ঢাকা, শনিবার, ৩ শ্রাবণ ১৪৩২, ১৯ জুলাই ২০২৫, ২৩ মহররম ১৪৪৭

জাতীয়

শহীদ মুগ্ধের স্মৃতিচারণ করলেন ভাই স্নিগ্ধ

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩:৫১, জুলাই ১৮, ২০২৫
শহীদ মুগ্ধের স্মৃতিচারণ করলেন ভাই স্নিগ্ধ মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ ও শহীদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ। (বাম থেকে)

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘোষিত কমপ্লিট শাটডাউন অর্থাৎ সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচির প্রথম দিন ছিল গত ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই। সেদিন রাজধানী ঢাকা ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষোভে উত্তাল।

সেদিন সংঘাত ছড়িয়েছিল শহরের অলি-গলিতে। ঠিক সন্ধ্যে নামার আগে উত্তরার আজমপুর এলাকায় ক্লান্ত শিক্ষার্থীদের মাঝে পানি বিতরণ করছিলেন মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ।

তার কণ্ঠে ছিল, ‘পানি লাগবে কারো, পানি!’ কিন্তু মুহূর্তেই একটি গুলি থামিয়ে দেয় তার সব স্বপ্ন, পরিবার, ভবিষ্যৎ সবকিছু। ওই দিন শহীদ হন মীর মুগ্ধ।
মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধের যমজ ভাই মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ। আজ শহীদ ভাইয়ের স্মৃতিচারণ করে দীর্ঘ একটি পোস্ট দিয়েছেন তিনি।

স্নিগ্ধের ফেসবুক পোস্টটি পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো—

৯ অক্টোবর ১৯৯৮ সালে জন্মগ্রহণ করি আমরা দুই যমজ ভাই। জন্মের পর থেকেই আমরা নাকি গোলগাল প্রকৃতির ছিলাম। একইরকম দেখতে হওয়ায় অনেক সুবিধাও নিয়েছি—একজন আরেকজনের হয়ে। যখনই মাটিতে কিছু পড়ে থাকতে দেখতাম, সঙ্গে সঙ্গে দুজন দৌড় দিতাম— কে আগে সেটা বারান্দা দিয়ে বাইরে ফেলে দেবে! বারান্দা বন্ধ থাকলে বাথরুমে কমোডে ফেলে দিতাম আর খিলখিল করে হাসতাম।

স্বর্ণের চেইন থেকে শুরু করে পায়ের জুতো—কোনো কিছুই আমাদের জন্য মাটিতে রাখা যেত না।

জীবনে এরকম কত যে পরীক্ষা একে অপরের হয়ে দিয়েছি! কোনো শিক্ষক আজ পর্যন্ত ধরতেই পারেনি। এভাবেই আমাদের বড় হয়ে ওঠা—একসঙ্গে। বুঝ হওয়ার পর থেকেই দুজনের মধ্যে সবসময় প্রতিযোগিতা লেগেই থাকত। যদিও পড়ালেখায় ওর থেকে কখনো এগিয়ে থাকতে পারিনি, তবে ফ্রিল্যান্সিং থেকে শুরু করে অন্য সবকিছুতে আমাদের টক্কর হতো সমানে সমানে।

আর একটা জিনিস ছিল—ওর সাহস। সেই সাহসের উদাহরণ দিতে গেলে গল্প শেষ হবে না। ছোট থেকে বড় হওয়ার এই যাত্রায় আমরা প্রায় সারা বাংলাদেশ একসঙ্গে ঘুরে বেরিয়েছি—কি করি নাই একসঙ্গে!

১৭ জুলাই ২০২৪—মুগ্ধর মৃত্যুর একদিন আগেও আমরা প্রায় রাত ১টা পর্যন্ত একসঙ্গে কাজ করে ঘুমাতে গিয়েছিলাম। সেই রাতেও প্রতিদিনের মতো মশারি টানানো নিয়ে আমাদের ঝগড়া হয়—এটা ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। আমি ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই মুগ্ধ নিজেই ডেকে আমাকে উঠিয়ে দিল। এমন আগে কখনো হয়নি—ও ঘুমের মধ্যে থেকে আমাকে ডেকেছে! আমাকে ঘুম থেকে তুলে নানা বিষয় নিয়ে কথা বলছিল—বিশেষ করে আম্মুকে নিয়ে। বলছিল, ‘আম্মু সারাজীবন আমাদের জন্য কষ্ট করেছে, কীভাবে আম্মুকে নিজের টাকায় একটা ফ্ল্যাটে উঠাবে…’ ওর খুব শখ ছিল—নিজের টাকায় একদিন আম্মুকে নতুন ফ্ল্যাটে তুলবে।

একপর্যায়ে কথা বলতে বলতে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনের ভিডিও বের করে দেখাচ্ছিল—বলছিল, ‘এখন খুলনায় থাকা উচিত ছিল, জুনিয়রদের হেল্প করতে পারতাম। ’ কথা বলতে বলতে প্রায় ৩টা বেজে গেল, তবু ওর কথা শেষ হয় না। আমার তখন একদিন আগের এক্সিডেন্টে হাতের নখ উঠে গিয়েছিল, ৫টা সেলাই—ভীষণ ব্যথা করছিল। তাই একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘কি শুরু করলি? ঘুমাতে দে। ’ এটাই ছিল মুগ্ধর সঙ্গে কাটানো আমার শেষ রাত।

সবচেয়ে বেশি ঝগড়া হতো জামাকাপড় নিয়ে। পরের দিন আন্দোলনে যাওয়ার সময় ও আমারই একটা জামা পরে বের হয়, আর যখন জানতে পারি ওর গায়ে গুলি লেগেছে—তখন আমিও ওর একটা শার্ট গায়ে দিয়ে বের হই। যখন মুগ্ধকে হাসপাতালে প্রথম দেখি—মনে হচ্ছিল কি আরাম করে ঘুমাচ্ছে, এক শান্তির ঘুম! বোঝার কোনো উপায় ছিল না যে ও আর নেই। মায়ের পেট থেকে যে একসঙ্গে বেরিয়েছি—সে কীভাবে এভাবে একা চলে যায়?

সারা রাত ওর লাশের গাড়ির পাশে বসে ছিলাম—ঠিক প্রতিরাতের মতোই। পার্থক্য একটাই—গত রাতে ওর ভেতরে প্রাণ ছিল, আজ আর নেই। যতবারই সেদিন ওকে দেখেছি—মনে হচ্ছিল ওর শরীর থেকে আলো বের হচ্ছে। জীবনে ওকে এতটা সুন্দর আর কখনো লাগেনি। এক পর্যায়ে মনে পড়ল—আম্মু-আব্বু তো তখনো জানে না মুগ্ধ আর নেই! তারা তখনো চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসছিল। ভাবছিলাম, মা যখন মুগ্ধকে এই অবস্থায় দেখবে, তখন কী হবে?

অবশেষে সকালে তারা এলো। মুগ্ধর পাশে গিয়েই জানল—মুগ্ধ আর নেই। সেইদিন শক্ত-সবল ভাইকে দেখলাম কীভাবে নিরীহ শিশুর মতো লাশের গাড়ি ধরে বিনা শব্দে কাঁদছিল। কাঁদবেই বা না কেন? চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত পুরো রাস্তায় আব্বু-আম্মু কিছু বুঝতে না পারে, সেই অভিনয় করতে গিয়ে ওর চোখের পানি শুকিয়ে গিয়েছিল—সেইদিনই একবারে বের হলো সব।

আম্মু বলত—‘তোমাদের দুজনকে একসঙ্গে মানুষ করতে করতে আমার জীবনটা পানি হয়ে গেছে। ’ যাদের যমজ সন্তান আছে তারা জানে—দুজনকে একসঙ্গে বড় করা কতটা কঠিন। সেই আম্মুকে দেখলাম—কীভাবে নির্বাক হয়ে মুগ্ধর কপালে শেষ চুমু খেলো। চুমুর দৃশ্যটা দেখে মনে হচ্ছিল—এক মা কপালে চুমু দেয়, আর আরেক মা, যাকে আমরা ‘দেশ’ বলি—সে কপালে গুলি চালায়।

আজ এতটুকুই থাক। তারপর কীভাবে মুগ্ধকে কবর দেওয়া হলো? কীভাবে ৫ আগস্ট পর্যন্ত আমাদের ব্ল্যাঙ্ক চেক আর হুমকি-ধমকির মাধ্যমে কিনে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে—সেসব গল্প আরেকদিন বলব। যারা বাঁচে, তাদের দায় বেশি। কথা আছে—‘সত্য মরে না। ’ মুগ্ধর গল্পও শেষ হবে না—কারণ ওর স্বপ্নগুলো এখন আমাদের শ্বাসে বাঁচে।

এসআরএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।