ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

বসুন্ধরা গ্রুপের সহায়তায় শুভসংঘের কম্বল বিতরণ

উষ্ণতার পরশে প্রাণ জুড়ানো আনন্দ

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০১২ ঘণ্টা, মার্চ ৪, ২০২৩
উষ্ণতার পরশে প্রাণ জুড়ানো আনন্দ

১৬ জানুয়ারি সকাল ১০টা। ঢাকা থেকে দিনাজপুরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে কালের কণ্ঠ শুভসংঘ কেন্দ্রীয় কমিটির একটি দল।

দলের নেতৃত্বে ছিলেন শুভসংঘের পরিচালক জাকারিয়া জামান। বসুন্ধরা গ্রুপের সহায়তায় দেশের বিভিন্ন স্থানে অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মাঝে কম্বল বিতরণ করার জন্য তাঁদের এই যাত্রা। রাত প্রায় ৮টায় দিনাজপুর পৌঁছেন তাঁরা। দিনাজপুরের শুভসংঘ সদস্যরা ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়ে তাঁদের বরণ করে নেন। শুভেচ্ছা বিনিময় শেষে শুরু হয় পরবর্তী দিনের কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা। কখন, কোথায়, কিভাবে কম্বল বিতরণ হবে সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে করতেই রাত ১০টা বেজে যায়। আলোচনা পর্ব শেষ করে হোটেলে পৌঁছে ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়েন সবাই।

১৭ জানুয়ারি কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে দিনাজপুর শহরের সারদেশ্বরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে কম্বল বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর বিরল, কাহারোল, বীরগঞ্জ ও খানসামা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে কম্বল বিতরণ করা হয়। পরদিন চিরিরবন্দর, পার্বতীপুর, নবাবগঞ্জ, বোচাগঞ্জ ও হাকিমপুর উপজেলায় কম্বল বিতরণ করা হয়। দুই দিনে দিনাজপুরে বসুন্ধরা গ্রুপের সহায়তায় তিন হাজার কম্বল বিতরণ করে শুভসংঘ। দিনাজপুর জেলার হাকিমপুরে সর্বশেষ কম্বল বিতরণ কার্যক্রম সম্পন্ন করে পরবর্তী গন্তব্য জয়পুরহাট।

জয়পুরহাটে পৌঁছে স্থানীয় শুভসংঘের সদস্যদের সঙ্গে সাংগঠনিক আলোচনা শেষে সেদিনের মতো কার্যক্রম সমাপ্ত করা হয়। ১৯ জানুয়ারি সকালে জয়পুরহাট শহরের সার্কিট হাউস মাঠে কম্বল বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক সালেহীন তানভীর গাজী। এ সময় কম্বল হাতে পেয়ে বৃদ্ধা আমেনা খাতুন বলেন, ‘কয়েক দিনের শীতে মোটা একটা কাপড়ের জন্য একটু ভালো করে ঘুমও পাড়বের পারতেছিলাম না। শীতে খুব কষ্ট করে রাত পার করতিছিলেম। কত জনেক বলেছি একটা কম্বল দেওয়ার জন্য, কেউ দেয় না। আজ ওনারা (বসুন্ধরা গ্রুপ) একটা কম্বল দিল। বাপু রে, অনেক দরকার ছিল কম্বলটা। ’ ওই দিন জেলা শহর ছাড়াও পাঁচবিবি, কালাই, ক্ষেতলাল ও আক্কেলপুর উপজেলায় এক হাজার কম্বল বিতরণ সম্পন্ন করে নওগাঁর উদ্দেশে জয়পুরহাট ত্যাগ করে শুভসংঘ দল।

নওগাঁ জেলা ভৌগোলিকভাবে বৃহত্তর বরেন্দ্র ভূমির অংশ। ২০ জানুয়ারি নওগাঁর পিটিআই মাঠে কম্বল বিতরণ কার্যক্রম শুরু করে বদলগাছী, পত্নীতলা, সাপাহার ও মান্দা উপজেলায় মোট দুই হাজার কম্বল বিতরণ সম্পন্ন করা হয়। পত্নীতলায় কম্বল বিতরণকালে নানা প্রতিকূলতার মাঝেও জিপিএ ৫ পেয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ মাছুমা আক্তারের খোঁজ পায় শুভসংঘ। মাছুমার বাবা পেশায় একজন পান বিক্রেতা। পুরনো বই সংগ্রহ করে পড়ত মাছুমা। মাধ্যমিকে ভালো ফল করেও অর্থের অভাবে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। এমন অবস্থা দেখে ভর্তি ও বই কেনার জন্য ১১ হাজার টাকা মেধাবী ছাত্রী মাছুমা আক্তারের হাতে তুলে দেন কালের কণ্ঠ শুভসংঘের পরিচালক জাকারিয়া জামান। এ সময় তিনি বলেন, ‘মাছুমা এবার নিশ্চিন্তে পড়াশোনা করবে। শুভসংঘ সব সময় তার পাশে আছে। ’

নওগাঁ থেকে এবারের গন্তব্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জেলা হিসেবে দেশব্যাপী খ্যাত রাজশাহী। ২১ জানুয়ারি পদ্মা নদীর একেবারে পার ঘেঁষে গড়ে ওঠা গোদাগাড়ীর পিরিজপুর গ্রামের একটি আমবাগানে পাঁচ শতাধিক সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মাঝে কম্বল বিতরণ করা হয়। পদ্মার হু হু বাতাস আর তীব্র ঠাণ্ডায় কাবু হওয়া বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা কম্বল হাতে পেয়েই জড়িয়ে নিলেন নিজের শরীরে। তাঁদেরই একজন হলেন আছিয়া বেওয়া। তিনি কম্বল পেয়ে অনেকটা আবেগাপ্লুত হয়ে বলতে থাকেন, ‘এমন জাড় (শীত) ল্যাগছে, পাওগুলানো ঠিকমুতন মাটিতে র‌্যাখতে প্যারছি না। এই জাড়ে কম্বলডা এখুন খুব আরাম দিবে। রাতেও আরামে ঘুমাতে পারবো। আল্লাহ বসুন্ধরার ভালো করুক। আমার মুতন অসহায় মানুষকে মুনে করিছে, আল্লাহ তিনাদের ভালো করুক। ’

রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ীসহ বিভিন্ন উপজেলায় মোট এক হাজার কম্বল বিতরণ সম্পন্ন করে ‘আমের রাজ্য’ হিসেবে খ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জে পৌঁছে শুভসংঘ দল। প্রথমেই চাঁপাইনবাবগঞ্জ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ২৫০ অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মাঝে কম্বল বিতরণ করে দৈনিক কার্যক্রমের সমাপ্তি হয়। পরে সোনামসজিদ পর্যটন মোটেলে রাত যাপন করে তারা। মোটেলের আশপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও আমবাগানের গহিন অন্ধকার থেকে ভেসে আসা শিয়ালের ডাক শুভসংঘ সদস্যদের মাঝে রোমাঞ্চকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। ২১ জানুয়ারি খুব ভোরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলায় কম্বল বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্যাতিত চাঁপাইনবাবগঞ্জের ১৫ নারী বীরাঙ্গনা স্বীকৃতি পান। এর পরও সমাজে তাঁরা উপেক্ষিত ছিলেন। শীতে তাঁরা কষ্ট পাচ্ছিলেন। তাঁদেরসহ ৫০০ জন অসহায়ের মাঝে কম্বল বিতরণ করা হয়। এ ছাড়া ভোলাহাট ও নাচোল উপজেলার ২৫০ জনের মাঝে কম্বল বিতরণ করে জেলায় মোট এক হাজার কম্বল বিতরণ সম্পন্ন করে শুভসংঘ।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে পরবর্তী গন্তব্য প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরের পথ দেশের সর্ব-উত্তরের জেলা পঞ্চগড়। বিকেল ৪টায় যাত্রা শুরু করে পঞ্চগড়ে পৌঁছতে রাত ১টা বেজে যায়। পরদিন ভোরে জেলা শহরের বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম স্টেডিয়ামে কম্বল বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়। কম্বল পেয়ে জেলা শহরের পুরনো ক্যাম্প এলাকার ষাটোর্ধ্ব তহিমা বেওয়া বলেন, ‘এরং ঠাণ্ডা পৈছে বাপু আতিত ঘুমাবা পারু না। পাতলা এগনা কম্বল দিয়া শীত মানে না বাপু। বহু মানুষেরঠে ঘুরিছু এগনা কম্বলের তানে। কাহো মোরতি দেখেনি। বসুন্ধরার নোগলা খুঁজে কম্বল দিছে। এলা কনেক শান্তিত নিন্দাবা পামিরো বা। ’ দুপুরে তেঁতুলিয়া উপজেলার ডিমাগজ গ্রাম ও খয়খাট পাড়া নুরানিয়া হাফিজিয়া মাদরাসা মাঠে এবং বিকেলে আটোয়ারী ও বোদা উপজেলায় সর্বমোট এক হাজার কম্বল বিতরণ সম্পন্ন করে পরবর্তী গন্তব্য নীলফামারী জেলায় পৌঁছে শুভসংঘ দল।

২৪ জানুয়ারি জেলার সদর, জলঢাকা, ডিমলা ও সৈয়দপুর উপজেলায় এক হাজার কম্বল বিতরণ করা হয়। জলঢাকায় কম্বল বিতরণ শেষে চারআনি গ্রামে প্রতিষ্ঠিত শুভসংঘ স্কুল পরিদর্শনে গিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে বই বিতরণ করেন শুভসংঘের পরিচালক জাকারিয়া জামান। এ সময় শুভসংঘ স্কুলের শিক্ষিকা আয়শা সিদ্দিকা বলেন, ‘শুভসংঘ জলঢাকা শাখার সহযোগিতায় ২০২১ সালের ডিসেম্বরে আমাদের স্কুলটির পাঠদান কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে স্কুলটিতে প্রথম শ্রেণিতে ৩০ জন এবং দ্বিতীয় শ্রেণিতে ৩০ জন শিক্ষার্থী আছে। ’

নীলফামারীর কার্যক্রম শেষ করে শুভসংঘ দলের গন্তব্য ঠাকুরগাঁও। জেলার পাঁচটি উপজেলায় এক হাজার কম্বল বিতরণ করবে শুভসংঘ। ২৫ জানুয়ারি সকালে স্থানীয় বিডি হল মাঠে কম্বল বিতরণ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মামুন ভুঁইয়া। এ সময় তিনি বলেন, ‘আমি বসুন্ধরা গ্রুপের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই এই শীতে সমাজের দুস্থ জনগণের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। এই শীতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কষ্টে থাকে ছিন্নমূল দরিদ্র মানুষগুলো। বসুন্ধরা গ্রুপের এই উপহার শীতার্তদের উপকারে আসবে। ’

জেলার সদর উপজেলার জগন্নাথপুর এলাকায় শহীদ পরিবার ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে কম্বল বিতরণ করা হয়। কম্বল নিতে আসা শহীদ পরিবারের ভুক্তভোগী রসমুনি বেওয়া বলেন, ‘মাঘের শীতত বাঘে পালায়, খুবে কষ্টত ছু বাঁগে। এই জাড়ে (ঠাণ্ডাতে) দেহাডা কোঁকড়া হয়ে যাছে। তোমহার বসুন্ধারার মালিক যে কম্বলডা মোক দিলে, সেইডা দিয়া মনডাত শান্তি পাইল! এই কম্বল দিয়া এইবারের শীতখান মোর কাটি যাবে। ’

এ ছাড়া এর মাঝে পাবনা ও নারায়ণগঞ্জে দুই হাজার অসহায় ও শীতার্ত মানুষের মাঝে কম্বল বিতরণ করা হয়। ঠাকুরগাঁও থেকে শুভসংঘ কেন্দ্রীয় কমিটির দল প্রথম ধাপের কম্বল বিতরণ শেষে ঢাকায় ফিরে আসে। এর মাধ্যমে দেশের ১০টি জেলার ১৩ হাজার মানুষের কাছে পৌঁছায় বসুন্ধরা গ্রুপের উপহার। ঢাকায় ফিরে বসুন্ধরা গ্রুপের সহযোগিতায় মাধ্যমিক পরীক্ষায় ভালো ফল করা দরিদ্রজয়ী ১০৪ জন অসহায় মেধাবীকে শিক্ষা সহায়তা প্রদান অনুষ্ঠান আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে শুভসংঘ কেন্দ্রীয় টিম। ৩১ জানুয়ারি বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীর এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে এককালীন ২৫ হাজার টাকা অর্থ সহায়তা হাতে তুলে দেন। প্রতি মাসে এই শিক্ষার্থীদের দুই হাজার টাকা শিক্ষাবৃত্তি প্রদান করা হবে।

২ ফেব্রুয়ারি পুনরায় যাত্রা শুরু করে শুভসংঘ দল। গাজীপুরের বিভিন্ন স্থানে কম্বল বিতরণ করা হবে। সকাল ১০টায় গাজীপুর মহানগরের পুবাইল বালুর মাঠে, দুপুর দেড়টায় কাপাসিয়ার উত্তর খামের ঈদগাহ মাঠে, বিকেল সাড়ে ৩টায় কাপাসিয়ার পাবুর ঈদগাহ মাঠে এবং সন্ধ্যা ৬টায় শ্রীপুরের সাতখামাইর দারুল উলুম মাদরাসা মাঠে সর্বমোট এক হাজার কম্বল বিতরণ সম্পন্ন করা হয়। শ্রীপুর থেকে পরবর্তী যাত্রা ময়মনসিংহের ত্রিশালে অবস্থিত নজরুল একাডেমি ডাকবাংলোতে। দুই দিন সেখানে অবস্থান করে জেলার ত্রিশাল, নান্দাইল, গফরগাঁও, ফুলবাড়িয়া ও ভালুকা উপজেলার মাদরাসা শিক্ষার্থী, বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দাসহ অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিত এক হাজার  মানুষের মাঝে কম্বল বিতরণ সম্পন্ন করে তারা।

এ ছাড়া ঢাকার আশপাশের এলাকাসহ নরসিংদী ও সিলেটে আরো তিন হাজার কম্বল বিতরণ করা হয়। এ নিয়ে দ্বিতীয় ধাপে পাঁচ হাজার কম্বল বিতরণ সম্পন্ন করল শুভসংঘ। এ বিষয়ে কালের কণ্ঠ শুভসংঘের পরিচালক জাকারিয়া জামান জানান, এ বছর সারা দেশের ১৫ জেলায় বসুন্ধরা গ্রুপের মোট ১৮ হাজার কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। দেশের শীতপ্রধান উত্তরাঞ্চলে এই কম্বল বিতরণ শুরু হয়। বসুন্ধরার কম্বল পেয়ে উপকারভোগী অনেকেই আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেছেন। বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান স্যারের জন্য দুই হাত তুলে প্রাণভরে দোয়া করেছেন। আমাদের এই শুভ কাজ আগামী দিনেও অব্যাহত থাকবে, ইনশাআল্লাহ।

বাংলাদেশ সময়: ১০১২ ঘণ্টা, মার্চ ০৪, ২০২৩
জেডএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।