ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

উচ্চশিক্ষিত, ইউরোপে স্থায়ী আবাস, তারপরও জঙ্গিবাদে

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২৩
উচ্চশিক্ষিত, ইউরোপে স্থায়ী আবাস, তারপরও জঙ্গিবাদে

ঢাকা: উচ্চশিক্ষার জন্য ইউরোপে গিয়ে গ্রিনকার্ডে পরিবারসহ স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন মেজবাহ ওরফে আবু মাসরুর। একপর্যায়ে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে জড়িয়ে পড়েন নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামে।

বিদেশে অবস্থানকালে অনেককেই উদ্বুদ্ধ করে সংগঠনের সদস্য সংগ্রহ অব্যাহত রাখেন। ২০২২ সালের অক্টোবরে সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের নির্দেশে বাংলাদেশে এসে সংগঠনের দাওয়াতি কার্যক্রম অব্যাহত রাখেন। একপর্যায়ে সংগঠনের ঢাকা অঞ্চলের দাওয়াতি শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত হন।

সোমবার (২৫ সেপ্টেম্বর) রাতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে মেজবাহসহ আনসার আল ইসলামের ৬ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যারা প্রত্যেকেই উচ্চশিক্ষিত, ইউরোপে উচ্চশিক্ষা নেওয়া ২ জনসহ রয়েছেন চিকিৎসকও।

গ্রেপ্তাররা হলেন- মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী ওরফে আবু মাসরুর (৫০), শেখ আশিকুর রহমান ওরফে আবু আফিফা (৪৯), সাদী মো. জূলকার নাইন (৩৫), মো. কামরুল  হাসান সাব্বির (৪০), মো. মাসুম রানা ওরফে মাসুম বিল্লাহ (২৬) ও সাঈদ মো. রিজভী (৩৫)।

প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই) ও র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) যৌথ অভিযানে রাজধানীর উত্তরা, বনানী, বনশ্রী ও যাত্রাবাড়ি এলাকা থেকে তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এ সময় তাদের কাছ থেকে ২টি ল্যাপটপ, ৬টি মোবাইল ফোন, উগ্রবাদে সহায়ক পুস্তিকা ও সাংগঠনিক কার্যক্রম সংক্রান্ত ডায়রি ও নোট বই উদ্ধার করা হয়েছে।

র‍্যাবের লিগ্যাল এন্ড মিডিয়া উইংয়ের সহকারী পরিচালক আ ন ম ইমরান খান জানান, গ্রেপ্তাররা আফগানিস্তানে তালেবানের উত্থানে উদ্বুদ্ধ হয়ে আল কায়েদা মতাদর্শের জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছিল। তারা বিভিন্ন সময় অনলাইনে বিভিন্ন উগ্রবাদী নেতাদের বক্তব্য দেখে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে সংগঠনের সদস্যদের মাধ্যমে সংগঠনে যোগদান করে।

পরবর্তীতে তারা সংগঠনের সদস্য সংগ্রহে দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করছিল। পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশে মুসলমানদের উপর নির্যাতনসহ বিভিন্ন ধর্মীয় অপব্যাখ্যার মাধ্যমে ভুল বুঝিয়ে সংগঠনের সদস্যদের তথাকথিত জিহাদের মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী করে তোলে।

এ উদ্দেশ্যে সংগঠনের সদস্যদেরকে তারা বিভিন্ন উগ্রবাদি বই, মুসলমানদের ওপর নির্যাতন ও উগ্রবাদী নেতাদের বক্তব্যের ভিডিও সরবরাহ করতো। এছাড়াও তারা সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ভুল তথ্য প্রদান করে তাদের আত্মীয়-স্বজন, বিভিন্ন মাদ্রাসা ও সদস্যদের নিকট থেকে নিয়মিত অর্থ সংগ্রহ করতো।

র‍্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, তারা বিভিন্ন সময়ে মসজিদ, বাসা বা বিভিন্ন স্থানে সদস্যদের নিয়ে গোপন সভা পরিচালনা করতো। বিভিন্ন অপব্যাখ্যা ও মিথ্যা তথ্যের মাধ্যমে দেশের বিচার ও শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে বিতৃষ্ণা তৈরি করে ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম করার জন্য সদস্যদেরকে উগ্রবাদী করে তুলতো।

তারা পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশের সমমনা ব্যক্তিদের সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যোগাযোগ রাখতেন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন উগ্রবাদী গ্রুপে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

গ্রেপ্তার যারা

গ্রেপ্তার মিজবাহ ওরফে আবু মাসরুর দেশের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে উচ্চ শিক্ষার জন্য ২০০৪ সালে ইউরোপের একটি দেশে যান এবং ফিন্যান্স এ মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করে দেশে ফিরে আসেন।

২০১০ সালে গ্রিনকার্ড স্কিমের মাধ্যমে স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে সপরিবারে ইউরোপে একটি দেশে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। তিনি আশিক ওরফে আবু আফিফার মাধ্যমে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে আনসার আল ইসলামে যোগদান করে এবং দাওয়াতি কার্যক্রম শুরু করেন।

সে ইউরোপে ওই দেশে অবস্থানের সময় সংগঠনের নাম না বলে বিভিন্ন দেশের মসুলমানদের উপর নির্যাতনের ভিডিও দেখিয়ে ও ধর্মীয় বিষয়ে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে সেখানে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ করে নতুন সদস্য সংগ্রহ করতো এবং নতুন সদস্যদের নিয়ে গোপন সভা করে উগ্রবাদে আগ্রহী করতো।  

২০২২ সালের অক্টোবরে সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের নির্দেশে বাংলাদেশে এসে সংগঠনের দাওয়াতি কার্যক্রম করতে থাকেন। পরবর্তীতে সে সংগঠনের ঢাকা অঞ্চলের দাওয়াতি শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তিনি দেশ ও বিদেশ থেকে সংগঠনের জন্য চাঁদা সংগ্রহ করতো বলে জানা যায়। তিনি ঢাকা, ঠাকুরগাও, দিনাজপুর, লক্ষীপুর, ভোলা এবং খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাংগঠনিক সফর, সভায় অংশগ্রহণ এবং নতুন সদস্য সংগ্রহ ও চাঁদা আদায় করতেন।

গ্রেপ্তার শেখ আশিকুর রহমান ওরফে আবু আফিফা একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএস সম্পন্ন করে। সে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরির পাশাপাশি এয়ার কন্ডিশনিং ব্যবসাও করতেন। আশিকুর সপরিবারে ইউরোপের একটি দেশে বসবাসকালীন মিজবাহর সঙ্গে পরিচয় ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তিনি ইউরোপের ওই দেশে থাকাকালীন সংগঠনের একজন শীর্ষ স্থানীয় নেতার মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে সংগঠনে যোগদান করে দাওয়াতী কার্যক্রম করতে থাকে। তিনি সংগঠনটির ঢাকা অঞ্চলের অন্যতম উপদেষ্টা ও অর্থের যোগানদাতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলো। সে বিভিন্ন সময় উগ্রবাদী ভিডিও কনটেন্ট সংগঠনের সদস্যদের পাঠাতো।

গ্রেপ্তার সাদী মো. জূলকার নাইন একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হতে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করে গার্মেন্টস সেক্টরে চাকরি করতো। সে মিজবাহর মাধ্যমে আনসার আল ইসলামে যুক্ত হয় এবং ঢাকা অঞ্চলের বিভিন্ন দাওয়াতী কার্যক্রমের পাশাপাশি সংগঠনের নতুন সদস্যদের প্রশিক্ষণ প্রদান করতো। সে সংগঠনে নিয়মিত চাঁদা প্রদান করতো।

এছাড়া সে মেজবাহর কাছ থেকে বিভিন্ন উগ্রবাদী বই, মুসলমানদের উপর নির্যাতন ও উগ্রবাদী নেতাদের বক্তব্যের ভিডিও সংগ্রহ করতো। সে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশের সমমনা ব্যক্তিদের সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচিত হয়ে তাদের সাথে যোগাযোগ করে তথাকথিত জিহাদের নামে হিজরত করে পার্শ্ববর্তী দেশে গমনের পরিকল্পনা ও চেষ্টা করছিল।

গ্রেপ্তার কামরুল হাসান সাব্বির একটি পাবলিক ইউনিভার্সিটি থেকে আইটিতে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করে একটি আইটি ফার্মে কর্মরত ছিল। সে শেখ আশিকুর রহমানের মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে দাওয়াতি কার্যক্রম করছিল। সে সংগঠনে নিয়মিত চাঁদা প্রদান করতো বলে জানা যায়।

সে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন উগ্রবাদী কনটেন্ট প্রচার প্রচারণা করতো এবং সংগঠনের নতুন সদস্যদের আইটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করতেন বলে জানা যায়।

গ্রেপ্তার সাঈদ মো. রিজভী পেশায় একজন চিকিৎসক। ২০২১ সালে একটি মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে অবস্থানকালীন উগ্রবাদী মতাদর্শের উদ্বুদ্ধ হন। পরবর্তীতে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মেজবাহর সাথে পরিচয় হয় এবং তার মাধ্যমে সংগঠনে যোগ দেয় এবং সংগঠনে নিয়মিত চাঁদা প্রদান করতো।

তার বাসায় প্রতি দুই মাস অন্তর অন্তর সংগঠনের সভা অনুষ্ঠিত হতো এবং নতুন সদস্যদের সংগঠনে যুক্ত করার আনুষ্ঠানিকতাও সেখানে সম্পন্ন হতো। এছাড়াও তার বাসায় সংগঠনের নতুন সদস্যদের শারীরিক কসরত প্রশিক্ষণ প্রদান করা হতো বলে জানা যায়।

গ্রেপ্তার মাসুম রানা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত। সে সাদী জূলকার নাইনের মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়। সে তার নিজ এলাকায় দাওয়াতী কার্যক্রম পরিচালনা করছিল বলে জানা যায়। সে সংগঠনে নিয়মিত চাঁদা প্রদান এবং সংগঠনের অন্যান্য সদস্যদের নিকট হতে চাঁদা সংগ্রহ করতো বলে জানা যায়।

গ্রেপ্তারদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন বলেও জানান র‍্যাবের এই কর্মকর্তা।

বাংলাদেশ সময়: ১৩১৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২৩
পিএম/এমএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।