অনেক দূর থেকে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় নামের একটি প্রতিষ্ঠানের গল্প শোনা আর সেখানে গিয়ে নিজের চোখে দেখার অভিজ্ঞতার মধ্যে স্বপ্ন আর বাস্তবতার মতোই পার্থক্য। ২০১১ সালের অক্টোবরের মাঝামাঝি, কিছু কাজ নিয়ে আমি ইংল্যান্ডে।
এক রোদ ঝলমলে দিনে লন্ডনের সেইন্ট এন্ড্রুজ কলেজের বার্ষিক বনভোজনে যোগ দিলাম। এই কলেজের মালিক আমার খুব কাছের এক বড় ভাই। সাথে লন্ডনে থাকা আমার বন্ধু পিয়াস। দুটি বড় বড় বাস বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীদের নিয়ে কেমব্রিজের উদ্দেশ্যে চলতে শুরু করলো। যাবার কয়েক দিনের মাথায় সেটাই আমার প্রথম লন্ডনের বাইরে যাওয়া। শহর থেকে বেরোনোর পরই দৃশ্যপট বদলাতে লাগলো। সবকিছুই ছবির মতো।
চোখে মুগ্ধতার রেশ কাটলো না, ৭৯ কিলোমিটারের দূরত্ব শেষ হলো। কেমব্রিজ বিশ্বাবদ্যালয়ে পৌঁছোলাম আমরা। বিশ্বের সপ্তম প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়। ১২০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু বিদ্বান মানুষদের মধ্যে দ্বন্দ্বের ফলে এক দল বেরিয়ে এসে এই কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ব্রিটিশ সমাজে এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বন্দ্বের একটা সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে। যদিও প্রাচীন এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশিষ্ট্যে এতই মিল যে, দুটিকে একত্রে কখনো কখনো ‘অক্সব্রিজ’ও বলা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে কেমব্রিজের প্রাচীন পথে হাঁটতে লাগলাম আমরা। প্রথমেই একটা সরু খাল পেরোলাম, প্রাচীন একটা ব্রিজের ওপর দিয়ে। পরে জেনেছি ওটা খাল নয়, ক্যাম নদী। হয়তো এমনও হতে পারে যে, ক্যাম নদীর ওপর প্রাচীন অনেকগুলো ব্রিজ আর তার সাথেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে ওঠার কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ‘কেমব্রিজ’ হয়েছে।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের দিকে একটু একটু করে এগোচ্ছি আর মনে হচ্ছে এক’শ দুই’শ বছর করে পেছনের দিকে যাচ্ছি। মনে হলো, খুব যত্ন করে বয়স ধরে রাখা হয়েছে ভবনগুলোর শরীর জুড়ে। ১৪৪১ সালে স্থাপিত ‘কিংস কলেজ’ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। ঘন সবুজ ঘাসের চাদর বিছানো কিংস কলেজের প্রবেশ পথের দুপাশে। দেখলে মনে হবে মহা পরাক্রমশালী কোন রাজার বাড়ি। মনের মুগ্ধতার পুরোটা ছবিতে ধরে রাখা যায় না, তবুও ছবি তোলা। ভেতরে ঢোকা গেল না কারণ তখন ক্লাস চলছিল। কিংস কলেজের ঠিক সামনেই ‘করপাস খ্রিস্টি কলেজ’ আর তার দেয়ালেই খুব বড় সড় এবং অদ্ভুত ধরণের সোনালী ঘড়ি। আসলে ২৪ ক্যারেট সোনায় মোড়ানো স্টিলের পাত দিয়ে এই ঘড়ি তৈরি করা হয়েছে। বিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং এই ঘড়ি উদ্বোধন করেন ২০০৮ সালে।
একটু সামনে এগিয়ে যাই। ডান পাশে ‘সেইন্ট জোনস চ্যাপেল’ রেখে সামনের দিকে পা বাড়াই।
অনেকগুলো কলেজের সমন্বয়ে এই কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের ছায়ায় থাকলেও ৩১ টি কলেজ তো স্ব-নামে বিশ্ব বিখ্যাত। এক এক করে সামনে পড়ে কুইন্স, ইমানুয়েল,ডারউইন, চার্চিল, রবিনসনের মতো কলেজগুলো। চোখ জুড়ালে ক্লান্তি আসে না। তাই পৃথিবীর প্রাচীন বিদ্যা নিকেতনে হাঁটতেই থাকি হাঁটতেই থাকি।
হাঁটতে থাকি সেইসব অলিগলিতে যেখানে এক সময় চার্লস ডারউইন, আইজ্যাক নিউটন, জেমস ওয়াটসন, প্রিন্স এডওয়ার্ড, জন মিল্টন আর স্টিফেন হকিং এর মতো মহামানবরা প্রতিদিন চলাফেরা করতেন। নিজেকে ক্রমেই ক্ষুদ্র লাগতে থাকে।
এক একটি ভবনের দিকে তাকালে তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করে। কত ইতিহাস! মনে হয়, একেবারে থেকে যাই। সেটা না হোক, অন্তত: প্রাচীন একটা গাছের নিচে বসে সারাটা দিন কাটাতে পারলেও তো হতো। কিন্তু কিছু করার নেই। ঘুরতে ঘুরতে আবারো ক্যাম নদী সামনে এসে পড়ে। কবুতরের মতো কিছু পাখি বার বার ঝাপিয়ে পড়ে সেই নদীর পানিতে। একটা ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে থাকি অনেকক্ষণ। ভিন্ন রকম কিছু বৈঠার নৌকা ভেসে বেড়ায় চোখের সামনে। আর তাতে হেলান দিয়ে বসে আয়েসী কিছু পর্যটক নৌ-পথে কেমব্রিজের ক্যাম্পাস দেখছেন। নদীর ওপর, ব্রিজের ওপর ঝুঁকে পড়েছে লাল, হলুদ, সবুজ রঙ এর পাতাওয়ালা গাছেরা। আর এই ছোট্ট নদীর কিনার জুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিপাটি ভবনগুলো।
ফিরতে হয়। কিন্তু আইজ্যাক নিউটন ডাক দিলেন হঠাৎ। ট্রিনিটি কলেজ না দেখেই ফিরবো তা হয়তো ভালো লাগেনি তার। ট্রিনিটি কলেজ। কলেজের বিশাল গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকছি। মনে হচ্ছে, ১৬৬১ থেকে ১৬৬৭ সালের কোনো এক দিন।
মনে হচ্ছে, কলেজের মাঠে হয়তো দেখা হবে নিউটনের সাথে। ভেতরে ঢুকলাম। অর্ধেকটা পর্যন্ত যেতে পারলাম। বাঁকি অর্ধেকে খুব পরিপাটি ড্রেস পরে দাঁড়ানো কয়েকজন গার্ড। দেখলে মনে হবে, কোন কর্পোরেট অফিসের কর্মকর্তা। তারা বিনয়ের সাথে আর সামনে যেতে নিষেধ করলো। কারণ, অন্য পাশটাতে ক্লাস চলছে তখন। মাঠের মাঝখানটাতে খুব সুন্দর একটা ছোট্ট বাগান। সেইন্ট এন্ড্রুজ কলেজের মালিক আমার সেই বড় ভাই বুকের বাম পাশটাতে হাত দিয়ে রাখলেন সারাক্ষণ। বললেন, নিউটনের সেই ট্রিনিটি কলেজ, হৃদয়ে অন্যরকম একটা অনুভুতি হচ্ছে। বলে বোঝাতে পারবো না।
বেরিয়ে আসি ট্রিনিটি কলেজ থেকে। কেন জানি গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। কেউ একজন বললো, যে আপেল গাছ থেকে আপেল পড়তে দেখে মধ্যাকর্ষণ শক্তির সূত্র আবিস্কার করেছিলেন নিউটন, সেই গাছ দেখেছি কি না! না দেখিনি, বলতেই আঙ্গুল তুলে দেখালো। কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। ট্রিনিটি কলেজের গেটের সাথেই ছোট্ট একটা গাছ, আপেল গাছ। আমি সত্যি জানি না, এটা সত্যি কি না? নিউটন এই আপেল গাছের নিচেই বসে ছিলেন কি না? আমি সত্যিই জানি না, এতদিন সেই আপেল গাছ টিকে থাকা সম্ভব কি না। কিন্তু সেই আপেল গাছের একটু দূরে বসে পড়ি, ছবি তুলি কয়েকটা। নিউটনের সেই আপেল গাছ...