ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

ইউনিসেফের প্রতিবেদন

করোনায় শৈশবকালীন টিকাদানে ৪৪ শতাংশ আস্থা কমেছে

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫২ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০২৩
করোনায় শৈশবকালীন টিকাদানে ৪৪ শতাংশ আস্থা কমেছে

ঢাকা: কোভিড-১৯ মহামারির সময় দেশে শৈশবকালীন টিকাদানে আস্থা ৪৪ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে বলে জানিয়েছে ইউনিসেফ। সংস্থাটির নতুন প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চাপে থাকা, স্বাস্থ্যসেবা ব্যহত হওয়া ও দুষ্প্রাপ্য সম্পদের বিচ্যুতি-আত্মবিশ্বাস হ্রাসের কারণে তিন বছরে ৬ কোটি ৭০ লাখ শিশু টিকার এক বা একাধিক ডোজ পায়নি।

বৃহস্পতিবার (২০ এপ্রিল) টিকাদান বিষয়ে ‘দি স্টেট অব দি ওয়ার্ল্ডস চিলড্রেন ২০২৩: ফর এভরি চাইল্ড, ভ্যাক্সিনেশন’ শীর্ষক এক সমীক্ষা প্রতিবেদনের ফলাফলে এসব তথ্য জানায় ইউনিসেফ।

প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, মহামারি শুরু হওয়ার পর কোরিয়া প্রজাতন্ত্র, পাপুয়া নিউ গিনি, ঘানা, সেনেগাল ও জাপানে শিশুদের জন্য টিকার গুরুত্ব সম্পর্কে মানুষের ধারণা এক তৃতীয়াংশেরও বেশি কমেছে। সমীক্ষা চালানো দেশগুলোর মধ্যে শুধু চীন, ভারত ও মেক্সিকোতেই টিকার গুরুত্ব সম্পর্কিত ধারণা আগের মতোই অটল আছে বা ক্ষেত্রবিশেষে বেড়েছে। মহামারি শুরু হওয়ার পর বেশিরভাগ দেশে ৩৫ বছরের কম বয়সী মানুষ ও নারীরা শিশুদের জন্য টিকা সম্পর্কে তাদের আস্থা কমার কথা বেশি জানিয়েছে।

টিকার ওপর আস্থা সাধারণত ক্ষণস্থায়ী ও সময় নির্দিষ্ট। সমীক্ষার ফল দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতার ইঙ্গিত দেয় কিনা তা নির্ধারণ করতে আরও উপাত্ত সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণের প্রয়োজন হবে। আস্থা কমা সত্ত্বেও টিকার জন্য সামগ্রিক সমর্থন তুলনামূলকভাবে বেশ জোরালোই রয়েছে। সমীক্ষা চালানো ৫৫টি দেশের প্রায় অর্ধেকে ৮০ শতাংশেরও বেশি উত্তরদাতা টিকাকে শিশুদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছেন।

তবে প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে যে বিভিন্ন কারণ একত্রে টিকা নিয়ে দ্বিধা বাড়ার সংকেত দেয়। এই কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে মহামারিতে সাড়া দেওয়ার বিষয়ে অনিশ্চয়তা, ক্রমবর্ধমান বিভ্রান্তিকর তথ্য, বিশেষজ্ঞদের প্রতি আস্থা হ্রাস ও রাজনৈতিক মেরুকরণ।

ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ক্যাথরিন রাসেল বলেন, মহামারির চূড়ান্ত অবস্থায় বিজ্ঞানীরা দ্রুত টিকা তৈরি করেছিলেন যা অগণিত জীবন বাঁচায়। কিন্তু এই ঐতিহাসিক অর্জন সত্ত্বেও, সব ধরনের টিকা নিয়ে ভয় ও বিভ্রান্তি ভাইরাসের মতোই ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে। এই উপাত্ত একটি উদ্বেগজনক সতর্কতা সংকেত। আমরা নিয়মিত টিকাদানের প্রতি মানুষের অনাস্থাকে মহামারির মারাত্মক পরিণতির অংশ হতে দিতে পারি না। অন্যথায়, মৃত্যুর পরবর্তী ঢেউয়ে যুক্ত হতে পারে হাম, ডিপথেরিয়া বা অন্যান্য প্রতিরোধযোগ্য রোগে আক্রান্ত শিশুরা।

উদ্বেগজনকভাবে, কোভিড-১৯ মহামারি কারণে ৩০ বছরের মধ্যে শৈশবকালীন টিকাদান সবচেয়ে ব্যাপক আকারে পিছিয়ে পড়ার মধ্যেই আস্থা কমার বিষয়টি এলো। বিশেষ করে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর তীব্র চাপ, টিকাদানের সুযোগ-সুবিধাগুলো কোভিড-১৯ টিকাদানে ব্যবহার করা, স্বাস্থ্যকর্মীদের স্বল্পতা ও করোনাভাইরাসের ঝুঁকি কমাতে বাড়িতে থাকার প্রয়োজনীয়তা- এ সব কারণে মহামারিটি প্রায় সর্বত্র শৈশবকালীন টিকাদানে ব্যাঘাত ঘটায়।

প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়, ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে মোট ৬ কোটি ৭০ লাখ শিশু টিকাদান কার্যক্রম থেকে বাদ পড়েছে, এবং ১১২টি দেশে টিকাদানের আওতার মাত্রা কমেছে। মহামারির মধ্যে বা ঠিক আগে জন্মগ্রহণ করা শিশুরা এখন সেই বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে যে বয়সে তাদের সাধারণত টিকা দেওয়া সম্পন্ন হয়। এটি টিকা থেকে বাদ পড়া শিশুদের টিকা দেওয়া এবং মারাত্মক রোগের প্রাদুর্ভাব ঠেকানোর জন্য জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে উদাহরণস্বরূপ ২০২২ সালে হামে আক্রান্তের সংখ্যা আগের বছরের মোট সংখ্যার দ্বিগুণেরও বেশি ছিল। বছরওয়ারি হিসেবে ২০২২ সালে পোলিওয় পঙ্গু হওয়া শিশুদের সংখ্যা ১৬ শতাংশ বাড়ে। ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সময়কে পূর্ববর্তী তিন বছরের সঙ্গে তুলনা করা হলে দেখা যায়, পোলিওতে পঙ্গু হয়ে যাওয়া শিশুর সংখ্যা আটগুণ বেড়েছে, যা টিকাদানের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।

২০২০ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশ মহামারির কারণে লকডাউনে শুরু হলে প্রাথমিক অবস্থায় স্বাস্থ্য পরিষেবাগুলোর ওপর প্রভাব পড়েছিল, যার ফলে পরবর্তী মাসগুলোয় টিকার আওতা ৫০ শতাংশের নিচে নেমে আসে। তবে ইউনিসেফের সহায়তায় বাংলাদেশ সরকার টিকাদান কমার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং ২০২০ সালের অক্টোবর নাগাদ মাসিক টিকাদানের হার কোভিড-১৯ পূর্ববর্তী সময়ের মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। দেশে কার্যকরী কভারেজ বেশ ভালো অবস্থায় রয়েছে, যেখানে প্রায় ৮৪ শতাংশ শিশু তাদের ১২ মাস বয়সের মধ্যেই টিকা গ্রহণ করছে। কার্যকরী কভারেজ বলতে জাতীয় টিকাদান সূচি অনুসারে একটি শিশুর ১২ মাস বয়স পর্যন্ত যেসব টিকা পাওয়ার কথা সেগুলো পাওয়া বোঝায়।

মহামারি বিদ্যমান বৈষম্যকেও আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। অনেক শিশুর জন্য, বিশেষ করে সবচেয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে, টিকাদান এখনও সহজপ্রাপ্য, গ্রহণযোগ্য বা সাশ্রয়ী নয়। মহামারির আগেও টিকাদানে অগ্রগতি প্রায় এক দশক ধরে থমকে গিয়েছিল; কেননা সবচেয়ে প্রান্তিক শিশুদের কাছে পৌঁছাতে বিশ্বকে সংগ্রাম করতে হচ্ছিল।

২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে যে ৬ কোটি ৭০ লাখ শিশু নিয়মিত টিকাদান থেকে বাদ পড়েছিল, তাদের মধ্যে ৪ কোটি ৮০ লাখ শিশুটি নিয়মিত টিকার একটি ডোজও পায়নি, যা ‘জিরো-ডোজ’ নামে পরিচিত। ২০২১ সালের শেষ নাগাদ ভারত ও নাইজেরিয়ায় (দুটি দেশেই এ সময়ে জন্মগ্রহণ করা শিশুর সংখ্যা অনেক বেশি) জিরো-ডোজ শিশুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল। এসব শিশুর সংখ্যা বৃদ্ধির দিক থেকে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল মায়ানমার ও ফিলিপাইন।

বাংলাদেশেও কিছু ভৌগোলিক ও আর্থ-সামাজিক বৈষম্য রয়ে গেছে। অনেক শিশু টিকার নির্ধারিত সকল ডোজ পায় না বা সঠিক সময়ে সঠিক ডোজ পায় না। জাতীয় পর্যায়ে টিকার কভারেজের তুলনায় দুর্গম এলাকা ও শহরের বস্তিগুলোয় কভারেজ কম রয়ে গেছে। বাংলাদেশে জিরো-ডোজ শিশুর সংখ্যা ৩০ হাজার বা ১ বছরের কম বয়সী শিশুদের এক শতাংশেরও কম। যদিও এটি দেশের টিকাদান কর্মসূচির একটি উল্লেখযোগ্য অর্জনকে তুলে ধরে, তবে বিচ্ছিন্নভাবে টিকা না পাওয়া শিশুদের বিষয়টিও এতে উঠে আসে।

বাংলাদেশের টিকাদান কর্মসূচির জন্য শৈশবকালীন সব টিকা সংগ্রহ ও সরবরাহ করে ইউনিসেফ। ২০২২ সালে ইউনিসেফ ৮ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের ১৭ কোটি ৩০ লাখ শৈশবকালীন টিকার ডোজ সরবরাহ করেছে বাংলাদেশে। এই টিকাগুলো কিনতে অর্থের যোগান দিয়েছে ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স, গ্যাভি ও বাংলাদেশ সরকার।

বাংলাদেশে ইউনিসেফ প্রতিনিধি মি. শেলডন ইয়েট বলেন, টেকসই রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি এবং একটি সুপ্রশিক্ষিত ও অনুপ্রাণিত স্বাস্থ্য কর্মীবাহিনী থাকলে কী করা সম্ভব, বাংলাদেশে শিশু টিকাদান কর্মসূচির সাফল্য তারই প্রমাণ। শৈশবকালীন টিকাদানের ক্ষেত্রে নিজস্ব অর্থায়নের দিকে এগোতে থাকা দেশটিকে ইউনিসেফের দেওয়া সহায়তা আগামী বছরগুলোয় অব্যাহত থাকবে।

বিশ্বে টিকা থেকে বাদ পড়া শিশুরা সবচেয়ে দরিদ্র, সবচেয়ে প্রত্যন্ত ও প্রান্তিক কমিউনিটিতে বাস করে, যারা অনেক সময় সংঘাতের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রতিবেদনটির জন্য ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইক্যুইটি ইন হেলথ’র সংগ্রহ করা নতুন উপাত্তে দেখা গেছে, সবচেয়ে দরিদ্র পরিবারগুলোতে প্রতি ৫ শিশুর মধ্যে ১ জন ‘জিরো-ডোজ’ শিশু, যেখানে ধনী পরিবারগুলোয় এই সংখ্যা প্রতি ২০ জনে একজন। এতে উঠে এসেছে, টিকা না পাওয়া শিশুরা প্রায়শই গ্রামীণ এলাকা বা শহুরে বস্তির মতো দুর্গম কমিউনিটিতে বসবাস করে। প্রায় ক্ষেত্রেই তাদের মায়েরা স্কুল শিক্ষা থেকে বঞ্চিত এবং পারিবারিক সিদ্ধান্তে তাদের অংশগ্রহণ খুব কমই দেখা যায়। এই চ্যালেঞ্জগুলো সবচেয়ে বেশি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে, যেখানে শহরাঞ্চলে প্রতি ১০ শিশুর মধ্যে ১ জন শিশু ‘জিরো-ডোজ’ এবং গ্রামীণ অঞ্চলে প্রতি ৬ জনের মধ্যে একজন। উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশগুলোয় শহুরে ও গ্রামীণ শিশুদের মধ্যে প্রায় কোনো ব্যবধান নেই।

প্রতিটি শিশুকে টিকা দেওয়ার জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে শক্তিশালী করা এবং এর ফ্রন্টলাইনে থাকা বেশিরভাগ নারী কর্মীকে তাদের প্রয়োজনীয় উপকরণ এবং সহায়তা দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, নারীরা টিকাদানের ফ্রন্টলাইনে রয়েছে, কিন্তু তারা কম বেতন, অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান, আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ও ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগের অভাব এবং তাদের নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন।

শিশুর বেঁচে থাকার এ সংকট মোকাবিলায় ইউনিসেফ সরকারগুলোকে টিকাদানের জন্য অর্থায়ন বাড়ানোর বিষয়ে তাদের প্রতিশ্রুতি দ্বিগুণ করার এবং শিশুদের সুরক্ষিত রাখতে ও রোগের বিস্তার ঠেকাতে টিকা থেকে বাদ পড়া শিশুদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে টিকাদান কার্যক্রম বাস্তবায়ন ও জোরদার করার জন্য কোভিড-১৯ এর বেচে যাওয়া তহবিলসহ ব্যবহারযোগ্য সম্পদ ব্যবহার করতে অংশীজনদের সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানায়।

প্রতিবেদনটি সরকারগুলোর প্রতি আহ্বান জানায়: জরুরি ভিত্তিতে সকল শিশুকে, বিশেষ করে যারা কোভিড-১৯ মহামারি চলাকালে টিকা পায়নি, তাদের শনাক্ত করতে এবং তাদের কাছে টিকা পৌঁছে দিতে, টিকার প্রতি আস্থা তৈরি করাসহ টিকার চাহিদা বাড়াতে, টিকাদান কার্যক্রম ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য তহবিল গঠনে অগ্রাধিকার দিতে, নারী স্বাস্থ্যকর্মী, উদ্ভাবন এবং স্থানীয় উৎপাদনের পেছনে বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে।

ক্যাথরিন রাসেল আরও বলেন, টিকা লাখ লাখ জীবন বাঁচিয়েছে এবং কমিউনিটিগুলোকে প্রাণঘাতী রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষা করেছে। আমরা সবাই জানি, রোগ সীমান্ত চেনে না। ভবিষ্যতের মহামারি, অপ্রয়োজনীয় মৃত্যু ও দুর্ভোগ প্রতিরোধে নিয়মিত টিকাদান ও শক্তিশালী স্বাস্থ্য ব্যবস্থাই আমাদের সেরা অস্ত্র। কোভিড-১৯ টিকাদান কার্যক্রমের তহবিল ও উপকরণ এখনও অবশিষ্ট থাকায়, টিকাদান পরিষেবাগুলোকে শক্তিশালী করতে এবং প্রতিটি শিশুর জন্য টেকসই ব্যবস্থার পেছনে বিনিয়োগ করতে সেই তহবিলগুলো কাজে লাগানোর এখনই সময়।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৫২ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০২৩
আরকেআর/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।