ঢাকা, বুধবার, ৭ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৩ জুলাই ২০২৫, ২৭ মহররম ১৪৪৭

জাতীয়

উত্তরায় বিমান দুর্ঘটনা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে অপতথ্য: বাস্তবতা কী বলছে

রকিবুল সুলভ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২:০৭, জুলাই ২২, ২০২৫
উত্তরায় বিমান দুর্ঘটনা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে অপতথ্য: বাস্তবতা কী বলছে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিধ্বস্ত বিমানের ধ্বংসাবশেষ। ছবি: জিএম মুজিবুর

রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে প্রাণহানির যে ঘটনা ঘটেছে, তা গোটা দেশকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত অন্তত ৩১ জনের প্রাণহানির কথা সরকারিভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে।

আহত হয়েছেন দেড় শতাধিক, যাদের বড় অংশই শিশু শিক্ষার্থী।  

এই ভয়াবহ মানবিক ট্র্যাজেডির প্রেক্ষাপটে সরকারি পর্যায়ে উদ্ধারকাজ, চিকিৎসা সহায়তা, পরিচয় শনাক্তকরণসহ নানা দিক নিয়ে যখন সর্বোচ্চ প্রস্তুতি চলছে, তখনই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একের পর এক অপতথ্য, বিভ্রান্তিকর ছবি, মিথ্যা ভবিষ্যদ্বাণী, এআই-নির্মিত ভিডিও এবং ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ঘুরে বেড়াতে শুরু করেছে। এর সঙ্গে ছড়ায় ‘অ্যানোনিমাস মেইন পেজ’ নামে ফেসবুক পেজের একটি পোস্টও, যেখানে ‘দুর্ঘটনার ভবিষ্যদ্বাণী’ ছিল বলে বিভ্রান্তি ছড়ায় অনেকের মধ্যে। এই বিভ্রান্তিতে অনেকে ধোঁয়াশায় পড়েন, এটি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র বা সুপরিকল্পিত হামলা কি না।

সরকারি সংস্থা, গণমাধ্যম, স্বতন্ত্র ফ্যাক্টচেকাররা তথ্য যাচাই করে স্পষ্টভাবে জানাচ্ছেন, এসব প্রচার মূলত মিথ্যা, ভিত্তিহীন এবং উদ্দেশ্যমূলক। তবু এসব গুজব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করছে এবং দুর্ঘটনাজনিত শোককে রাজনৈতিক বা ষড়যন্ত্রমূলক রূপ দেওয়ার প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে।

দুর্ঘটনার দিনই একটি ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়, যাতে দেখা যায় একটি যুদ্ধবিমান একটি বিল্ডিংয়ে বিধ্বস্ত হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে আগুন ধরে যাচ্ছে এবং ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। ভিডিওর ক্যাপশনে দাবি করা হয়—এই ভিডিওটি ২১ জুলাই মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার মুহূর্তের দৃশ্য।  

রিউমর স্ক্যানার টিম ভিডিওটির উৎস অনুসন্ধান করে জানতে পারে যে, এটি কোনো সংবাদমাধ্যম, প্রত্যক্ষদর্শী, নিরাপত্তা ক্যামেরা বা মোবাইল ফোনে ধারণ করা বাস্তব ভিডিও নয়, বরং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) ব্যবহার করে তৈরি একটি ভুয়া ভিডিও।

গুগলের তৈরি ‘ভিইও’ নামের একটি এআই ভিডিও টুল দিয়ে ৮ সেকেন্ডের ওই ভিডিওটি তৈরি করা হয়েছে। এতে ভিডিওর নিচের ডানপাশে ‘ভিইও’ লেখা ওয়াটারমার্ক ও ‘এআই জেনারেটেড’ ট্যাগ দেখা গেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে—ভিডিওতে দেখা যাওয়া বিল্ডিংয়ে ‘ইউএনটিআইই কলেজ’ সদৃশ লেখা স্পষ্ট দেখা যায়।

অর্থাৎ এটি উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সঙ্গে কোনোভাবে সাযুজ্যপূর্ণ নয়। অর্থাৎ, ভিডিওটি একটি সম্পূর্ণ সাজানো দৃশ্য, যা একাধিক ব্যতিক্রমী অস্বাভাবিক ভিজ্যুয়াল ও গঠনগত বৈপরীত্য বহন করে।

দুর্ঘটনার দিনই ফেসবুকে আরেকটি পোস্ট ভাইরাল হয়, যেখানে একজন তরুণীর ছবি দিয়ে বলা হয়, তিনি একজন প্রশিক্ষিত পাইলট এবং এই বিমান বিধ্বস্তের ঘটনাকে ‘সুপরিকল্পিত একটি মিলিটারি-পি আর অপারেশন’ বলে উল্লেখ করেন। তিনি আরও বলেন, ‘এটি নিছক দুর্ঘটনা নয়, বরং জনগণের মনোযোগ অন্যদিকে ঘোরানোর কৌশল। ’ 

পরে ফ্যাক্টওয়াচ অনুসন্ধান করে জানতে পারে, এই তরুণীর নাম রোকেয়া দেশাই এবং তিনি একজন ভারতীয় নাগরিক। তিনি বাংলাদেশের এই বিমান দুর্ঘটনা সম্পর্কে কোথাও কোনো মন্তব্য করেননি। তার ছবি এবং পরিচয় ব্যবহার করে বাংলাদেশে গুজব ছড়ানো হয়েছে সম্পূর্ণ মিথ্যা দাবির ভিত্তিতে।

এ ছাড়া দুর্ঘটনার আগের দিন ‘অ্যানোনিমাস মেইন পেজ’ নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে একটি পোস্ট দেওয়া হয়, যাতে লেখা ছিল ‘একটি স্কুল ভবন ধসে পড়তে যাচ্ছে, বহু শিশু প্রাণ হারাবে। ’ দুর্ঘটনার পর ওই একই পেজ থেকে বাংলাদেশের বিমান দুর্ঘটনার ভিডিও শেয়ার করে বলা হয়—‘আমরা সবসময় আগেভাগেই সতর্কবার্তা পাঠাই। ’

এই পোস্ট দুইটি দেখে অনেকেই দাবি করতে শুরু করেন, অ্যানোনিমাস গ্রুপ আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল এবং এটি নিছক দুর্ঘটনা নয়, বরং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র বা সুপরিকল্পিত হামলা হতে পারে।

কিন্তু বিশ্লেষক ও ফ্যাক্ট-চেকার কদরুদ্দিন শিশির জানিয়েছেন, এই পেজের কোনো সম্পর্ক নেই প্রকৃত ‘অ্যানোনিমাস হ্যাকার গ্রুপের’ সঙ্গে। তাদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে যে ফেসবুক পেজ উল্লেখ আছে, এটি সেই পেজ নয়। বরং এই ভেরিফায়েড পেজটি মূলত একটি অনলাইন জুয়ার প্ল্যাটফর্ম, যারা বিভিন্ন সময়ে গেমিং ও জুয়াবিষয়ক পোস্ট করে থাকে এবং নতুন সদস্য সংগ্রহ করে।

তিনি আরও জানান, এই পেজের ট্রান্সপারেন্সি বা পরিচালনাগত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এটি পরিচালিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই, নাইজেরিয়া এবং একটি অনির্দিষ্ট দেশ থেকে। ভাইরাল হওয়ার পর পেজটির অ্যাডমিন সংক্রান্ত তথ্য তারা গোপন করে দেয়, যা থেকে প্রতীয়মান হয় এটি একটি স্ক্যামার চক্র দ্বারা পরিচালিত পেজ এবং এর সঙ্গে নাইজেরিয়ান অনলাইন জুয়াড়িদের সম্পৃক্ততা থাকতে পারে।

এই অপপ্রচারের আরেকটি চিত্র পাওয়া যায় ‘মতিউর রহমান’ নামের একটি ফেসবুক ব্যবহারকারীর পোস্টে। তিনি একটি স্ক্রিনশটে লেখেন, ‘বিমান বিধ্বস্ত হবে, শতাধিক শিশু আহত হবে..’ এবং তা ভাইরাল হয় ‘আগাম ভবিষ্যদ্বাণী’ হিসেবে।

রিউমর স্ক্যানার অনুসন্ধানে নিশ্চিত হয়, এই পোস্টটি প্রথম দেওয়া হয় ১৮ জুলাই রাত ২টা ১০ মিনিটে, যেখানে লেখা ছিল ‘০১৯৬৭৬৫৭৫১৫ ১৭ জুলাই’। এরপর ২১ জুলাই দুর্ঘটনার পর একাধিকবার ওই একই পোস্ট এডিট করে বিমান বিধ্বস্ত, শতাধিক আহত, মাইলস্টোন হামলা পরিকল্পিত ইত্যাদি বার্তা যুক্ত করা হয়।

অর্থাৎ, ঘটনাপূর্ব কোনো ভবিষ্যদ্বাণী ছিল না, বরং দুর্ঘটনার পর আগের পোস্ট এডিট করে মিথ্যা প্রচার চালানো হয়।

এ ছাড়া, দুর্ঘটনায় আহত শিশুর ছবি দাবি করে একটি ছবি ছড়ানো হয়, যেখানে দেখা যায়, দুটি ধুলো-মলিন শিশু হাসপাতালের স্ট্রেচারে বসে আছে। ক্যাপশনে লেখা, ‘এটা গাজা নয়, বাংলাদেশের দৃশ্য। ’

ফ্যাক্টচেকে দেখা যায়, ছবিটি আসলে গাজার আল-শিফা হাসপাতালে তোলা, ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে ইসরায়েলি হামলায় আহত শিশুদের ছবি। নিউ ইয়র্ক টাইমস ও আইরিশ টাইমসসহ একাধিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ছবিটি সে সময় ব্যবহার করা হয়েছিল।

এই মর্মান্তিক মানবিক বিপর্যয়কে ঘিরে যে ধরনের গুজব, অপপ্রচার, বিভ্রান্তি ও ফেক কনটেন্ট ছড়ানো হয়েছে, তা শুধু দুর্ঘটনার শিকার পরিবার নয়—গোটা সমাজের মানসিক শান্তি ও তথ্যের উপর আস্থা নষ্ট করে দেয়।

সরকারি পর্যায় থেকে এরইমধ্যে বলা হয়েছে, হতাহতের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুতের কাজ চলছে, শনাক্ত না হওয়া মরদেহের ডিএনএ টেস্ট করা হচ্ছে এবং আহতদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

এছাড়া, মাইলস্টোন ট্র্যাজেডিতে হতাহতের সংখ্যা নিয়েও বিভিন্ন ফেসবুক আইডি ও পেজে নানা তথ্য ছড়ায়। বিশেষ করে পতিত আওয়ামী লীগ ও তাদের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্লাটফর্মে ‘অনেক লাশ লুকানো’র গুজবও ছড়ানো হয়।

সংশ্লিষ্টদের মতে, যেভাবে লাশ গুমের দাবি করা হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে তা সম্ভব হওয়ার নয়। কারণ কোনো অভিভাবক তার সন্তান বা স্বজনকে না পেলে (জীবিত বা মৃত) এরই মধ্যে গণমাধ্যমসহ নানা মাধ্যমে তা প্রকাশ করে দেওয়ার কথা।

গুজব, অপতথ্যের ভয়াবহতা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারও বিবৃতি দিয়েছে। তারা বলেছেন, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার চলছে।

মঙ্গলবার সকালে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম তার ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে দেওয়া এক পোস্টে বলেন, ‘রাজধানীর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতদের প্রত্যেকের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সবধরনের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। নিহতদের পরিচয় নিশ্চিত করতে তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। যেসব মরদেহ শনাক্ত করা যাচ্ছে না, সেগুলো ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে সনাক্ত করা হচ্ছে। পাশাপাশি, ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ’

পোস্টে আরও বলা হয়, ‘আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, কিছু মহল ‘হতাহতের সংখ্যা গোপন করা হচ্ছে’ এমন অভিযোগ তুলে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াচ্ছে। এটি সম্পূর্ণ অসত্য এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এই মর্মান্তিক ঘটনায় আহত ও নিহতদের নির্ভুল তালিকা প্রস্তুতের জন্য বাংলাদেশ সরকার, সেনাবাহিনী প্রশাসন, বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং হাসপাতাল প্রশাসন একযোগে কাজ করছে। ’

তিনি আরও জানান, দুর্ঘটনার পর থেকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির একটি কন্ট্রোল রুম চালু করা হয়েছে, যেখানে স্বজনদের খোঁজ নিতে যোগাযোগ করার জন্য বলা হচ্ছে। একই সঙ্গে বিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রেশন খাতা ও অন্যান্য নথিপত্র ঘেঁটে খতিয়ে দেখা হচ্ছে, এখনো কেউ নিখোঁজ রয়েছেন কি না।

শফিকুল আলম সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘যদি কারও পরিচিত কেউ এই ঘটনায় নিখোঁজ থাকেন, তাহলে অনতিবিলম্বে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। গুজব বা বিভ্রান্তিকর তথ্য না ছড়িয়ে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা করুন। ’

আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।