চাঁপাইনবাবগঞ্জ: জনপ্রিয় ইসলামি বক্তা ড. মিজানুর রহমান আজহারী বলেছেন, আমরা এমন এক রাজনৈতিক বন্দোবস্ত চাই, যেখানে কেউ কাউকে জুলুম করার সাহস দেখাবে না। নতুন করে আর কেউ জালিম হবে না।
শনিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) বিকেল ৩টায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের মহারাজপুর ইউনিয়নের ঘোড়া স্ট্যান্ড সংলগ্ন লালাপাড়া মাঠে জাবালুন নুর ফাউন্ডেশনের আয়োজিত তাফসির মাহফিলে তিনি এসব কথা বলেন।
ড. মিজানুর রহমান আজহারী বলেন, যখন আমরা একা থাকি তখন আমরা ব্যক্তি, যখন আমরা সবাই মিলি তখন আমরা শক্তি। আমাদের এই ইউনিটি, আমাদের এই ঐক্যবদ্ধ শক্তিকে আগামীর ইসলামের জন্য কাজে লাগাতে হবে। নতুন বাংলাদেশ উদিত হওয়ার পর আমরা ইউনাইটেড, আমরা উচ্ছ্বসিত।
তিনি বলেন, একত্রিত হয়ে ছাত্র-জনতা দেখিয়ে দিয়েছে কীভাবে জালিমদের শায়েস্তা করতে হয়। চোখের ইশারায় কী তাদের কানেক্টিভিটি, কী তাদের বোঝাপড়া! গত ১৬-১৭ বছরে যেটা করা যায় নাই অল্প কয়েকদিনের ব্যবধানে তাদের ইউনিটি গোটা বাংলাদেশকে উজ্জীবিত করেছে। এই উচ্ছ্বাস, এই ইউনিটি আমাদের বজায় রাখতে হবে। এজন্য আগামীর বাংলাদেশ হবে ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ।
কয়েকটি রাজনৈতিক দলকে উদ্দেশ্য করে এ ইসলামী বক্তা বলেন, একসঙ্গে দেশ গড়ার কাজে ঐক্যবদ্ধ হতে চাই, এটা আবার অনেকের ভালো লাগে না। আমাদের সুখ অনেকের ভালো লাগে না। নানামুখী ষড়যন্ত্র। এমন এক দেশের পাশে আমরা প্রতিবেশী হয়ে আসছি। আমাদের অনেক কিছু বুঝে শুনে পা ফেলতে হয়। আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারি তাহলে কেউ আমাদের কিছু করতে পারবে না।
তিনি বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে উন্নতমানের রিসার্চ হোক। যেগুলো আমরা অন্যান্য দেশে দেখি, যে ছাত্রের হাতে কলম লেগেছে, সে হাতে অস্ত্রের স্পর্শ না লাগুক। আমরা নতুন বাংলাদেশে বুক ভরা স্বপ্ন নিয়ে এগোতে চাই। এক রাজনৈতিক দল অন্য রাজনৈতিক দলকে সম্মান করবে, শ্রদ্ধা করবে। এমন নেতা আমরা চাই, যে নেতা অসুস্থ হলে আমরা সারা দেশের মানুষ জায়নামাজ বিছিয়ে মোনাজাতে চোখের পানি ছেড়ে তার জন্য দোয়া করব।
আজহারী বলেন, নতুন ভোরের বাংলাদেশে আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। বিচ্ছিন্ন থাকলে হবে না।
তাফসির মাহফিলে জাবালুন নুর ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা জামায়াতের আমির মাওলানা আবু জার গিফারীর সভাপতিত্বে এতে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আমির নুরুল ইসলাম বুলবুল।
এছাড়াও প্রথম অধিবেশনে আলোচনা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের অধ্যাপক ড. গিয়াস উদ্দিন তালুকদার ও বাংলাদেশ মাজলিসুল মুফাসসিরিনের সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা মো. নুরুল আমিন।
এদিকে সকাল থেকেই সবগুলো মাঠ ভরে যায়। সোনামসজিদ- চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়কে মুসল্লিদের চাপে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। অনেক মুসুল্লিকে কয়েক কিলোমিটার পথ হেঁটে মাঠে পৌঁছাতে হয়। বন্ধ হয়ে যায় বন্দর থেকে ছেড়ে আসা পণ্যবাহী যান চলাচলও।
আয়োজকদের দাবি, যেহেতু এটি রাজশাহী বিভাগীয় মাহফিল, তাই রাজশাহী ছাড়াও পাবনা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, নওগাঁসহ বিভিন্ন জেলা উপজেলা থেকে মাহফিলে ১০ থেকে ১২ লাখ মানুষের সমাগম ঘটেছে। এটি চাঁপাইনবাবগঞ্জের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ওয়াজ-মাহফিল।
ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প ও অ্যাম্বুলেন্স সেবা:
মাহফিলকে কেন্দ্র করে চাঁপাইনবাবগঞ্জে নেওয়া হয় ব্যাপক প্রস্তুতি। লাখো মানুষের সমাগমকে কেন্দ্র করে মুসুল্লিদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে স্থাপন করা হয় ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প। এছাড়া জরুরিসেবা নিশ্চিত করতে সার্বক্ষণিক ৫টি অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত রাখা হয়।
ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা হাসপাতালের কনসালটেন্ট ডা. ইসমাইল হোসেন বলেন, আমরা তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা দিচ্ছি। তবে কোনো গুরুতর রোগীর খবর পাওয়া যায়নি।
আয়োজক কমিটির অন্যতম সদস্য হাফেজ গোলাম রাব্বানী বলেন, দূরদূরান্ত থেকে আগত মুসুল্লিদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে আমরা ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প চালু করি। এখানে প্রায় ৫০-এর অধিক চিকিৎসক এবং শতাধিক স্বাস্থ্যকর্মী ও ৩টি সার্জিক্যাল টিম নিরলসভাবে কাজ করছে। একইসঙ্গে গুরুতর অসুস্থ রোগীদের পরিবহনের জন্য ৫টি অ্যাম্বুলেন্স সার্বক্ষণিক প্রস্তুত রয়েছে এবং খাবার স্যালাইনসহ পর্যাপ্ত ওষুধের ব্যবস্থা রয়েছে।
এছাড়া পর্যাপ্ত টয়লেট, পানির ব্যবস্থা, খাবার হোটেল, প্রকাশনা স্টল, মেডিকেল টিম ও পরিবহন রাখার জন্য প্রায় ১৬টি গ্যারেজের সুব্যবস্থা ছিল। মূল মাঠে চারটিসহ সব মাঠে প্রজেক্টরের ব্যবস্থা ছিল। সার্বক্ষণিক বিদ্যুতের জন্য জেনারেটরের ব্যবস্থা ছিল। পাশাপাশি ফ্রি ওয়াইফাই, স্যানিটেশন, পর্যাপ্ত সুপেয় পানি, অজুখানার ব্যবস্থা, ইন্টারনেট সচলের ব্যবস্থা রাখা ছিল।
নিরাপত্তা ব্যবস্থা:
মাহফিলকে কেন্দ্র করে নেওয়া হয় নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পুরো এলাকা নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে রাখতে স্থাপন করা হয় শতাধিক চেকপোস্ট। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মোতায়েন করা হয় ৬৫০ পুলিশ সদস্য, ৫ হাজার স্বেচ্ছাসেবক, সেনাবাহিনীর একাধিক ইউনিট এবং র্যাবের টহল টিম।
ভিআইপি গেটের দায়িত্বে থাকা স্বেচ্ছাসেবক জহিরুল ইসলাম জানান, প্রবেশকারীদের কঠোর তল্লাশি এবং পরিচয়পত্র যাচাই করা হয়। সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
মাহফিলের মাঠে ২ লাখ মানুষের নামাজ আদায়:
শনিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) দুপুর সোয়া ১টায় জেলার মহারাজপুর ইউনিয়নের ঘোড়াস্ট্যান্ডের পাশের আমবাগান মাঠে জোহর নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নেন ২ লাখ মুসল্লি। নামাজে ইমামতি করেন জাবালুন নূর ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মাওলানা আবু জার গিফারী।
মাওলানা আবু জার গিফারী জানান, যেখানে মাহফিলের মূল মঞ্চ করা হয়েছে তার আয়তন ৪০ বিঘা। ধারণ ক্ষমতা ৩ লাখ মানুষ। ধারণা করা হচ্ছে, জোহরের নামাজে অন্তত ২ লাখ মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করেছেন। মূল মাঠ ছাড়াও আশপাশে পুরুষদের জন্য তিনটি ও নারীদের জন্য চারটি আলাদা মাঠ প্রস্তুত করা হয়। এত বড় মাহফিল ও এত মানুষ একসঙ্গে নামাজ আদায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের ইতিহাসে প্রথম।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. রেজাউল করিম বলেন, ড. মিজানুর রহমান আজহারীর মাহফিলে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করেছে পুলিশ। যানজট নিরসনে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে এবং জননিরাপত্তায় পুলিশ সদস্যরা নিয়োজিত ছিলেন।
বাংলাদেশ সময়: ১১২৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২৫
এসএএইচ