বৈশাখীর অনেক নাম শুনেছি কিন্তু চোখে দেখিনি তাকে। প্রথম দেখার পর মনে হয়েছিল যতটুকু শুনেছি তার চাইতে অনেক গুন বেশি সুন্দর বৈশাখী।
আর তখনকার সময় আমার বন্ধু আজিজ আসা যাওয়া করতো বৈশাখীর সাথে। আমার খুব লোভ হত ওদের এই মধুর সম্পর্ক দেখে। সত্যি বলতে আজিজের মুখেই বৈশাখীর নাম বেশি শোনা হত। বৈশাখী এতো সুন্দর ছিল যে তার সাথে আমি আর কাউকে তুলনা করতে পারতাম না। তাকে ভাললাগার আরেকটা কারণ হচ্ছে সে যাদেরকে সাথে করে চলাফেরা করতো তারা সবাই ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী।
আমার নিজেকে অনেক অসহায় মনে হত মনে মনে ভাবতাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেনো ছাত্র হতে পারলাম না? তারপরও যদি একদিন বৈশাখীর সাথে ঘুরতে পারতাম। নিজেকে অনেক ধন্য মনে হত। আজিজের সাথে বৈশাখীর অনেক বন্ধুত্ব ছিল। আজিজকে রেখে বৈশাখী কোনদিন যেতো না। আমরা তখন মিরপুরে থাকতাম তিন তলায় সামনা সামনি ফ্লাটে। এক পাশে আমরা আর অন্য পাশে থাকতো আজিজরা ওরা তিন জন থাকতো। তিন জনই ছিল স্টুডেন্ট, আর আমার সাথে আরও দুই জন ছিল কিন্তু তাদের সাথে আমার এতো বেশি সম্পর্ক ছিল না। আজিজ আমি একই জেলার ছিলাম বলে ওর সাথে আমার সম্পর্কটা একটু বেশি ছিল। আমি থাকতাম আমার কোম্পানির কাজে, তখন আমি বায়িং হাউসে কাজ করতাম। কিউ সি বায়ার ছিলাম তাই কাজে এতো ধরাবাঁধা ছিলনা। আজিজ সকালে যখন বের হত তখন আমার চোখে অনেক ঘুম থাকতো কিন্তু তবুও আমি বৈশাখীকে দেখার জন্য ব্যাকুল থাকতাম, তাইতো গিয়ে দাঁড়াতাম সামনের বারান্দায়।
যেখান থেকে প্রিয় বৈশাখীকে কাছ থেকে দেখা যেতো কোনো দিন আজিজ অপেক্ষা করতো বৈশাখীর জন্য আবার কোনো দিন বৈশাখী আগেই এসে দাঁড়াত। টাইমের বেলায় অনেক সচেতন ছিল বৈশাখী। যদিও আজিজ তার বন্ধু ছিল কিন্তু পাঁচ মিনিটের বেশি কোনোদিন তার জন্য অপেক্ষা করতো না। তাকে না পেলে অন্যদের সাথে চলে যেতো। আমার খুব কষ্ট হত কষ্টটা আমার জন্য না আজিজের জন্য। সে আজকে বৈশাখীকে মিস করল। দিন আসে দিন যায় এভাবে দিনে দিনে বৈশাখী হয়ে ওঠে আমার স্বপ্ন। কিন্তু আমার সেই সাধ্য কোথায় তার সাথে একদিন ঘোরার।
বৈশাখীর কাছে গিয়েও আমার ভয় করতো কারণ সব সময় তার সাথে একজন বডিগার্ড থাকতো। বৈশাখী অনেক ভালো ছিলো তাই বডিগার্ড তাকে যেটা বলত সেটাই শুনত। আমিও মনে মনে বুদ্ধি করলাম প্রথমে বডিগার্ড কে পটাতে হবে তারপর বৈশাখীর সঙ্গে একদিন ঘুরবো। যেদিন ভাবলাম পরদিন আমি বৈশাখীর জন্য পথপানে চেয়ে থাকলাম কিন্তু বৈশাখী সেইদিন এলো না। বৈশাখীর আরেক বান্ধবী ছিল চৈতালি আজিজ চৈতালির সাথে চলে গেলো চৈতালি যে সুন্দর না! সেটা কিন্তু না। কিন্তু আমার বৈশাখীকে বেশি ভাল লাগে হয়তো তার গল্প বেশি শুনেছি বলে। পরদিন তারপর পরদিন তিন দিন এলনা বৈশাখী আমার মনে অজানা একটা ভয় বাসা বাধতে লাগলো। কি হয়েছে বৈশাখীর আমাকে জানতেই হবে! কিন্তু কোথায় খুঁজব তাকে পরে আজিজকে জিজ্ঞেস করলাম যদিও জিজ্ঞেস করতে আমার লজ্জা করছিলো তারপর সব লজ্জা ভেঙ্গে তাকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম।
- দোস্ত বলতো আজ কয়েক দিন দেখি তুই বৈশাখীর সাথে যাসনা কি ব্যাপার?
তখন তার থেকে যা শুনলাম মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। বৈশাখী এক্সিডেন্ট করেছিলো। কিন্তু আজিজ বলল কাল থেকে সে নাকি আবার বৈশাখীর সাথে যাবে। এটা শুনে কিছুটা ভাল লাগলো। পরদিন ঠিকই এলো কিন্তু আজ তার বডিগার্ড পরিবর্তন হয়ে গেছে। আজ আর দূর থেকে নয় বৈশাখীর কাছে গেলাম ওকে দেখার জন্য তার শরীরে কোন ক্ষত হয়েছে কিনা দেখার জন্য। বুকটা দুরু দুরু করছিল কিন্তু তাকে দেখার পর প্রশান্তিতে ভরে গেলো।
সেই এখন পুরোপুরি ঠিক আছে। কথা বললাম তার নিউ বডিগার্ড এর সাথে তার থেকে জানলাম কি হয়েছিল তার। সে অনেক ভালো লোক ছিল আমি তাকে রাজি করালাম আর পরদিন বের হলাম আজিজের সাথে। বৈশাখীর সাথে ঘুরবো বলে। আমি আজিজ আরো ভার্সিটির স্টুডেন্টস আছে আমাদের সাথে। আমার সে যে কি আনন্দ আমার অনেক দিনের স্বপ্ন আজ সত্যি হল। বৈশাখী আমাদের সাথে নিয়ে হেলে দুলে চলতে লাগলো বাতাস এসে আমার গায়ে লাগতে লাগলো। বৈশাখী কত যে ফ্রেন্ডলি আমি তখন বুঝতে পারলাম। বৈশাখীর সাথে যারা চলাফেরা করে তারাও অনেক ফ্রেন্ডলি।
কয়েক জনের সাথে আমার কথা হয় ভার্সিটিতে যাওয়ার পর ওরা সবাই ক্যাম্পাসে চলে গেলো সেই দিন আরও ভালো করে পরিচিত হলাম বৈশাখীর সাথে। আমার সেই দিন কাজ ছিল না তাই একটা রিকশা নিয়ে চলে গেলাম শাহাবাগ। তারপর ওখান থেকে বাসায় চলে এলাম। আমি আজও ভুলতে পারিনি সেই অনুভুতির কথা কিন্তু কিছু দিন পর ভার্সিটি ছুটি হয়ে গেলো দীর্ঘ দিনের জন্য সবাই অনেক খুশী ছিল কিন্তু আমি যে বৈশাখীকে অনেক মিস করবো। তারপর কিছুদিন যাওয়ার পর হঠাৎ এক রোড এক্সিডেন্টে ভীষণ ভাবে আহত হল আজীজ। তাকে দেখতে গেলাম ঢাকা মেডিক্যালে কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস হাসপাতালে গিয়ে শুনি আজীজ আর নেই। আমার বুক ফেটে কান্না এসেছিলো সেদিন চীৎকার করে কাঁদতে চেয়েছি, পারিনি কিন্তু নীরবে ঝরে গেলো আমার চোখের অশ্রুবিন্দু।
তারপর ফিরে এলাম বাসায় সেদিন রাতেই আমার ছোট খালা ফোন করে বললেন আমার আমার মামা আমার জন্য দুবাই থেকে ভিসা পাঠিয়েছেন। দুবাই যাওয়ার মন আমার কোনদিন ছিল না। কিন্তু কি করবো তখন আমার কাছে পুরো দেশটায় বিষাদপূরী মনে হচ্ছিলো। প্রিয় বন্ধূকে হারিয়ে আমি দিশেহারার মতো ছূটে চললাম গ্রামে তারপর কিছুদিন গ্রামে থাকার পর আবার চলে এলাম ঢাকায়। এবার আমি ঢাকা থাকবো বলে আসিনি উদ্দেশ্য অচেনা অজানা অন্য একটা দেশ অন্য একটা জীবন কীভাবে কাটবে এমনটা ভাবতেছি গাড়িতে বসে বসে, হঠাৎ আমার চোখে পড়ল বৈশাখী। আমাদের গাড়ির সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে সেই আমার প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশাখী নামের একটা বাস। আমার স্বপ্নের পরিবহণ হাত নেড়ে তাকে গুড বাই জানালাম। আজ আমার সেই প্রিয় বন্ধু আজিজকে খুব মনে পড়ছে। ভালবাসা দিবসে হৃদয় নিংড়ানো সবটুকু ভালবাসা তোর জন্য দোস্ত। খুব মিস করি তোকে আর তোর প্রিয় বন্ধু বৈশাখীকে...