আবারও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে সিলেট। সীমাহীন পাথরলুট আর প্রশাসনের নির্বিকার ভূমিকায় ক্ষুব্ধ স্থানীয়রা যখন হতাশ, তখন পরিবর্তনের হাওয়া লাগে জেলা প্রশাসনে।
এ বিষয়ে সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট এমাদউল্লাহ শহীদুল ইসলাম বলেন, আমি স্পষ্ট বলতে চাই, কোন জেলা প্রশাসক (ডিসি), উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), সহকারী কমিশনার (ভূমি) আমলে লুটপাট হয়েছে, সেটা দেখার বিষয় এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। সেখানে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ঘটনাস্থলে গেছে। দুদক তখন যায়, যখন সরকারি কর্মকর্তারা দুর্নীতিতে জড়িত হয়ে পড়েন।
তিনি বলেন, পাথর কোয়ারি লুটে যারা জড়িত, সবাইকে আইনের আওতায় আনা হোক। তাছাড়া নতুন জেলা প্রশাসক আসছেন। তিনি আগের সব ত্রুটি দূর করবেন। পর্যটককে সচল করতে, সিলেটের লুটপাট ঠেকাতে সম্পূর্ণরূপে ভূমিকা নেবেন। সেক্ষেত্রে সাংবাদিক, সুধী সমাজ, পর্যটন ও পরিবেশ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকল শ্রেণির মানুষের সঙ্গে আলোচনা করে সিলেটকে সুন্দর করবেন।
পরিবেশ আইনবিদ সমিতি বেলার সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট শাহ শাহেদা আক্তার বলেন, যে উপজেলায় অবৈধ কার্যক্রম কেন্দ্র করে কমিটি করা হয়েছে। অভিভাবক হিসেবে দায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার। অথচ ওই ইউএনওকে জেলা প্রশাসনের ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটিতে রাখা হয়েছিল। মূলত জবাবদিহিতার জায়গাটি সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। নতুন জেলা প্রশাসক কেবল পাথর উত্তোলন ও টিলাকাটা বন্ধই নয়, পরিবেশের বিষয় ছাড়াও সার্বিক অবস্থায় ভালো কাজ করবেন, সেই প্রত্যাশা করি। তবে যে ইস্যুকে কেন্দ্র করে তাকে বদলি করে আনা হলো, তিনি পরিবেশের সার্বিক দিক গুরুত্বের সঙ্গে দেখবেন বলে আশা করি।
সিলেট জেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি মঈন উদ্দিন বলেন, পাথর লুটের ঘটনা সিলেটের জন্য দুঃখের। পাথর জাতীয় সম্পদ। মুষ্টিমেয় মানুষের কারণে এই সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে। দায় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, নাগরিক সমাজেরও দায় আছে। সবাই সচেতন থাকলে এটা হতো না। জেলা প্রশাসন নিয়ে মানুষের অনাস্থার ভাব কাটবে ডিসির বদলির মধ্য দিয়ে। নতুন ডিসির অনেক ভালো কাজ আছে, আমরা সেসব ভালো কাজ সিলেটেও দেখতে চাই, এটাই প্রত্যাশা থাকবে।
গত বছরের ৫ আগস্ট পট পরিবর্তনের পর সিলেটের ভোলাগঞ্জ, জাফলংসহ সব কোয়ারিতে পাথর লুটপাট শুরু হয়। সম্প্রতি জেলা প্রশাসন ধলাই নদীতে বালু লিজের ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই সপ্তাহে সাদাপাথর লুট করে নেয় পাথরখেকোরা। এই ঘটনায় ঘটনায় সমালোচনার ঝড় বয়ে যায় দেশে-বিদেশে। সাদাপাথরে নজিরবিহীন পাথর লুট নিয়ে সম্প্রতি দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এরপর থেকেই পাথর লুটপাটে প্রশাসনের উদাসীনতা ও ব্যর্থতার বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়।
গতকাল রোববার পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানও বলেন, পাথর লুটে স্থানীয় প্রশাসনের দায় রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পরিবেশ উপদেষ্টার এমন বক্তব্যের পরদিনই সিলেটের জেলা প্রশাসককে বদলি করা হলো। এর আগে সাদা পাথর পরিদর্শনে গিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তারাও পাথর লুটে স্থানীয় প্রশাসনের ব্যর্থতা রয়েছে বলে জানান।
সমালোচনার মধ্যেই সোমবার (১৮ আগস্ট) সিলেটের ডিসি মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদকে বদলির আদেশ দেওয়া হয়। তার স্থলাভিষিক্ত হচ্ছেন র্যাবের প্রাক্তন আলোচিত ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারোয়ার আলম। এদিন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে সিলেটের জেলা প্রশাসক হিসেবে তাকে নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাঠ প্রশাসন-২ শাখা থেকে এ প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের কর্মকর্তা সারোয়ার আলমকে সিলেট জেলার জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পদে বদলি ও পদায়ন করা হলো।
এর আগে বিকেলে প্রথমবারের মতো সাদা পাথর এলাকা পরিদর্শনে যান জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ। সেখানে তিনি সাদাপাথরের লুটপাটকৃত এলাকার পাথর পূণঃস্থাপন ঘুরে দেখেন। ঠিক সে সময় বদলির খবরটি প্রকাশ পায়।
শের মাহবুব মুরাদ গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর সিলেটের জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদান করেন। তার সময়েই সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ ও সাদাপাথরসহ বিভিন্ন কোয়ারি থেকে ব্যাপক বালু ও পাথর লুটের অভিযোগ রয়েছে।
এ ব্যাপারে কথা বলতে জেলা প্রশাসক শের মাহবুব মুরাদের মোবাইলে কল দেওয়া হলেও তিনি সেটি রিসিভ করেননি।
প্রসঙ্গত, সারাদেশে ৫১টি কোয়ারি (পাথর ও বালু উত্তোলনের নির্দিষ্ট স্থান) আছে। এর মধ্যে সিলেটের কানাইঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুরে আছে আটটি পাথর কোয়ারি। এর বাইরে সিলেটে সাদাপাথর, জাফলং, বিছনাকান্দি, উৎমাছড়াসহ আরও ১০টি জায়গায় পাথর আছে। এসব জায়গা পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। সীমান্তের ওপারে ভারতের পাহাড়ি নদী থেকে এসব পাথর আসে। ২০২০ সালের আগে সংরক্ষিত এলাকা বাদে সিলেটের আটটি কোয়ারি ইজারা দিয়ে পাথর উত্তোলনের সুযোগ দেওয়া হতো। তবে পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতির কারণে ২০২০ সালের পর আর পাথর কোয়ারি ইজারা দেওয়া হয়নি।
সিলেটের ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক দলের নেতারা সব সময় পাথর উত্তোলনের পক্ষে জোরালো অবস্থান নেন। বিগত পাঁচ বছরে তারা নানাভাবে কোয়ারি ইজারা আবার চালুর চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সরকার অনুমতি দেয়নি। এ অবস্থায় রাতের বেলা আড়ালে–আবডালে মানুষ অবৈধভাবে পাথর তুলতেন। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর টানা এক বছর দেদার পাথর লুটপাট চলে।
এনইউ/এমজে