‘বুকের ভিতর তুমুল ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’ চব্বিশের জুলাইয়ে স্লোগানটি শুধু বাক্য ছিল না, ছিল এক সম্পূর্ণ আন্দোলনের হৃদস্পন্দন।
২০২৪ সালের ১ জুলাই যখন সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে পথে নামে শিক্ষার্থীরা, তখন কেউ হয়তো কল্পনাও করেনি এই ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ৩৬ দিনের মধ্যে একটি সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেবে।
চব্বিশের আন্দোলনের ভাষা ছিল স্লোগান। স্লোগানগুলো কোনো কেন্দ্রীয় দলিল থেকে নয় এসেছিল রাজপথে রক্তাক্ত হওয়া মুখ থেকে, এসেছিল শোকবিহ্বল চোখ থেকে, বুকে জমে ওঠা ঘৃণা আর দ্রোহ থেকে। ঠিক যেমন নদী কোনো বাঁধ মানে না, তেমনই এই আন্দোলনও কোনো পূর্বলিখিত ছক ধরে এগোয়নি। প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি রক্তপাত জন্ম দিয়েছে নতুন স্লোগানের।
১৫ জুলাইয়ের পর আন্দোলনে যখন আওয়ামী লীগ সরকারের সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে, তখন আন্দোলনকারীদের মুখের ভাষাও বদলে যায়। রক্তাক্ত পরিস্থিতি মোড় নেয় সবচেয়ে ভয়ানক রূপে, আবু সাঈদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। ১৬ জুলাই, রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশ গুলিতে নিহত হন। সেখান থেকেই কার্যত শুরু হয় ‘এক দফা’, সরকার পতনের দাবিতে এক অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান।
শুরুটা ছিল ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলন। কিন্তু ধীরে ধীরে তা হয়ে ওঠে একটি জাতির সম্মিলিত আর্তনাদ। সে সময়কার স্লোগানগুলো শুধু শব্দই ছিল না, ছিল অস্ত্র, ছিল আন্দোলনের ব্যালট। যে ভাষায় মানুষ ভোট দিতে পারে না, কিন্তু চিৎকার করে উঠে দাঁড়ায়।
‘আমি কে, তুমি কে, রাজাকার রাজাকার! কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার!’ ‘এক দুই তিন চার, শেখ হাসিনা গদি ছাড়!’ এ বাক্যগুলো শুধুই কণ্ঠের শব্দ ছিল না, বরং লক্ষ লক্ষ মানুষের ক্ষোভের অভিব্যক্তি ছিল।
আন্দোলনের গভীরে গিয়ে যখন আবু সাঈদের রক্ত রাজপথে শুকাচ্ছিল, তখন জন্ম নিচ্ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে হৃদয়বিদারক কিছু স্লোগান— ‘আমার খায়, আমার পরে, আমার বুকেই গুলি করে!’, ‘তোর কোটা তুই নে, আমার ভাই ফিরায়া দে!’ ‘বন্দুকের নলের সাথে ঝাঁজালো বুকের সংলাপ হয় না!, ‘লাশের ভিতর জীবন দে, নইলে গদি ছাইড়া দে!’ এই স্লোগানগুলো রাজনৈতিক পুঁথির শব্দ ছিল না। ছিল জাতির স্নায়ুতন্ত্রে গেঁথে থাকা অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে রূপ নেওয়া সরকার বিরোধী আন্দোলন শুধু নতুন স্লোগান তৈরি করেনি, ফিরিয়ে এনেছিল পুরনো ইতিহাসও। যেমন: ‘আমার সোনার বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই!’ ‘৭১ এর হাতিয়ার, গর্জে ওঠো আরেকবার!’, ‘যে হাত গুলি করে, সে হাত ভেঙে দাও!’ ‘অ্যাকশন অ্যাকশন, ডাইরেক্ট অ্যাকশন!’ স্লোগানগুলো ১৯৭১ ও ১৯৯০-এর আন্দোলনের অনুরণন হিসেবে ফিরে এসেছিল এই প্রজন্মের কণ্ঠে।
এমনকি স্কুলপড়ুয়া শিশু, কিশোর-কিশোরীরাও মুখে তুলে নিয়েছিল প্রতিবাদের ভাষা। ‘কে এসেছে কে এসেছে, পুলিশ এসেছে পুলিশ এসেছে!, ‘কি করছে কি করছে, স্বৈরাচারের পা চেটেছে!’ তাদের কোমল কণ্ঠে এমন কঠিন শব্দ, বুঝিয়ে দিয়েছে জাতির শাসকেরা কতই না নিকৃষ্ট!
যখন রাজধানীসহ সারা দেশজুড়ে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে তখন প্ল্যাকার্ডে, ব্যানারে, কবিতার পঙ্ক্তিতেও দেখা যায় বিদ্রোহের চিত্রনির্মাণ— ‘চেয়ে দেখ এই চোখের আগুন, এই আগুনেই আমরা হবো দ্বিগুণ!’ ‘আসছে ফাগুন আমরা হবো দ্বিগুণ’ ‘হাল ছেড়ো না বন্ধু, কণ্ঠ ছাড়ো জোরে!’, ‘নিউটন বোমা বোঝো, মানুষ বোঝো না!’
সবচেয়ে হৃদয়বিদারক স্লোগান, যা গায়ের লোম খাড়া করে দেয়, ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর!’ বাক্যটি। এই একটিমাত্র স্লোগান যেন হয়ে উঠেছিল আন্দোলনের পোস্টারচিত্র।
বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ এ প্রজন্মের মনের মধ্যে যে গেঁথে গেছে, তা বোঝা যায় তরুণদের বলিষ্ঠ কণ্ঠে। ফ্যাসিস্ট সরকার প্রধান যখন ছাত্রদের রাজাকারের বাচ্চা বলে ওঠেন, তার লেজুড়ররা আন্দোলনকারীদের বাংলাদেশ ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যেতে বলেন। এর প্রতিবাদে কণ্ঠে ওঠে, ‘কথায় কথায় বাংলা ছাড়, বাংলা কি তোর বাপ দাদার’ স্লোগান।
রিকশাচালক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ভ্যানচালকদের রাজপথে নামাও চব্বিশের আন্দোলনের ব্যতিক্রমী ঘটনা ছিল। তাদের মুখেও উচ্চারিত হতে থাকে— ‘আমার ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেবো না!’, ‘আগুন জ্বালো আগুন জ্বালো, শেখ হাসিনার গদিতে আগুন জ্বালো, একসাথে!’ স্লোগান।
শুধু তা-ই নয়, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ‘বৌতদিন হাইও, আর নো হাইয়ে!’ স্লোগানটি মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে পড়ে। এর অর্থ ‘আর খেও না, অনেকদিন খেয়েছো!’ এই ভাষাগুলো কেবল রাস্তায় ছড়িয়ে ছিল না, তারা মিশে গেছে মানুষজনের শিরায় শিরায়।
ব্রিটিশ শাসনের সময়ে ‘বন্দে মাতারম’ নিষিদ্ধ হলে, বরিশালের নারীরা চুল বাঁধা বন্ধ করে গড়ে তুলেছিলেন এক অভিনব প্রতিবাদ। চব্বিশের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের স্লোগানগুলো সেই ধারাবাহিকতারই নবতম কণ্ঠ।
শেষের দিকে ফিরে আসে ইতিহাসের প্রতিধ্বনি— ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ!’ আসে আঠারোর সাহসের উন্মাদনা ছড়িয়ে দেওয়া স্লোগান ‘যদি তুমি ভয় পাও তবে তুমি শেষ, যদি তুমি রুখে দাঁড়াও তবে তুমিই বাংলাদেশ!’
এই স্লোগানগুলো ছিল আন্দোলনের মেরুদণ্ড। রাজপথে পুলিশের গুলির মুখেও থেমে যায়নি কণ্ঠ, বরং গর্জে উঠেছে, ঝড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এ স্লোগান শুধু পতনের ছিল না, ছিল পুনর্জন্মেরও। বাক্যগুলো শুধু প্রতিবাদের ছিল না, ছিল ঐক্যেরও।
চব্বিশের আন্দোলনের স্লোগানগুলো কখনো হয়তো পাঠ্যবইয়ে থাকবে না। কিন্তু এরা থাকবে দেয়ালে আঁকা, প্ল্যাকার্ডে লেখা, মুখে মুখে উচ্চারিত ইতিহাসের অংশ হয়ে। কেননা, ইতিহাস কেবল রাজনীতিবিদরা লেখেন না, তাকে লেখে রাজপথে পিঠ ঠেকে যাওয়া সেই ছাত্র, যার মুখে লেগে থাকে একটাই কথা— ‘দিয়েছি তো রক্ত, আরও দেবো রক্ত’!
কারণ এই রক্ত, এই শব্দ, এই স্লোগান— একটি প্রজন্মের সাহস। একটি দেশের বিবেক। একটি নতুন ভোরের প্রতিশ্রুতি।
এমজে