ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

লাইফস্টাইল

মেঘের ভেলায়

আসিফ আজিজ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩২০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৩
মেঘের ভেলায়

কখনো কখনো মানুষের কিছু স্বপ্ন, কল্পনা সত্যিই সত্যি হয়। ছোটবেলা থেকে অসংখ্যবার শুনেছি রবীন্দ্রনাথের ‘.....নীল আকাশে সবুজ ঘাসে সাদা মেঘের ভেলা....লুকোচুরি খেলা গানটি।

আর যতবার শুনেছি ভেবেছি, মেঘের কি ভেলা হয়? সেটা আবার সবুজ ঘাসে! যদি হয়, তাহলে আমরা সেই স্বর্গীয় ভেলায় চড়তে পারি না কেন?

এই সব প্রশ্ন, কল্পনা, কৌতূহলের উত্তর আমি পেয়ে গেছি। যে কেউ পেতে পারেন আমার মতো। যদি সময়, সুযোগ আর সদিচ্ছা থাকে। ভাবছেন কীভাবে? এর জন্য পাখির মতো ডানা লাগানোর কথা ভাবার প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন নেই উড়োজাহাজে চড়বার মতো ব্যয়বহুল স্বপ্নের কথাও। প্রয়োজন শুধু হাতে তিনদিন সময়, নতুনকে দেখার, জানার, স্বপ্নের রাজ্যে ভাসার আগ্রহ আর মাসের খরচ থেকে অল্প কিছু জমিয়ে সামান্য কটা টাকা। এটা কি অসম্ভব? নিশ্চয় না। আমি বাংলাদেশের অনেকের কাছে সুন্দরতম স্থান বান্দরবানের নীলগিরির কথা বলছি।

nilgiriআমাদের পরিবারের সবাই ভ্রমণপিপাসু। তবে অধিংকাশ ক্ষেত্রে উদ্যোগটা আমাকেই নিতে হয়।

যাইহোক, বান্দরবানে প্রথমবার গিয়েছি জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে। সেবার গিয়ে মেঘলা, স্বর্ণমন্দির,  নীলাচল এবং সর্বশেষ নীলগিরি দেখে অভিভূত হয়েছিলাম। সে কারণেই দ্বিতীয় বার যাওয়া। এবার পরিবারের সবাই মিলে। আমরা রাত ১০টার গাড়িতে উঠে বান্দরবান পৌঁছি ভোর ছয়টায়। অবশ্য চট্টগ্রামের যে কোনো গাড়িতে গিয়ে সেখান থেকেও বান্দরবান যাওয়া যায়।

আমাদের উদ্দেশ্য ঘোরা। সুতরাং বান্দরবান পৌঁছে হোটেলে উঠে একটু ফ্রেস হয়ে নাস্তা সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম সুন্দরতম স্থান নীলগিরির উদ্দেশ্যে। সাড়ে চার হাজার টাকা দিয়ে ঠিক করলাম চাঁদের গাড়ি। চারদিকে খোলা জিপটি উঁচু নিচু পাহাড়ি পথ বেয়ে চলতে শুরু করলো। তখনও জানতাম না বান্দরবানের সৌন্দর্যের আসল রহস্য। শুধু শুনেছি এই সময় মেঘ দেখা যায় পাহাড় থেকে। তবে শীতে কুয়াশা পড়া শুরু হলে মেঘ যেন কোথায় পালিয়ে যায়। প্রথমবার অতি সামান্য মেঘ দেখেই আবেগায়িত হয়েছিলাম।

nilgiri2আমাদের গাড়িটি ছুটে চলেছে বেশ দ্রুত গতিতেই। আমরা বারবার নিষেধ করেছি। কিন্তু কে শোনে কার কথা! ড্রাইভারের গাড়ি চালানো দেখে মনে হলো পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ির রেস হচ্ছে। বান্দরবান শহর থেকে নীলগিরি দূরত্ব ৪৮ কিলোমিটার। যেতে সময় লাগে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা। পথে পেলাম শৈলপ্রপাত ও চিম্বুক পাহাড়। আমরা যখন শৈলপ্রপাত পার হলাম তখন সবার চোখে মুখে শুধু বিস্ময়। মুখ দিয়ে কারও কোনো কথা সরছে না। গাড়িতে বসে সবাই শুধু চিৎকার করছে। সবুজ পাহাড়ের উঁচু নিচু,  আঁকা-বাঁকা রাস্তা দিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলেছে। আর দু’পাশে যতদূর চোখ যায় শুধু সাদা মেঘ।

বয়স ভুলে সবাই গলা ছেড়ে গাইছি....নীল আকাশে সবুজ ঘাসে সাদা মেঘের ভেলা.....লুকোচুরি খেলা। তখনও লুকোচুরি খেলা শুরু হয়নি। শুধু মনে হচ্ছিলো সাদা মেঘের ওপরে আমরা ক’জন ভাসছি। আপা এবং মামী কিছুক্ষণের জন্য ছবি তোলার কথাও ভুলে গেলেন। কারণ এই অভূতপূর্ব দৃশ্য কেউ এক মুহূর্তের জন্য মিস করতে চাইবে না। মনের ভেতর ছবিটা গেঁথে রাখাই যেন মুখ্য উদ্দেশ্য সবার।

আমাদের গাড়ি এগিয়ে চললো সেই স্বর্গীয় সৌন্দর্যের মধ্য দিয়ে। কিছুক্ষণ পর আমরা নিজেরা নিজেদের কাছে হারিয়ে গেলাম। প্রথটায় কেউ বুঝে উঠতে পারিনি। তারপর দেখলাম আমাদের গাড়ি চলছে মেঘের ভেতর দিয়ে। মেঘ তার কোমল,  স্নিগ্ধ পরশে অবগাহন করালো আমাদের। মুহূর্তে সবাই যেন বাকরুদ্ধ হয়ে হারিয়ে গেলাম অন্য জগতে। কেউ চোখে দেখে এসে বলেনি যে স্বর্গ দেখে এলাম। কিন্তু পৃথিবীতে যে স্বর্গ আছে,  সেটা শতভাগ সত্যি। যাকে সহজে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না এবং সেই বস্তুকে যদি হঠাৎ চোখের সামনে দেখা যায়, দেখা যায় শরীরের সঙ্গে শরীর মিলিয়ে সঙ্গে চলছে- তখনকার সেই অনুভূতিটি নিশ্চয় বিস্ময়! এই বিস্ময়ের সঙ্গে শুরু হলো আমাদের মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি খেলা। চলতে চলতে আস্তে আস্তে আমারা রোদের দেখা পেলাম। মেঘগুলো তখন যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। চলতে চলতে হঠাৎ এক চিলতে মেঘ এসে আমাদের ঢেকে দিচ্ছিল তার কোমল পরশে। তখন আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম না এক হাত সামনে থাকা ভাই বোনদের। এই অনুভূতিগুলো ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন, এগুলো আসলে উপভোগ করার বিষয়।

আড়াই ঘণ্টা চলার পরই আমরা পৌঁছে গেলাম নীলগিরি। গাড়ি আমাদের নামিয়ে দিল মেঘ আর পাহাড়ের মাঝে এক টুকরো উঁচু সবুজ ভূখণ্ডের ওপর। নেমে দেখলাম আরেক বিস্ময়। এতোক্ষণ গাড়ির গতির সঙ্গে মেঘের গতি মিশে গিয়েছিল। এখন আমরা স্থির, কিন্তু মেঘ চলেছে ছুটে। মেঘগুলো কিন্তু একেবারেই সাদা। ঠিক কাঁশফুল কিংবা তুলার মতো। পাহাড়ের ঠিক নীচে সর্পিল সাঙ্গু নদী। সেটা দেখেছি আমরা অনেক পরে। যখন বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেঘ একটু একটু করে সরতে শুরু করলো। তারপর একসময় একেবারেই হারিয়ে গেল। তখন নীলগিরি কেবলই নীল। নীল আকাশের মাঝে এক টুকরো সবুজ গিরি। আকাশের নীল নিয়ে বোধহয় নীল গিরি। এতোক্ষণে আমরা নীলগিরি নামের সার্থকতা খুঁজে পেলাম। কিন্তু মেঘ সরে যাওয়ার পরও যে এক বিন্দু সৌন্দর্যের ঘাটতি নীলগিরিতে হয় না,  তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ আমি নিজে। কারণ প্রথমবার এসে মেঘের দেখা পাইনি। তারপরও দ্বিতীয়বার এখানে এসেছি সৌন্দর্যের টানে। আর যা দেখলাম সেতো অতুলনীয়।

আমাদের দেশটা যে কত বেশি সুন্দর তার একটা ছোট্ট উদাহরণ দেই। আমরা যখন নীলগিরিতে ঘুরছি,  তখন পরিচয় হলো ঢাকা থেকে আসা বিভিন্ন অফিস ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্রমণপিপাসুদের সঙ্গে। তাদের অনেকেই ঘুরে এসেছেন হিমালয় কন্যা নেপাল কিংবা ভারতের মানস কন্যা দার্জিলিং থেকে। এর মধ্যে আমার পরিবারের কেউ কেউও আছেন। কিন্তু আজ যে দৃশ্য তারা সবাই দেখেছেন, তাদের প্রত্যেকের ভাষ্য- নেপাল কিংবা দার্জিংয়ে অনেক উঁচু পাহাড় থাকতে পারে কিন্তু এই সৌন্দর্যের সঙ্গে তার তুলনা নেই। বাড়ির কাছে  প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্য রেখে আমরা টাকা খরচ করে বিদেশে গিয়েছি!

যারা ভোরে না বেরিয়ে দেরিতে এসেছেন নীলগিরিতে তারা কিন্তু মেঘ দেখতে পাননি। কিন্তু তাদের চোখে মুখেও বিস্ময়ের কমতি নেই। এতে বোঝা যায় নীলগিরি তার যৌবনের সৌন্দর্য ধরে রাখে সবসময়। সকাল হোক বা সন্ধ্যা কোনো বিষয় না। এখানে কিন্তু প্রচুর পাহাড়ি ফল পাবেন। যেমন,  কমলা, বাতাবি লেবু, শশা, বরই, তেতুল,  কলা- এগুলো। খেতে ভুলবেন না যেন!

nilgiri3দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলে দেখলাম অন্য এক রূপ। প্রথমে দেখলাম পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে সবুজ গাছগুলোর মধ্য দিয়ে ধোঁয়া উড়ছে। আমরা ধোঁয়ার কারণ অনুসন্ধান করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুক্ষণ পর যা দেখলাম তা আমাদের বিস্ময় আরো বাড়িয়ে দিল। ধোঁয়ার কুণ্ডলীগুলো আসলে ধোঁয়া নয়- মেঘ। সবুজ গাছের মধ্য থেকে হালকা হালকা ধোঁয়াগুলো যখন একটু দূরে গিয়ে জড়ো হলো তখন সেগুলো খণ্ড খণ্ড মেঘের রূপ পেল। সত্যিই এ দৃশ্য অভূতপূর্ব।

তাই মেঘের ভেলায় যদি ভাসতে চান,  প্রকৃতির স্নিগ্ধতায় যদি অবগাহন করতে চান, সাদা-সবুজ-নীলের সঙ্গে যদি লুকোচুরি খেলতে চান ঘুরে আসুন বান্দরবানের নীলগিরি। আপনার চোখ আজীবন বাঁচবে বিস্ময় নিয়ে!

থাকা-খাওয়া ও খরচ

নীলগিরি আর্মিদের অধীনে গড়ে তোলা একটি পর্যটন কেন্দ্র। এখানে রয়েছে বেশ কয়েকটি কটেজ। ভাড়া প্রতি রাতে ৩ থেকে ৬ হাজার টাকা। গাড়ি রাখার জন্য দিতে হয় ২০০ টাকা এবং জনপ্রতি ঢুকতে ৫০ টাকা। তবে আগে থেকে যোগাযোগ করতে হবে কটেজ বুকিংয়ের জন্য। বান্দরবান শহরে যেখানে গাড়ি আপনাকে নামিয়ে দেবে,  সেখানেই আপনি বেশ কিছু হোটেল পাবেন। খরচ সিঙ্গেল রুম ২০০-৮০০ টাকা, ডাবল রুম ৪০০-১২০০ টাকা। প্রতিবেলা আপনি খেতে পারবেন ৫০-২০০ টাকার মধ্যে।

আপনার দলে যদি লোক বেশি হয়,  তাহলে আপনি সব মিলিয়ে ২ দিন দুই রাত বান্দরবান থেকে ঘুরে আসতে পারবেন জনপ্রতি ২৫০০-৩০০০ টাকার মধ্যে।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।