ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৯ চৈত্র ১৪৩১, ০৩ এপ্রিল ২০২৫, ০৪ শাওয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন ‘বিভ্রান্তিকর ও একপক্ষীয়’: প্রেস উইং

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১১৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ১, ২০২৫
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন ‘বিভ্রান্তিকর ও একপক্ষীয়’: প্রেস উইং

‘বাংলাদেশ নতুনভাবে গড়ে উঠছে, আর ইসলামি কট্টরপন্থিরা সুযোগ খুঁজছে’—সম্প্রতি এই শিরোনামে যুক্তরাষ্ট্রের দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনটি নিয়ে বিবৃতি দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস উইং।

মঙ্গলবার (১ এপ্রিল) ওই বিবৃতিতে প্রতিবেদনটিকে ‘বিভ্রান্তিকর ও একপক্ষীয়’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিবৃতিতে বলা হয়, নিউইয়র্ক টাইমসের নিবন্ধটি বাংলাদেশকে একটি সংকটাপন্ন দেশ হিসেবে উপস্থাপন করেছে, যেখানে ধর্মীয় চরমপন্থা দখলদারিত্বের পথে রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এই চিত্রায়ন দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতাকে অতিসরলীকৃতভাবে তুলে ধরে এবং ১৮ কোটি মানুষের একটি জাতিকে অন্যায়ভাবে কলঙ্কিত করার ঝুঁকি তৈরি করে। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের যে অগ্রগতি হয়েছে, তা স্বীকার করা জরুরি, পাশাপাশি পরিস্থিতির জটিলতাও বোঝা দরকার। কেবলমাত্র বাছাইকৃত ও উসকানিমূলক উদাহরণ ব্যবহার করে একটি ভুল ধারণা তৈরি করা অনুচিত।

বাংলাদেশের অগ্রগতি ও চ্যালেঞ্জ স্বীকার করা
নিবন্ধটিতে কিছু ধর্মীয় উত্তেজনা ও রক্ষণশীল আন্দোলনের বিষয় তুলে ধরা হয়েছে, কিন্তু এটি দেশের সামগ্রিক অগ্রগতি নিয়ে কথা বলেনি। বাংলাদেশ নারীদের জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি অর্জন করেছে, এবং অন্তর্বর্তী সরকার তাদের নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে বিশেষভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই সরকার নারীদের অধিকার ও নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে, যা নিবন্ধে আঁকা নেতিবাচক চিত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত।

একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো ‘ইয়ুথ ফেস্টিভ্যাল ২০২৫’, যেখানে দেশের সব প্রান্ত থেকে প্রায় ২৭ লাখ মেয়ে ৩,০০০টি খেলা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে অংশ নিয়েছে। অঞ্চলভেদে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এবং আদিবাসী তরুণীদেরও ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল, যা বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে নারীদের সক্রিয় ও গতিশীল অংশগ্রহণের প্রমাণ। কেবল একটি ফুটবল ম্যাচ নিয়ে বিরোধিতা হয়েছে বলে ২,৯৯৯টি সফল আয়োজনের সাফল্য মুছে যায় না। একটি মাত্র ঘটনার ওপর গুরুত্ব দেওয়া দেশের তরুণ প্রজন্ম, বিশেষ করে নারীদের প্রাণবন্ততা ও দৃঢ়তাকে ভুলভাবে উপস্থাপন করার শামিল।

আরেকটি বিভ্রান্তিকর দাবি হলো, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট কঠোর অবস্থান নেননি। এই মন্তব্য শুধু ভুলই নয়, এটি নারীর ক্ষমতায়নে তাঁর আজীবনকার অবদানের বিষয়টিও উপেক্ষা করে। প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ইউনূস নারীর অধিকার রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। দুই কন্যার জনক ইউনূস তাঁর পুরো কর্মজীবন এবং গ্রামীণ ব্যাংকের ভিত্তিই গড়ে তুলেছেন নারীর ক্ষমতায়নের প্রতি অগাধ বিশ্বাসের ওপর, যা তাঁকে শেষ পর্যন্ত নোবেল পুরস্কার এনে দিয়েছে। নারীর অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষায় তাঁর অঙ্গীকারই তাঁর কাজ ও সুনামের মূল ভিত্তি।

ধর্মীয় সহিংসতা সম্পর্কে বিভ্রান্তি দূর করা
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে ধর্মীয় সহিংসতা হিসেবে চিত্রিত করা বিভ্রান্তিকর। শেখ হাসিনার বিদায়ের পর যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে তা মূলত রাজনৈতিক এবং এর অনেকগুলো ঘটনাকে ধর্মীয় সংঘাত হিসেবে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো প্রায়ই জনসমর্থন পেতে ধর্মকে ব্যবহার করে, যা সমস্যাটিকে আরো জটিল করে তুলে এবং রাজনৈতিক অস্থিরতাকে ধর্মীয় নিপীড়ন বলে ভুল ব্যাখ্যা করা হয়।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সুরক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং এই লক্ষ্যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও সন্ত্রাসবাদবিরোধী কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। বাংলাদেশ যে সামাজিক সংস্কার ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে চরমপন্থার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, তা ভুল তথ্য ছড়িয়ে ঢেকে ফেলা উচিত নয়।

বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের ভূমিকা
বাংলাদেশ নিঃশব্দে এশিয়ার অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তিতে রূপ নিচ্ছে, যেখানে প্রবৃদ্ধির গতি বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশাল সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে। সব বাধা অতিক্রম করে বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থিতিশীলতা বজায় রেখেছে এবং অসাধারণ সহনশীলতা প্রদর্শন করেছে। গত সাত মাসে রপ্তানি প্রায় ১২% বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার পরেও ব্যাংকিং খাত স্থিতিশীল রয়েছে, এবং টাকার বিনিময় হার ১২৩ টাকা প্রতি ডলারে স্থির রয়েছে। ভবিষ্যতের দিকে তাকালে, বাংলাদেশ ২০২৬ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে, এবং ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের নবম বৃহত্তম ভোক্তা বাজারে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

কিন্তু ৮৪ বছর বয়সী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের অসাধারণ পরিশ্রমের স্বীকৃতি কোথায়? গত আট মাস ধরে তিনি বিশ্বজুড়ে ঘুরে বেড়িয়ে বাংলাদেশের জন্য একটি ভালো ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে কাজ করে চলেছেন। মাত্র এক সপ্তাহ আগে চীন সফরে গিয়ে তিনি ২.১ বিলিয়ন ডলারের ঋণ, বিনিয়োগ ও অনুদান নিশ্চিত করেছেন। আর আগামী সপ্তাহে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হবে ইনভেস্টরস কনফারেন্স, যেখানে ৫০টি দেশের ২,৩০০ এর বেশি অংশগ্রহণকারী থাকবেন, যার মধ্যে মেটা, উবার ও স্যামসাং-এর মতো বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তারা থাকবেন। বিশ্ব বাংলাদেশকে একটি উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে দেখতে শুরু করেছে।

এটি আশার, শক্তির এবং অভূতপূর্ব সম্ভাবনার গল্প—যা যথাযথ সম্মান ও মনোযোগ পাওয়ার দাবিদার।

অতিসরলীকরণ ও একটি জাতিকে কলঙ্কিত করা থেকে বিরত থাকা
প্রবন্ধটি কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা, যেমন একজন ব্যক্তির মুক্তি, যিনি এক নারীকে অপমানজনক ভাষা ব্যবহার করেছিলেন, তুলে ধরে বাংলাদেশকে চরমপন্থার দিকে ধাবিত একটি দেশ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছে। এই ধরনের উপস্থাপন শুধু বিভ্রান্তিকরই নয়, বরং ক্ষতিকরও। ১৮ কোটি মানুষের একটি দেশে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা দিয়ে গোটা দেশকে বিচার করা অন্যায়। বাংলাদেশ একটি বৈচিত্র্যময় ও গতিশীল সমাজ, যার রয়েছে দীর্ঘ ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি এবং প্রগতিশীল চেতনা।

বাংলাদেশ একাই ধর্মীয় চরমপন্থার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েনি; এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা, যা বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন রূপে দেখা দেয়। তবে বাংলাদেশ শুরু থেকেই আইন প্রয়োগ, সামাজিক সংস্কার এবং সন্ত্রাসবাদ দমনের মাধ্যমে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আসছে। মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান বা অন্য যেকোনো সম্প্রদায়ের মানুষ—সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি অটুট।

কিছু কট্টরপন্থী ব্যক্তি হয়তো সামাজিকমাধ্যমে বা সমাবেশে ঘৃণার বার্তা ছড়াতে চায়, কিন্তু তাদের এই বিদ্বেষকে গুরুত্ব না দেওয়া এবং তাদের প্রচারণার জ্বালানিটুকু না দেওয়াই আমাদের দায়িত্ব।

এ ছাড়া, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে চরমপন্থা স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে—এই ধারণা খুবই একপেশে ও ভুল। দেশের গণতান্ত্রিক চেতনা এবং উজ্জীবিত নাগরিক সমাজ চরমপন্থি আদর্শের প্রসার রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। চ্যালেঞ্জ থাকলেও, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ শুধু কট্টরপন্থিদের হাতে গড়া হবে না। বিশেষ করে দেশের তরুণ প্রজন্ম ও নারীরা ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে যাবে।

সবশেষে, বাংলাদেশের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে টিকে থাকার ইতিহাস, গণতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকার এবং নারীর ক্ষমতায়নের ওপর গুরুত্ব—এসবই প্রমাণ করে যে, দেশটি সামনে এগিয়ে যাবে। কয়েকটি নেতিবাচক ঘটনার ওপর ভিত্তি করে দেশের চিত্র আঁকার পরিবর্তে, আমাদের বাংলাদেশের অগ্রগতি, দৃঢ়তা ও সংকল্পের বড় চিত্রটা দেখা উচিত।

বাংলাদেশ সময়: ২১১৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ০১, ২০২৫
এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।