসম্মতিক্রমে ৮ মার্চ নারী দিবস পালন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে ‘আন্তজাতিক নারী দিবস’ হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়।
একটি বিশেষ দিবস পালনের মধ্য দিয়ে নারী পুরুষের সমঅধিকার সম্পন্ন পৃথিবী গড়া সম্ভব নয়। তারপরও যদি কোনো কোনো দিন একটি প্রতীকী দিন হিসেবে উদযাপিত হয় তাহলে তা কোনভাবেই খাটো করে দেখা ঠিক নয়। ৮ মার্চ তাই সমাজ ও সভ্যতার অগ্রগতির ক্ষেত্রে সে রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন।
আজকের দিনে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি বিশ্বব্যাপী নারী মুক্তির আন্দোলনে যারা নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন সেইসব সংগ্রামী নারী পুরুষদের। এদের মধ্যে অবশ্যই জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিন, ভারত উপমহাদেশে সতীদাহ প্রথারোধকারী রাজা রামমোহন রায়, স্ত্রী শিক্ষা প্রচলনের অগ্রদূত ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসগর, মুসলিম নারী শিক্ষার অগ্রগতির পথিক বেগম রোকেয়া ও বেগম সুফিয়া কামালকে।
নারীর ওপর সকল শোষন-বৈষম্য-আধিপত্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য যে সংগ্রাম সে সংগ্রাম কতটা ফলপ্রসু হয়েছে তা পর্যালোচনা করলে সন্তোষজনক অর্জন নেই বললেই চলে।
পুরুষ তার ব্যক্তিগত লোভ লালসা চরিতার্থতার জন্য আরাম আয়েশ, পরিতৃপ্তির জন্য নারী সমাজকে দাসী বানিয়ে রেখেছে। এই বৈষম্য রোধ করার জন্যই একসময় নারী পুরুষের সমঅধিকারের কথা আসে।
আজ আমরা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছি? সমাজে আমাদের অবস্থানটি কোথায়? স্বামী-স্ত্রী উভয়ের সংসার অথচ কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব, সম্পদ-সম্পত্তি কোন কিছুতে সমঅধিকার নেই নারীর। শুধু কি তাই অতন্দ্র প্রহরীর সতর্কতার একটি শিশুকে মানুষ করে তোলেন মা। অথচ সন্তানের অভিভাবক মা নয়, বাবা। এমনকি বাবার অবর্তমানে অভিভাবকের দায়িত্ব পড়ে মামা-চাচা স্থানীয় ব্যক্তিদের ওপর। এরচেয়ে অবাক কা- আর কী হতে পারে ? নারীর মানুষ ও ব্যক্তি হিসেবে সম্মান পাবার বিষয়টি নিয়ে সংক্ষেপে এমন বলা যায় যে, আমাদের দেশে যদিও নারীকে মা হিসেবে সাধারণত সম্মান দেখাবার চেষ্ঠা করা হয় কিš‘ মানুষ ও ব্যক্তি হিসেবে তার প্রাপ্য সম্মান তাকে দেয়া হয় না। স্ত্রী হিসেবেও তার প্রাপ্য সম্মান তাকে দেয়া হয় না।
দেশের বেশিরভাগ নারী সমাজের ওপর এই একবিংশ শতাব্দীতেও চলছে পুরুষতান্ত্রিক নিপীড়ন, নানা শোষন, বৈষম্য। চলছে ফতোয়াবাজি, নারী নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন, ধর্ষন, তালাক, যৌতুক, এসিড নিক্ষেপ, নারী পাচার। ঘরে বাইরে কোথাও নিরাপত্তা নেই নারীর। বিজ্ঞাপনের নামে নেতিবাচক, অমর্যাদাকর অবমাননাকর সনাতনী দৃষ্টি ভঙ্গির পরিচয় মেলে গণমাধ্যমেও।
নারীর সম্মান পাবার বিষয়টি আবার নারী সমাজের ক্ষমতায়নকে বাস্তবায়িত করার সাথে ওতোপ্রতো ভাবে জড়িত। তবে ‘ক্ষমতায়ন’ যথার্থ অর্থে যে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নয়, সে কথাটি আমাদের বিশেষভাবে বুঝতে হবে। বাস্তবে দেখা যায়, নারীরা প্রায়শঃই নিজের অর্জিত অর্থ ব্যয় করার স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত। স্বউপার্জিত অর্থ ব্যয় করতে স্বামী বা গৃহকর্তার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। তাই বলা যায়, নারীর যথার্থ ক্ষমতায়ন তখনই বাস্তবায়িত হবে যখন সমাজে নারী পুরুষের সমমর্যাদা পাবে।
তাই নারীর ক্ষমতায়নের প্রসার কেবল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ঘটালেই হবে না, সামাজিক, রাজনৈতিক, রাষ্ট্রিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে নারীকে ক্ষমতাসীন করে দায়িত্বশীল ভূমিক পালন করার সুযোগ দিতে হবে। একইভাবে পরিবারের ক্ষুদ্র গ-ির বাইরে বৃহত্তর পরিসরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানা ভূমিকায় পারদর্শী এক দায়িত্বশীল নারী সমাজ সৃষ্টি দ্বারাই সমাজের পুরুষতান্ত্রিকতাকে দূরীভূত করা সম্ভব।
পরিশেষে আমি মনে করি অধিকার কেউ চাইলেই দেয় না, লড়াই সংগ্রাম করে আদায় করতে হয়। আমি বিশ্বাস করি দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী যদি তার নায্য অধিকার আদায়ের জন্য সচেতনভাবে চেষ্ঠা করি তাহলে এই শক্তিকে অবজ্ঞা বা অবহেলা করার কেউ নেই। আর তার জন্য সবচেয়ে আগে যা প্রয়োজন তা নারীকে আগে নিজেকে নিজে সম্মান করতে শিখতে হবে; পাশাপাশি নারী হয়ে অন্য নারীকেও সম্মান দিতে হবে।
লতিফা নিলুফার পাপড়ি: কলাম লেখক, কবি, গল্পকার, শিক্ষক। ই-মেইল: lnpapri@gmail.com