ঢাকা, সোমবার, ৩০ আষাঢ় ১৪৩২, ১৪ জুলাই ২০২৫, ১৮ মহররম ১৪৪৭

জাতীয়

‘প্রিয় বাবা আর কোনো দিন আসবে না, আদর করে বুকে জড়িয়ে ধরবে না’

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭:০৯, জুলাই ১৪, ২০২৫
‘প্রিয় বাবা আর কোনো দিন আসবে না, আদর করে বুকে জড়িয়ে ধরবে না’ শহীদ হাফেজ মাওলানা মো. জসিম উদ্দিন (বাঁয়ে), তার কবর (মাঝে) ও তার পরিবার

ঢাকার উত্তরা ৫ নম্বর সেক্টরে একটি ওয়ার্কশপে চাকরি করতেন হাফেজ মাওলানা মো. জসিম উদ্দিন। প্রায় ১৫ বছর ধরে ঢাকায় ছিলেন তিনি।

২০২৪ সালের ১৮ জুলাই, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের দিন তিনি গিয়েছিলেন ৭ নম্বর সেক্টরে অবস্থিত ফরহাদ অটো পার্টসের দোকানে মাইক্রোবাসের যন্ত্রাংশ কিনতে। সেখান থেকে ফেরার সময় সড়কে চলমান আন্দোলনের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন জসিম।

১৮ জুলাই রাতেই তার মরদেহ আনা হয় বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার পূর্ব সলিয়াবাকপুর গ্রামে। পরদিন ১৯ জুলাই সকালে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় তাকে। হাফেজ মাওলানা জসিম উদ্দিন সলিয়াবাকপুর গ্রামে মৃত আব্দুল মান্নান হাওলাদের ছেলে।

মৃত্যুকালে জসিম উদ্দিন রেখে গেছেন স্ত্রী সুমি আক্তার, দুই সন্তান ও বৃদ্ধা মা মেহেরুন্নেছা বেগমকে। বর্তমানে এই পরিবারটি বসবাস করছে পূর্ব সলিয়াবাকপুর গ্রামের টিনশেড বাড়িতে, যেখানে কয়েক কদম দূরেই রয়েছে জসিম উদ্দিনের কবর।

স্বামী হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন সুমি আক্তার। এখন সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটে তার। তিনি বলেন, আমার স্বামী হাফেজ জসিম উদ্দিন ঢাকার উত্তরায় একটি ওয়ার্কশপে চাকরি করতেন। ১৮ জুলাই যানবাহনের পার্টস কিনে ওয়ার্কশপে ফেরার পথে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। মৃত্যুর কিছু সময় আগেই মেয়েকে স্কুল থেকে আনার জন্য আমাকে ফোন দিয়েছিলেন। কিন্তু এরপরই ভাসুরের মাধ্যমে খবর আসে, আমার স্বামী আর নেই।

সুমি আক্তার আরও বলেন, আমিও আর আমার স্বামীকে ফিরে পাবো না। ছোট ছোট দুটি সন্তানও আর কোনোদিন তার বাবাকে ফিরে পাবে না। আমি খুব চিন্তায় আছি ওদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। সরকারিভাবে কিছু সহযোগিতা ও জুলাই ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে কিছু সহায়তা পেয়েছি। কিন্তু সঞ্চয়পত্রের মুনাফার টাকায় এই বাজারে সন্তানদের খরচ চালানো খুব কষ্টকর। দিন যত যাবে খরচ আরও বাড়বে। সরকার যেন আমাদের দিকে তাকায়, আমার সন্তানদের কথা ভাবে।  

তিনি আরও বলেন, আমার স্বামী তো হাফেজ ছিলেন, তিনি তো কোনো অপরাধ করেননি। তাকে কেন এভাবে খুন করা হলো? আমি চাই— এই হত্যার বিচার হোক।  

হাফেজ জসিম উদ্দিনের বড় মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস এখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। বাবার কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। বলে, আমার বাবা বলেছিল ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠলে একটা ল্যাপটপ কিনে দেবে। আমি তো ভালো রেজাল্ট করে ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠেছি। কিন্তু এখন আমার বাবাই তো নেই। বাবা না থাকলে অনেক ইচ্ছা অপূর্ণ থেকে যায়। বাবা আর কোনো দিন আসবে না, আদর করে বুকে জড়িয়ে ধরবে না…

ছুটিতে ঢাকা থেকে জসিম বাড়ি এলে তার দুই সন্তানের জন্য খেলনা, খাবার ও পোশাক নিয়ে আসতেন। আদর করে বুকে জড়িয়ে ধরতেন। তার আড়াই বছরের ছেলে সাইফ এখনো বুঝে উঠতে পারে না বাবা নেই। কবরের পাশে গেলেই আদুরে কণ্ঠে ডাকে— আব্বু, ঘরে চলো। কিন্তু বাবা তো তার সঙ্গে ফেরেন না!

জসিম উদ্দিনের মা মেহেরুন্নেছা বেগম এখনো বিশ্বাস করতে পারেন না তার ছেলে আর নেই। তিনি বলেন, আল্লাহ তাআলা যেইভাবে রাখবেন সেইভাবেই আছি এই নাতিগো নিয়া। আল্লাহ যা খাইতে দেন, তাই খাই, যেভাবে রাখতেছেন সেইভাবে থাহি। পোলা যার যায় হ্যার পড়ানডার ভেতরে কি হরে হ্যা কি কওয়া যায়? গ্যাছে গোটা রাইতও কাইন্দা কাটাইছি। জসিম মরার দুইদিন আগেও আমার লগে ফোনে কতা কইছে। কইছে-মা তোমার কোনো সমস্যা নাই, তুমি কোনো কাজ কাম করবা না, আগে তোমার তিন পোলা কাম করতো এহন চাইর পোলা করে, এক পোলার টাহা শ্যাষ হইয়ে আরেক পোলার তা খরচ করবা। আমি অসুস্থ হওয়ার সময়ও জসীমসহ আমার পোলারা আমার লইগ্যা কতো কানছে, কিন্তু এহন তো হেই জসিমও আমার কাছে নাই, মোরে আর মা কয় না।

তিনি আরও বলেন, মোর পোলার বউ তো এহানে আছে, দেইখা নাতিগো লইয়া আল্লাহ দেলে ভালো আছি। হে না থাকলেও তো মোর থাকতে হইতো। তয় সব মিলাইয়া আল্লাহ যেইভাবে রাখতেছেন সেইভাবে থাহি।

সরেজমিনে দেখা যায়, পূর্ব সলিয়াবাকপুর গ্রামের কাঁচা রাস্তার শেষ মাথায় অবস্থিত একটি টিনশেড বাড়িতে দুই সন্তান আর শাশুড়িকে নিয়ে বসবাস করছেন সুমি আক্তার। স্বামী মারা যাওয়ার পরও শাশুড়ির দায়িত্ব ছেড়ে যাননি তিনি। সেখানেই আঁকড়ে আছেন ভালোবাসার স্মৃতি ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভার নিয়ে।

এমএস/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।