ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন

যেভাবে শুকিয়ে ফেলা হলো বাংলাদেশের অর্থনীতি

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৪, ২০২৪
যেভাবে শুকিয়ে ফেলা হলো বাংলাদেশের অর্থনীতি

বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন গভর্নর আহসান মনসুরের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, শেখ হাসিনার সরকার আগস্টে পতনের আগের ১৫ বছরে দেশের অর্থনীতি থেকে প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলার পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে।

কয়েকজন অর্থনীতিবিদের ধারণা, শেখ হাসিনার শাসনামলে পাচার অর্থের পরিমাণ ৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।

তবে কেউই নিশ্চিতভাবে টাকার হিসাব বলতে পারে না।  

আহসান মনসুর বলেন, সরকার ও দেশের কিছু বড় বড় কোম্পানির মধ্যে থাকা অপরাধীরা কার্যত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ব্যাংক ডাকাতির ঘটনাটি ঘটায়। তারা বাংলাদেশের অর্থনীতির অবর্ণনীয় ক্ষতি করেছে।

বুধবার নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব বলা হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের সরকারের সময়ে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব পালন করছেন।

গভর্নর বলেন, রাজনৈতিক ক্ষমতার সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ উপলব্ধি করেছিল যে লুট করার জন্য সবচেয়ে ভালো স্থান হলো ব্যাংক। সম্পূর্ণ পরিচালনা পর্ষদগুলো অপহৃত হয়েছিল।

২৭ বছর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফে) কাজ করার সময়ে তিনি কখনো এমন কোন দেশ দেখেননি, যেখানে সরকারে শীর্ষস্তরের লোকেরা কিছু গুন্ডার সাহায্যে ব্যাংকগুলোতে পদ্ধতিগতভাবে লুটপাট চালায়।

খবরে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা ভারত পালিয়ে গেছেন, তার ভাগ্য ও সম্পত্তির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার বলেছে যে তারা তার প্রত্যার্পণ চেয়েছে।  

দেশছাড়া হাসিনার সহযোগী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর অর্থপাচারের তদন্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) নির্বাহী পরিচালক এ কে এম. ইহসান।

সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিরুদ্ধে এখনো অভিযোগ গঠন করা হয়নি। তবে আল–জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেন, হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ‘উইচ হান্ট’ করা হচ্ছে, তিনি তার বাইরে নন।

নিউইয়র্ক টাইমস শেখ হাসিনা ও সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। ঢাকায় আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয় শূন্য পড়ে আছে। এরপর তারা শেখ হাসিনার মুখপাত্রের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সফল হয়নি।

ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুল মান্নানের পদত্যাগের ঘটনা উল্লেখ করে নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি।  আব্দুল মান্নানের জন্য দিনটি অন্যান্য দিনের মতোই ছিল। তার চালক জ্যামের মধ্যে দিয়েই তাকে কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন। তখন গোয়েন্দা দপ্তর থেকে ডাক আসে। তাকে সদরদপ্তরে যেতে বলা হয়।  

সেখানে যাওয়ার পর সামরিক গোয়েন্দারা আব্দুল মান্নানের ফোন, ঘড়ি ও ওয়ালেট নিয়ে নেন। এরপর গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান আব্দুল মান্নানের দীর্ঘ ক্যারিয়ারের বিবরণ দেন; বাংলাদেশের ব্যাংক খাতকে তিনি যে গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের কাছে নিয়ে গেছেন, সেজন্য তার প্রশংসা করেন।

এরপরই তাকে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে পদত্যাগের চিঠিতে সই করতে বলা হয়। গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান তাকে বলেন, এই আদেশ দেশের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের কাছে থেকে আসা, অর্থাৎ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে পদত্যাগের নির্দেশ দেন।

আব্দুল মান্নান ও আহসান মনসুর গলা মিলিয়ে বলেন, ওই ঘটনার পর এস আলম গোষ্ঠী ইসলামী ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ হাতে নেয়। এস আলম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সাইফুল আলম। তিনি ট্রেডার হিসেবে ব্যবসা শুরু করেন।  

পরে বিশেষ করে শেখ হাসিনার আমলে তিনি বিভিন্ন খাতে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দাবি, এস আলম গোষ্ঠী অন্যান্য গোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত শূন্য করে দেওয়ার চক্রান্ত করেছিল।

ইসলামী ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংক এস আলম গোষ্ঠীর হাতে যাওয়ার পর নামে–বেনামে বিভিন্ন কোম্পানিকে ঋণ দেওয়া হয়েছে, যে ঋণের বড় অংশ আর ফেরত আসেনি। ফলে সেগুলো খেলাপি হয়ে গেছে।

এস আলম গ্রুপ আইনি প্রতিষ্ঠান কুইন ইমানুয়েলের মাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছে। বলেছে, দেশের একটি মাত্র ব্যাংক তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং সেটি ইসলামী ব্যাংক নয়।  

তাদের অভিযোগ, আহসান এইচ মনসুর এস আলম গোষ্ঠীর সঙ্গে নিপীড়নমূলক আচরণ করছেন; এমনকি যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে না।

হাসিনা সরকারের ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে বলে জানান বিএফআইইউর নির্বাহী পরিচালক এ কে এম এহসান।  

বাংলাদেশে অনেক ব্যাংক এখন লাইফ সাপোর্টে রয়েছে- নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে এমনটি উল্লেখ করা হয়েছে। যেসব ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা ভালো, তারাও সেভাবে ঋণ দিতে পারছে না, এমনকি আমানতকারীদের টাকা সব সময় ফেরত দিতে পারছে না। আমানতকারীদের মাঝেমধ্যে টাকা তোলার সুযোগ দিচ্ছে ব্যাংকগুলো।

বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ অর্থ নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তা উদ্ধারের চেষ্টা করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। শেখ হাসিনার দলের অনেক সদস্যের নামে অর্থ পাচারের মামলা করা হয়েছে, বিশেষ করে আমদানি–রপ্তানির মাধ্যমে যে অর্থ পাচার করা হয়েছে।

এর মাধ্যমে যে শুধু কিছু মানুষের পকেট ভারী হয়েছে তা নয়, এতে বাংলাদেশের মুদ্রা টাকার দরপতনও হয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের গতি বাড়তে থাকে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। অনেক ব্যাংকে নগদ অর্থের সংকট রয়েছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা একদিনে পুরো বেতন তুলতে হিমশিম খাচ্ছেন।  

বাংলাদেশে ওষুধ কোম্পানি টেকনো ড্রাগ কর্মী ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়েছে। এই কোম্পানির সহমহাব্যবস্থাপক মাজেদুল করিম নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, নিম্ন আয়ের কর্মীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কর্মীরা তাকে বলেছেন, ব্যাংক টাকা দিতে পারছে না। নিজের ডেবিট কার্ড দিয়েও টাকা তোলা যাচ্ছে না বলেও জানান তিনি।

আহসান মনসুর বলেন, যদিও মূল্যস্ফীতির হার কমে আসছে ও প্রবাসী আয়প্রবাহ বাড়ছে, তবুও এটি বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির বছর নয়। ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী গভর্নর বলেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বাংলাদেশের মুদ্রা স্থিতিশীল করতে আরও তিন বিলিয়ন বা ৩০০ কোটি ডলার সহায়তা দেবে।

বাংলাদেশ সময়: ২২৫৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৪, ২০২৪

আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।