ঢাকা, শনিবার, ১৮ শ্রাবণ ১৪৩২, ০২ আগস্ট ২০২৫, ০৭ সফর ১৪৪৭

জাতীয়

জুলাই শহীদ আব্দুল্লাহর মায়ের অন্তহীন লড়াই

ডিএইচ বাদল, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮:২৩, আগস্ট ২, ২০২৫
জুলাই শহীদ আব্দুল্লাহর মায়ের অন্তহীন লড়াই জুলাই শহীদ আব্দুল্লাহ বিন জাহিদের ছবি হাতে মা ফাতেমাতুজ জোহরা। ছবি: বাংলানিউজ

ঢাকার শহীদ রমীজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের ছাত্র আব্দুল্লাহ বিন জাহিদ। ফ্যাসিস্ট শাসক শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের চূড়ান্ত লগ্নে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন।

সেই থেকে শুরু হলো তার মা ফাতেমাতুজ জোহরার অন্তহীন শোক আর লড়াইয়ের পথচলা।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানের ফাঁকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বাংলানিউজকে বলছিলেন একেবারে অসহায় হয়ে পড়ার কাহিনি। তার দুই ছেলে। বড় ছেলে আব্দুল্লাহর বয়স ছিল ১৬, ছোট ছেলে জিসান ১৪ বছর বয়সে পা রাখছে। ২০২৪ সালের ১৮ মার্চ ব্রেইন স্ট্রোক করে মারা যান তার স্বামী। সেই শোকের পাহাড় বয়ে যখন পথ এগোচ্ছিলেন, জুলাই অভ্যুত্থানে হারালেন বড় ছেলেকে। এই বুকের ধন হারানোর বেদনার মধ্যেই তার ওপর নেমে আসে আরেক মহাবিপদ—১৫ দিনের মাথায় ১৯ আগস্ট জিসানের দেহে ধরা পড়ে কোলন ক্যানসার। তাও থার্ড স্টেজে।

তার মাথার ওপর যেন আকাশ ভেঙে পড়ার  মতো অবস্থা। এক হাতে শহীদ বড় সন্তানের স্মৃতি, অন্য হাতে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়া ছোট্ট সন্তানের চিকিৎসার ভার।

“একটা মা হিসেবে আমি বুঝি, আল্লাহর দেওয়া সবচেয়ে প্রিয় ধন যখন দু’টোই চলে যায় বা চলে যাওয়ার পথে থাকে, তখন কেমন লাগে। একটা তো আল্লাহ নিয়ে গেছেন, আরেকটাকে নিয়ে আমি হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল দৌঁড়াই। বড় ছেলেটা শহীদ হলো, আর ছোটটার জীবন বাঁচাতে প্রতিদিন যুদ্ধ করি,”—কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিলেন ফাতেমাতুজ জোহরা।

কিশোর জিসানকে প্রথমে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় অর্থাৎ পিজি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিলেও পরে আশাহত হন ফাতেমা।

তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “আমার জিসানের চিকিৎসা সেবা পেতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে আব্দুল্লাহর কলেজের প্রিন্সিপাল। উনি আমাকে যখন বলেছেন, জিসানের পিজিতে অনেক কষ্ট হচ্ছে, কারণ প্রতিদিন লাশ বের হচ্ছে। এতটুকু ছোট ছেলে, সে সহ্য করতে পারতেছে না। উনি অনেক ছোটাছুটি করে আমার ছেলের সিএমএইচে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। ওনার কাছে আমি চির কৃতজ্ঞ, জিসানের ট্রিটমেন্টের রাস্তা তৈরি করে দেওয়ার জন্য। ”

“আমি সচিবালয়ে স্বাস্থ্য উপদেষ্টার কাছে গেছি, চার-পাঁচ ঘণ্টা বসে থেকেছি। আমার ছেলের সার্জারি বিদেশে হলে ভালো হয় বলেছিলাম। কিন্তু আমাকে বলা হলো, আপনার ছেলে এ সুবিধা পাবে না। পরে বলা হলো, সিএমএইচের যাবতীয় খরচ তারা দেবে। কয়েকদিন পর বললো, ‘সিএমএইচের সঙ্গে যোগাযোগ নেই, আমরা পারব না’। আমার মনে হলো—আমরা সাধারণ মানুষ সরকারের কাছে কিছুই না। ”

গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম সংগঠক ও বর্তমানে জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা সারজিস আলমের সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “আগস্টের শেষদিকে উত্তরার একটা অনুষ্ঠানে সারজিসের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় এবং শুনে যে আমার এই অবস্থা। তারপর আমার বাসায় এসে জিসানকে দেখে যায় এবং আমাকে কমিটমেন্ট করে সারজিস বলে, ‘আন্টি, আমি আপনার বড় ছেলে। জিসানের জন্য যতদূর করা লাগে, আমি করব। ’ ও পারসোনাল মোবাইল নাম্বার আমাকে দিয়ে যায়। এরপর বিগত এক বছরে সারজিসের সঙ্গে আমার চার থেকে পাঁচ বার দেখা হয়েছে। সারজিসকে আমি অনেক রিকোয়েস্ট করছি, ‘আমার জিসানের জন্য কিছু করো’। কারণ একটা ক্যানসার রোগীর ট্রিটমেন্টে কী পরিমাণের খরচ, সেই ভুক্তভোগী জানে। আর আমার পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ ছিল না। ”

“আমার বড় ছেলেটা মারা গেছে, আমি ওর শোক পালন করব নাকি আমার ছোট ছেলেকে নিয়ে দৌঁড়াব। একটা মায়ের জন্য এই রাস্তাটা যে কী কঠিন, শুধু সেই বোঝে। ”

শহীদ জননী ফাতেমাতুজ জোহরা বলেন, “আমার এই ঘটনায় ‘আমরা বিএনপির পরিবার’র পক্ষ থেকে সম্পূর্ণ সাহায্য পাই। এই ১৩ বছরের বাচ্চাটার বিগত দুই মাসে দুইটা বড় বড় সার্জারি হয়েছে। এটা সম্পূর্ণ আমরা বিএনপির পরিবারের পক্ষ থেকে তারেক রহমান স্যার দিয়েছেন। আমি ওনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ। শহীদ আব্দুল্লাহর কলেজের প্রিন্সিপাল থেকে শুরু করে বিএনপি নেতা তারেক রহমানসহ অনেকেই পাশে দাঁড়ান। তাদের অর্থায়নেই জিসানের দুটি বড় সার্জারি হয়, চলছে কেমো ও রেডিওথেরাপি। এই কথাগুলো আমি বলাতে কেউ যদি বলে বিএনপির পক্ষ নিয়ে কথা বলি, আমি সরি, কারণ আমি ওদের টাকা দিয়ে আমার ছেলের ট্রিটমেন্ট করিয়েছি। কিন্তু এই সরকার বলতে পারবেন না, তারা আমার অসুস্থ সন্তানকে একটা টাকাও সাহায্য করেছে। এই হাসনাত, সারজিস ও এনসিপি আজ পর্যন্ত যোগাযোগই করেনি, সাহায্য তো পরের হিসাব। ”

শহীদ আব্দুল্লাহর জন্মদিন ছিল ১ নভেম্বর, সে কথা স্মরণ করে ফাতেমা বলেন, “সে তো আর নেই,  খালি ঘর, খালি বুক, আর হাসপাতালের দৌড়ঝাঁপ। ”

অস্ত্রোপচারের সময় শিশু জিসানের পাকস্থলীটা কেটে গেছে উল্লেখ করে ফাতেমা বলেন, “সেকেন্ড অপারেশনের তিন দিন পরে ওকে যখন বেডে দেওয়া হয়, ও শুধু আমাকে বলে, ‘আম্মু, আমি আর নিতে পারছি না, আমাকে এবার মাফ করে দেন। ’ একজন মায়ের জন্য এই বাক্য শোনার যন্ত্রণা কতটা কষ্টের তা বর্ণনাতীত। ”

ফাতেমাতুজ জোহরা অভিযোগ করে বলেন, “যেই শহীদদের রক্তের বিনিময়ে তারা দাঁড়িয়ে আছে, তাদেরই এখন ভুলে যায়, ভবিষ্যতে তারা আর আমাদের কি মনে রাখবে? এই উপদেষ্টারা, প্রধান উপদেষ্টার কি উচিত ছিল না এসব শহীদ ফ্যামিলিকে ডেকে কথা বলা, কার কী সুবিধা অসুবিধা আছে? আমরা কি তাদের কাছে এতটুকু পাই না? আমাদের ভাগ্যে কি শুধু শোক আর অবহেলা?”

ডিএইচবি/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।