ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৬ আষাঢ় ১৪৩২, ০১ জুলাই ২০২৫, ০৫ মহররম ১৪৪৭

জাতীয়

তথ্যপ্রযুক্তি

সংবাদমাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: সম্ভাবনা নাকি শঙ্কা?

রাকিব উদ্দিন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২:১১, জুন ৩০, ২০২৫
সংবাদমাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: সম্ভাবনা নাকি শঙ্কা?

সংবাদমাধ্যমের ভবিষ্যৎ কি মানুষের হাতে, নাকি প্রযুক্তির? এই প্রশ্ন এখন অনেকের মুখে মুখে। কারণ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই এখন আর কেবল গবেষণার বিষয় নয়, বাস্তবে তা পৌঁছে গেছে সব জায়গায়।

এমনকি সংবাদমাধ্যমও এটি ব্যবহার করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। সংবাদ তৈরি, সম্পাদনা, উপস্থাপন এমনকি পাঠকের কাছে পৌঁছানো থেকে শুরু করে সব জায়গায় এখন এআই প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে।

বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকতার অনেকটাই বদলে দিচ্ছে এআই। স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রতিবেদন তৈরি থেকে শুরু করে ভিডিওতে ভয়েসওভার যোগ করা কিংবা ভিডিও ফুটেজ আকারে তা পরিবেশন— এই সবকিছুই এখন সম্ভব অত্যাধুনিক এই প্রযুক্তির মাধ্যমে। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস, রয়টার্স, ব্লুমবার্গসহ অনেক বিখ্যাত সংবাদমাধ্যম ইতোমধ্যে এআই ব্যবহার করে রিপোর্টিংয়ের গতি বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

সম্প্রতি ওপেনএআই-এর চ্যাটজিপিটি, গুগল জেমিনি বা ভিইও থ্রির মতো টুলগুলো দিয়ে খসড়া লেখা, অনুবাদ, সারাংশ তৈরি কিংবা প্রাথমিক স্ক্রিপ্ট লেখার পাশাপাশি ভিডিও আকারে পরিবেশনের কাজ হচ্ছে অনায়াসেই। একইভাবে রানওয়ে অথবা পিকাল্যাবসের মতো ভিডিও টুল ব্যবহার করে সহজেই তৈরি করা যাচ্ছে মাল্টি-ল্যাঙ্গুয়েজ ভিডিও, ভিজ্যুয়াল রিপোর্ট ও ভয়েসওভারযুক্ত সংবাদ বুলেটিন। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোয় এমন প্রেজেন্টেশনই ভবিষ্যতের সংবাদ উপস্থাপনার নতুন ধারা গড়ছে।

বিশ্লেষণধর্মী সাংবাদিকতাতেও এআইয়ের প্রভাব স্পষ্ট। বিশাল তথ্যভান্ডার মুহূর্তের মধ্যেই বিশ্লেষণ করে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরিতে ‘এআই’ দিচ্ছে তাৎক্ষণিক সহায়তা। ভিন্ন ভাষায় করা সাক্ষাৎকারের অনুবাদ, বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলো থেকে তথ্য সংগ্রহ করে নিজেদের ভাষায় করা আগের চেয়ে এখন অনেক সহজ ও নির্ভুল। বিবিসি থেকে শুরু করে বাংলাদেশের অনেক গণমাধ্যমও এখন বিশ্লেষণভিত্তিক প্রতিবেদন তৈরিতে এসব প্রযুক্তির সহায়তা নিচ্ছে।

এআই শুধুমাত্র প্রতিবেদন তৈরি নয়, পাঠকের কাছে কোন খবর পৌঁছাবে তা ঠিক করতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। গুগল নিউজ বা ফেসবুকের অ্যালগরিদম অনেকাংশেই নির্ধারণ করছে কে কোন সংবাদ দেখবে। এ ছাড়া অনেক সংবাদপোর্টালই এখন নিজেদের ওয়েবসাইটে এআইভিত্তিক রিকমেন্ডেশন চালু করেছে। পাঠক কী পড়ছে, কতক্ষণ থাকছে, কাদের লেখায় আগ্রহ দেখাচ্ছে, কোন প্রতিবেদনে সময় বেশি দিচ্ছে—এরকম অনেক কিছুই বিশ্লেষণ করে মানুষের সামনে খুব দ্রুত উপস্থাপন করছে এআই।

এতক্ষণ ধরে এআইয়ের গুরুত্ব সম্পর্কে জানা গেলেও এর রয়েছে বেশ কিছু অসুবিধে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জাতিসংঘের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশ সাংবাদিকতার জন্য যেমন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে, তেমনি এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে জটিল নৈতিকতা, তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা এবং সাংবাদিকতায় স্বাধীনতার সংকট।

জাতিসংঘের ২০২৫ সালের মে মাসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘AI-powered journalism can support the industry, but without checks and balances, it risks undermining credibility and ethics.’

এই সতর্কবার্তার পেছনে রয়েছে অনেক বড় বাস্তবতা। বিশ্বের অনেক বিখ্যাত সংবাদমাধ্যম যেমন নিউইয়র্ক টাইমস, বিবিসি, রয়টার্স এখন এআই ব্যবহার করছে প্রতিবেদন লেখায়, হেডলাইন তৈরি, ট্রাফিক বিশ্লেষণ, এমনকি এসইও উন্নয়নে। একাধিকবার নিজেদের করা প্রতিবেদনে নিউইয়র্ক টাইমস উল্লেখ করেছে, তারা এআই দিয়ে পাঠকের আচরণ বিশ্লেষণ করছে— যেন পাঠকের সামনে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক সংবাদ সবার আগে তুলে ধরা যায়।

অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) প্রতি বছর প্রায় ৩৭০০ রিপোর্ট এআই দিয়ে তৈরি করছে। যার মধ্যে আছে স্টক মার্কেট আপডেট, খেলাধুলার স্কোর এবং আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্যও। ফলে সাংবাদিকরা আরও সময় পাচ্ছেন ইনভেস্টিগেটিভ বা বিশ্লেষণধর্মী সাংবাদিকতায় মনোযোগ দিতে।

যদিও সংবাদের নির্ভুলতার ক্ষেত্রে অনেক সময় সঠিক তথ্য উপস্থাপন করে না এই প্রযুক্তি। অনেক সময়ই দেখা যাচ্ছে, এআইভিত্তিক প্রযুক্তি দৃষ্টিভ্রমের কারণে ভুল তথ্য উপস্থাপন করছে। প্রতিবেদনে নিজের কল্পিত অথবা বিভ্রান্তিকর তথ্য তুলে ধরেছে। ফলে এসব প্রতিবেদন প্রকাশের আগে সাংবাদিকদের অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হচ্ছে।

এখানে অবশ্য প্রশ্ন ওঠে, প্রযুক্তি ব্যবহার করে যদি ভুল প্রতিবেদন বানানো হয় তবে এর দায় নেবে কে? লেখক? সংবাদমাধ্যম? নাকি প্রযুক্তি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান? এক্ষেত্রে এখনও স্পষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। তবে পয়েন্টার ইনস্টিটিউট কিংবা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস-এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ইতোমধ্যেই কিছু নীতিমালা প্রস্তাব করেছে।

আরেকটি বড় আশঙ্কা হলো পক্ষপাতমূলক কনটেন্ট। কারণ, এআইকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় ইন্টারনেটভিত্তিক তথ্য দিয়ে। অর্থাৎ, যে তথ্যগুলো ইনপুট করা হয়, সেগুলোই এআই বিশ্লেষণ করে উপস্থাপন করে। যেখানে অনেক ক্ষেত্রেই বিদ্যমান থাকে জাতিগত, ভাষাগত বা শ্রেণিভিত্তিক পক্ষপাত। ফলে প্রতিবেদন তৈরিতে অনেক সময় একপাক্ষিক তথ্য পাওয়া যায়। ভিন্নমতের তথ্য আড়ালে রয়ে যায়।

এখানে বাস্তবতা হলো, এআই পুরো সাংবাদিকতাকে একা চালাতে পারবে না। বরং সাংবাদিকদের কাজ আরও ফলপ্রসূ করতে এআইকে একজন দক্ষ সহকারী হিসেবে বিবেচনা করা যায়। গবেষণা, অনুসন্ধান ও গল্প বলার জগৎ তৈরি করবে মানুষই। এআই কেবল ইনপুট দেওয়া তথ্যাবলি থেকে মানুষকে সহায়তা করতে পারবে। ঠিক এই কারণেই অনেক গণমাধ্যম ইতোমধ্যে সাংবাদিকদের জন্য এআই প্রশিক্ষণ চালু করেছে—যাতে ভবিষ্যতের সাংবাদিকতায় তারা পিছিয়ে না পড়ে।

ইতোমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘এআই অ্যাক্ট’সহ বেশ কয়েকটি দেশে এআই ব্যবহারের নীতিমালা তৈরির কাজ চলছে। কীভাবে উদ্ভাবনকে রক্ষা করে নৈতিকতা বজায় রাখা যায়, সে পথেই হাঁটছে সংবাদমাধ্যমগুলোও।

এদিকে বাংলাদেশেও সংবাদমাধ্যমগুলোতে এআইয়ের ব্যবহার বাড়ছে। যদিও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে এটি। তবে দ্রুতই বাড়ছে এই প্রযুক্তির ব্যবহার। বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম এখন ভিডিও স্ক্রিপ্ট লেখায়, ভয়েসওভার তৈরিতে বা সোশ্যাল মিডিয়ার থাম্বনেইল ডিজাইন করতে এআই ব্যবহার করছে। এমনকি গ্রাফিক্সের কাজেও ব্যবহার হচ্ছে এই প্রযুক্তি। নিজেদের ভিডিওর জন্য করা থাম্বনেইল অথবা প্রতিবেদনের জন্য করা কাভার ফটো করা হচ্ছে এই প্রযুক্তি দিয়ে।

এতকিছুর পরেও এআই সম্পূর্ণভাবে এই পেশার অস্তিত্ব সংকটে ফেলতে পারবে না। কারণ, সাংবাদিকতা একটি পেশাই নয় কেবল, এটি দায়িত্ব, মানবিকতা ও সত্যানুসন্ধানের একটি প্রতিশ্রুতি। এই যাত্রায় এআই কেবল সহকারী হতে পারে, চালক নয়।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।