ঢাকা, রবিবার, ২২ আষাঢ় ১৪৩২, ০৬ জুলাই ২০২৫, ১০ মহররম ১৪৪৭

জাতীয়

তাজুল: রাজনীতি মানেই দুর্নীতি-দ্বিতীয় পর্ব

লাকসামের ‘দানব’ ছিলেন তাজুল

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯:৪৮, জুলাই ৬, ২০২৫
লাকসামের ‘দানব’ ছিলেন তাজুল

১৯৯৬ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত কুমিল্লার লাকসামে রাজত্ব ছিল মো. তাজুল ইসলাম ও তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের। এই সময়ের মধ্যেই নানান কর্মকাণ্ডে তাজুল ইসলামের ক্ষুধার রাক্ষুসে রূপ প্রকাশ হয়েছিল।

তাজুলের টানা রাজত্বে অতিষ্ঠ হয়ে স্থানীয় লোকজন তাঁকে লাকসামের ‘এরশাদ শিকদার’ বলেও অভিহিত করা শুরু করেছিল। কিন্তু প্রকাশ্যে কেউ তাঁর বিরুদ্ধে মুখ খুলত না।

লাকসামে শুধু দুর্নীতি নয়, মানুষকে ভয়ভীতি দেখিয়ে, তাদের জমি দখল করে, নির্যাতন করে জমি লিখে দিতে বাধ্য করা হতো। বহু মানুষকে গুম করার অভিযোগ আছে আওয়ামী লীগের এই সাবেক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর লাকসামবাসী তাজুলের বিরুদ্ধে মুখ খুলছে, বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য। তারা বলছেন, তাজুল ছিলেন লাকসামের ‘দানব’।

১৯৯৬ সালে এমপির পদে বসেই আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাদের কোণঠাসা করে তাজুল বিস্তার করতে থাকেন নিজের সাম্রাজ্য। গড়ে তোলেন নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী। ২০০৮ সালে দ্বিতীয়বারের মতো এমপি নির্বাচিত হয়ে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি। নিজেকে ভাবতে শুরু করেন লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ উপজেলার একক অধিপতি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাদের কোণঠাসা করে দাবিয়ে রাখার কূটকৌশল নেন তাজুল। দিন যত যাচ্ছিল, তাজুলের নিজ আত্মীয়-স্বজন ও পছন্দের হাইব্রিড নেতাদের দিয়ে দল পরিচালনার পরিধি ততই বেড়েছিল। ২০১৮ সালের বিতর্কিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর এলজিআরডি মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান তাজুল। তখনই অহংকার ও দম্ভের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছান তিনি। মন্ত্রিত্ব পেয়ে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

নিজ নির্বাচনী এলাকার সাধারণ মানুষ তো বটেই, দলের নেতাকর্মীদেরও আর প্রয়োজন বলে মনে করেননি। তিনি বনে যান লাকসাম-মনোহরগঞ্জের অঘোষিত সম্রাট।

তাজুল ইসলাম ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগ থেকে এমপি হওয়ার পর এলাকায় ‘তাজুলীগ’ প্রতিষ্ঠায় তৎপর হয়ে ওঠেন। ধীরে ধীরে সেটি প্রতিষ্ঠিতও হয়। ‘তাজুলীগ’ ছাড়া তাঁর কাছে আর কারোর মূল্য ছিল না। দানবীয় প্রকৃতি প্রকাশ পায় তাঁর। তাজুল ইসলাম দ্বিতীয়বার এমপি হওয়ার পর ভেতরের রাক্ষুসে ক্ষুধা বেড়ে যায়, আর তা লোকজনের চোখেও ধরা পড়ে। নজর পড়ে লাকসামের কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংকের ওপর। ২০১০ সালে কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে লাকসাম সমবায় ব্যাংকের গ্রাহকদের সঞ্চিত টাকায় কেনা স্থাবর-অস্থাবর শতকোটি টাকার সম্পদ দখল করে নেন তাজুল। দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ করা হয়েছে, লাকসাম কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংকের বিরুদ্ধে অর্থ ডিক্রি জারির মামলা দায়ের করে বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক লিমিটেড। এরপর ওই ব্যাংকের স্থাবর সম্পত্তির নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়। ওই নিলাম বিজ্ঞপ্তির বিরুদ্ধে তৎকালীন লাকসাম কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যান নিলাম কার্যক্রম বন্ধ রাখার জন্য সমবায় ব্যাংকের সহযোগিতা চেয়ে একটি চিঠি দেন। কিন্তু ওই চিঠির গুরুত্ব না দিয়ে লাকসাম কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংক নিলামে বিক্রির সিদ্ধান্তে অটল থাকে। স্থানীয়দের দাবি, তৎকালীন এমপি তাজুল ইসলামের সমবায় ব্যাংকের সম্পত্তি দখলের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্যই লাকসাম কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যানের চিঠির গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। লাকসাম কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিলামে বিক্রি হয়। জানা গেছে, তাজুল ইসলাম সন্ত্রাসী বাহিনীর মহড়া দিয়ে অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ওই নিলামে অংশগ্রহণ করতে দেননি।

সাবেক এলজিআরডি মন্ত্রী তাজুল ইসলামের পাঁচ খলিফার তাণ্ডবে আওয়ামী লীগের পুরোটা সময় তটস্থ ছিল কুমিল্লার লাকসাম ও মনোহরগঞ্জবাসী। আয়নাঘর বানিয়ে নির্যাতন করে টাকা আদায়, টেন্ডারবাজি ও জোর-জুলুম করে জমি দখলসহ নানাভাবে হয়রানি করাই ছিল তাঁদের কাজ। এসব অনৈতিক কাজে নেতৃত্ব দিতেন মন্ত্রীর ভাতিজা সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আমিরুল ইসলাম ও যুবলীগ নেতা শাহাদাত হোসেন, ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) মো. কামাল হোসেন, সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) জাহিদ হোসেন ও শ্যালক, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মহব্বত আলী। অনৈতিক কাজ করে তাঁরা এখন বিশাল সম্পদের মালিক।

২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর এলজিআরডি মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পেলে অহংকার ও দম্ভ বেড়ে যায় তাজুলের। নিজেকে ভাবতেন, লাকসাম-মনোহরগঞ্জের সম্রাট। মন্ত্রিত্ব পাওয়ার পর তাজুল লুটপাট আর অবৈধ সম্পদ অর্জনের খেলায় মেতে ওঠেন। দেশে-বিদেশে বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়েন। দুর্নীতি, অনিয়ম ও সীমাহীন ক্ষমতার অপব্যবহার করেন।

মনোহরগঞ্জে বিগত আওয়ামী লীগের শাসনামলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন সাবেক এলজিআরডি মন্ত্রী তাজুল ইসলামের ভাতিজা,  যুবলীগ নেতা শাহাদাত হোসেন। এলাকায় তিনি ‘মন্ত্রীর ক্যাশিয়ার’ হিসেবে পরিচিত। চাচা মন্ত্রী হওয়ায় উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় জমি দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ মানুষকে তুলে নিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়াসহ সম্পদের পাহাড় গড়তে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি। গত ইউপি নির্বাচনে বিনা ভোটে নির্বাচিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে উপজেলার বিভিন্ন প্রার্থীর কাছ থেকে মোট ১৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা এবং ১১ জন চেয়ারম্যানের কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা করে মোট ১৬ কোটি ৫০ লাখ টাকাসহ মোট ৩৩ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করেন মন্ত্রীর ভাতিজা আমির। এলজিইডির প্রতিটি কাজে ১০ শতাংশ হারে কোটি কোটি চাঁদা নিতেন এই আমির। বর্তমানে তাঁর নামে যমুনা ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংকে বিপুল অর্থ রয়েছে। বিপুল অঙ্কের অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে।

সাবেক এলজিআরডি মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের শ্যালক লাকসাম উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মহব্বত আলীর কোনো মহব্বত নেই। নানা অপরাধমূলক কর্মের জন্য এলাকায় তিনি ‘কসাই’ হিসেবে পরিচিত। লাকসাম শহরের প্রাণকেন্দ্র থানার সামনেই ছিল তাঁর ব্যাবসায়িক অফিস। কুমিল্লা জেলায় এটি ‘আয়নাঘর’ হিসেবে পরিচিত। এই ঘর থেকেই লাকসামে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতনের নির্দেশ দেওয়া হতো। মহব্বতের ছিলেন দুই খলিফা—চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দিন শামীম ও চেয়ারম্যান ওমর ফারুক। গোবিন্দপুর ও কান্দিরপাড়ে ছিল তাঁদের আয়নাঘরের দুটি শাখা। আরো দুটি শাখা পরিচালনা করতেন লাকসাম পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মনসুর আহমদ মুন্সী এবং ৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবু ছায়েদ বাচ্চু। বাচ্চুর পশ্চিমগাঁও পুরান বাজারের বাসা ও রাজঘাটে মুন্সীর কার্যালয়ে ছিল আয়নাঘরের জল্লাদখানা। আয়নাঘরের প্রধান কার্যালয় থেকে উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মহব্বত আলী প্রতিদিন চারটি শাখা থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিতেন। এসব করে ‘টোকাই’ মহব্বত আলী রাতারাতি হয়ে যান গাড়ি, বিশাল অট্টালিকা ও নামে-বেনামে অঢেল সম্পদের মালিক। এসব আয়নাঘরে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদেরও নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল। নির্যাতিত লাকসামবাসী এসব নির্যাতনের বিচার চান। ২০১২ সালে শ্যালক মহব্বতকে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত করার সব আয়োজন করেছিলেন তাজুল। যদিও ওই সময় ধনসম্পদ বলতে মহব্বতের তেমন কিছু ছিল না। অভিযোগ রয়েছে, ধীরে ধীরে তৈরি হয় মহব্বতের ‘গুণ্ডা বাহিনী’। তারা রেলওয়েসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থার জায়গা দখল করতে থাকে। এ নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। পরে কৌশল পাল্টে তরুণ প্রজন্মের রাজনীতিবিদ হওয়ার চেষ্টা করেন মহব্বত।

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।