ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

যমুনার ভাঙনে সব হারিয়ে নিঃস্ব আয়নাল-জয়ান এখন দিনমজুর

স্বপন চন্দ্র দাস, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩১ ঘণ্টা, নভেম্বর ৫, ২০২৪
যমুনার ভাঙনে সব হারিয়ে নিঃস্ব আয়নাল-জয়ান এখন দিনমজুর

সিরাজগঞ্জ: তীরে এসে যমুনা নদীর মাঝ বরাবর তাকিয়ে আছেন বাহাত্তর বছর বয়সী আয়নাল ব্যাপারী। কয়েক বছর আগে যেখানটায় হারিয়েছে তার স্বপ্ন, সেটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন।

মনে মনে ভাবেন আবার যদি সেই দিনটা ফিরে আসতো, যদি যমুনার উদর থেকে বাড়ি আর ফসলি জমিগুলো বেরিয়ে আসতো। ক্ষণিক পরেই সম্বিত ফিরে আসে বৃদ্ধের, বুঝতে পারেন সেদিন আর ফিরে আসার নয়। বিষণ্ন মনে চলে যান ক্ষেতে, যেখানে মজুর খাটছেন তিনি।  

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার জালালপুর ইউনিয়নের যমুনার কুল ঘেঁষা সৈয়দপুর গ্রামের বাসিন্দা বাহাত্তর বছর বয়সী আয়নাল ব্যাপারীকে দিনমজুরি খেটে সংসার চালাতে হয়।

সরেজমিনে সৈয়দপুর কবরস্থান এলাকায় গেলে যমুনার পাড়ে বসে থাকতে দেখা যায় আয়নাল ব্যাপারীকে। জানতে চাইলে যমুনার মাঝামাঝি স্থানে আঙুল তুলে তিনি বলেন, ওই যে গাঁয়ের পূবের মাথায় আমাগোরে বাড়ি আছিল, তিন বিঘার ওপরে চাষের জমিও আছিল। কয়েক বছর ধইর‌্যা ভাঙতে ভাঙতে সব গিল্যা নিছে যমুনা। এ্যাহন আমি নিঃস্ব। ওয়াপদা বাঁধের ওপর আশ্রয় নিছি, পরের জমিতে কৃষিকাজ কইর‌্যা সংসার চালাই। দুই মেয়েকে বিয়্যা দিছি, তিন ছওয়াল আছে। তারাও বিয়্যা কিইর‌্যা আলাদা সংসার পাতছে। এ্যাহন শুধু বুড়া-বুড়ি  থাকি।  

সৈয়দপুর গ্রামে যমুনা নদীর তীরেই পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গার ওপর বাড়ি করেছেন জয়ান মোল্লা। তার বয়সও সত্তরের ওপরে। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন, চার ছেলে বিয়ে করে আলাদা হয়েছেন। তারাও দিনমজুরি করে কোনোমতে সংসার চালায়। তাই বৃদ্ধ জয়ান মোল্লাকেও নিজের সংসার চালাতে মজুর খাটতে হয়।  

জয়ান মোল্লা বলেন, বাপে জমি-বাড়ি সব রাইহ্যা গেছিল। কিন্তু যমুনা নদী কিচ্ছু থোয় নাই, সব পেটে পুইড়্যা নিছে। এ্যাহন পুরো পরিবার নিয়্যা ওয়াপদার জায়গায় বাড়ি কইর‌্যা রইচি। ভাঙতে ভাঙতে এ্যাহন এই বাড়ির কাছেও চইল্যা আইচে যমুনা। এইড্যা ভাইঙ্যা গেলে কোনে যামু হেই চিন্তাই কইরত্যাছি।  

আয়নাল আর জয়ান মোল্লার মতোই অবস্থা ৮১ বছর বয়সী মকরম ফকিরের। চলতি বছরে তার পুরো বাড়িই নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। আব্দুস সালামের দেড় বিঘা জমি, সোনাউল্লাহর ৫৫ শতক জমি কয়েক মাসের মধ্যেই চলে গেছে। এ বছরের ভাঙনেই বাড়ি ও জমি হারিয়েছেন ফটিক আলী মণ্ডল, বাবলু শেখ, ওয়াহেদ আলী শেখ, রায়হান মোল্লা, আব্দুল মোতালেবসহ দেড় শতাধিক মানুষ।  

যমুনা পাড়ের এসব ভুক্তভোগীরা বলেন, ১৫ বছর ধরে এ অঞ্চলে ভাঙন শুরু হয়েছে। চার বছর আগে ভাঙনরোধে সরকার বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প শুরু করে। কিন্তু বাঁধের কাজ শুরু করার পর দফায় দফায় তা বন্ধ করা হয়। ফলে এ অঞ্চলের মানুষ ভাঙনের কবল থেকে মুক্তি পায়নি। চলতি বছরেই এক হাজার বিঘারও বেশি কৃষিজমি ও ৪শর বেশি বসতবাড়ি নদীগর্ভে চলে গেছে। এছাড়াও একটি স্কুল নদীগর্ভে গেছে। এখন কবরস্থান ভাঙনের মুখে রয়েছে।  

নদী রক্ষা আন্দোলন শাহজাদপুর উপজেলা শাখার সভাপতি মো. ফারুক রেজা বলেন, আমাদের দাবির মুখে গত কয়েক বছর আগে এনায়েতপুর থেকে হাঁট পাচিল পর্যন্ত নদী তীর রক্ষা বাঁধ প্রকল্প পাস হয়। কাজ শুরু হয়েও অদৃশ্য কারণে এই প্রকল্পটি বার বার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।  

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোখলেসুর রহমান জানান, ২০২১ সাল থেকে সেখানে বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প শুরু হয়। ঠিকাদাররা কিছু কিছু পয়েন্টে ব্লক তৈরি করেছে। কিন্তু পর্যাপ্ত ব্লক তৈরি না হওয়ায় তারা মাঠে নামে নাই। জুন মাস পর্যন্ত যে প্রগ্রেস হয়েছে তাতে ৫০ শতাংশ ব্লক ও জিওব্যাগ তৈরি করে ফেলা হয়েছে। এ বছর দৃশ্যমান একটা অগ্রগতি হবে। দু-একজন ঠিকাদার যারা কাজ শুরু করে নাই, তাদের নোটিশ দেওয়া হয়েছে যাতে কাজ শুরু করে। যদি শুরু না করে তবে কন্ট্রাকের রুল মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।  

বাংলাদেশ সময়: ১২২৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৫, ২০২৪
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।