ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২, ০১ জুলাই ২০২৫, ০৫ মহররম ১৪৪৭

জাতীয়

ভুয়া তথ্যের ঝড়ে আস্থাহারা সংবাদমাধ্যম, দিশেহারা পাঠক

সৈয়দ মুহাম্মদ সালাউদ্দীন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২:১৬, জুন ৩০, ২০২৫
ভুয়া তথ্যের ঝড়ে আস্থাহারা সংবাদমাধ্যম, দিশেহারা পাঠক

সোশ্যাল মিডিয়া ও সংবাদমাধ্যমে ভুয়া তথ্য বা ‘ফেক নিউজ’ এখন শুধু বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে না, বরং সমাজ-রাজনীতি, ধর্মীয় সম্প্রীতি ও গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতাকেও গভীর সংকটে ফেলছে। ২০২৪ সালে বাংলাদেশে ভুয়া তথ্য শনাক্ত ও যাচাইয়ের হার আগের বছরের তুলনায় ৫৮ শতাংশ বেড়েছে।

এ বছর জানুয়ারিতে প্রকাশিত ডিসমিসল্যাবের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, বছরজুড়ে ৩ হাজারের বেশি বিভ্রান্তিকর বা ভুয়া তথ্য সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ ছিল রাজনীতি সংক্রান্ত। ধর্মীয় বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সংক্রান্ত ভুয়া তথ্য বিশেষভাবে ভাইরাল হয় আগস্ট থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে।

মিথ্যা তথ্য কেবল ব্যক্তির মানহানি বা ধর্মীয় উত্তেজনা তৈরিতে সীমাবদ্ধ থাকে না। তা দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ২০২৪ সালে ভারতে লোকসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভারত ও বাংলাদেশে একযোগে বিদ্বেষমূলক বিভ্রান্তিকর পোস্ট ভাইরাল হয়। ৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ভুয়া খবর ছড়িয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করা হয়।

সম্প্রতি আলোচনায় উঠে আসে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি নিয়ে মিথ্যাচারের একটি বড় ঘটনা। এ বছর ৩ জুন রাতে ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (সংশোধন), ২০২৫’ অধ্যাদেশ জারি হয়, যেখানে মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বা অন্যান্য নেতাদের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি বাতিলের কোনো প্রসঙ্গ ছিল না। অথচ ওই রাতেই দেশের একটি প্রথম সারির দৈনিকে ‘বঙ্গবন্ধুসহ ৪ শতাধিক নেতার মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি বাতিল’ শিরোনামে একটি বিভ্রান্তিকর সংবাদ প্রকাশ করে। এরপর একযোগে বহু গণমাধ্যমে এই ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে পড়ে। এ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বলেন, ‘অধ্যাদেশে এমন কিছু নেই। মুজিবনগর সরকারের যারা নেতৃত্বে ছিলেন, তারা অবশ্যই মুক্তিযোদ্ধা। তবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত। ’ প্রশ্ন উঠেছে, এতগুলো গণমাধ্যম কীভাবে একই ভুল সংবাদ প্রচার করল?

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটেও ভুল তথ্য একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে উভয় পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে তথ্য বিকৃতির অভিযোগ করছে। ইসরায়েলের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেন, ইরানি হামলায় ইচ্ছাকৃতভাবে সোরোকা হাসপাতালে আঘাত করা হয়েছে। তবে জাতিসংঘে ইরানের স্থায়ী মিশন এক বিবৃতিতে বলেছে, তাদের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ছিল নিখুঁতভাবে নির্ধারিত ও কেবলমাত্র এমন লক্ষ্যবস্তুতে, যেগুলো ইরানের বিরুদ্ধে হামলায় জড়িত বা সহায়ক ছিল। এভাবেই গুজব ও অপপ্রচারে আন্তর্জাতিক সংবাদজগৎও আজ বিভ্রান্ত।

এদিকে বাংলাদেশে ২০২৪ সালে ছড়িয়ে পড়া কিছু ভুয়া তথ্য ছিল চরম আশঙ্কাজনক। শেখ হাসিনার পতনের পর বলা হয়, ভারতীয় সেনারা বাংলাদেশ ছাড়ছে— যার কোনো ভিত্তি ছিল না। আবার একই সময়ে দাবি করা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন পরিচালক নাকি ভারতীয় নাগরিক। আন্দোলনরত ছাত্রনেতাদের ছবি বিকৃত করে বলা হয়, তারা চরমপন্থী বা জঙ্গি সংগঠনের সদস্য। এমনকি পুরনো মিছিলের ছবি দিয়ে বলা হয়, হাইকোর্ট ছাত্রলীগের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। আগস্ট মাসে বন্যার সময়, বিভিন্ন এনজিও বা সংস্থার পক্ষ থেকে দেওয়া ত্রাণ সহায়তার ছবি ছাত্রলীগের নামে চালিয়ে দেওয়া হয়।

এসব বিভ্রান্তিকর তথ্য সাধারণ মানুষকে যেমন ভুল বার্তা দেয়, তেমনি সংবাদমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। গণমাধ্যমের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো সত্য ও নিরপেক্ষতা। যখন যাচাই না করে ভুয়া সংবাদ প্রকাশিত হয়, তখন ওই সংবাদমাধ্যম পাঠকের আস্থা হারায়। সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলো যখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া তথ্য যাচাই না করেই প্রচার করে, তখন সংবাদমাধ্যম তার নৈতিক দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়।

এই পরিস্থিতিতে করণীয় কী? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিটি গণমাধ্যমে একটি স্বতন্ত্র ফ্যাক্ট-চেকিং ইউনিট থাকা উচিত, যারা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া খবর যাচাই করে রিপোর্ট তৈরি করবে। সরকারকে আইনগত কাঠামো গড়ে তুলতে হবে, যেন উদ্দেশ্যমূলকভাবে মিথ্যা তথ্য ছড়ানোকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা যায়। পাশাপাশি, স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ‘মিডিয়া লিটারেসি’ অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন, যাতে ভবিষ্যৎ নাগরিকরা তথ্য যাচাইয়ের প্রক্রিয়া সম্পর্কে সচেতন হয়।

সোশ্যাল মিডিয়া এখন মানুষের চিন্তা, আচরণ ও রাজনৈতিক মত গঠনে প্রভাব বিস্তারকারী অন্যতম হাতিয়ার। তবে এই হাতিয়ার যখন ভুল তথ্যের বাহক হয়, তখন তা ভয়াবহ রূপ নেয়। বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংবেদনশীলতা তীব্র, সেখানে ভুয়া তথ্য দেশের নিরাপত্তা, সম্প্রীতি ও গণতান্ত্রিক ধারার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এখনই সচেতনতা না বাড়ালে আগামী দিনে তথ্যের যুদ্ধ আমাদের বাস্তব যুদ্ধের দিকেই ঠেলে দেবে।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।