সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহালের প্রতিবাদে ২০২৪ সালে জুনে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করার দেড় মাসের মাথায় সেটি ঘিরে সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে শুরু করে। ১৮ জুলাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে এলে আন্দোলনে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়।
তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ ও গুলির ঘটনায় ঢাকার বাড্ডা, রামপুরা, উত্তরা, যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকা রীতিমত রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
সেদিন সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক । তিনি বলেন, ‘সকাল থেকেই আহতরা আসছিলেন, কিন্তু দুপুরের পর তাদের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। ’
প্রাথমিকভাবে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসকরাই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু আহত রোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকায় অন্য বিভাগের চিকিৎসকরা একপর্যায়ে তাদের সঙ্গে যুক্ত হন। চিকিৎসক মাহমুদ বলেন, তখন রোগীর চাপ এতটাই বেড়ে গিয়েছিল ছিল যে, হাসপাতালের সাধারণ রোগীদের দেখার ফুরসত ছিল না বললেই চলে।
পর দিন সহিংসতা আরও তীব্র আকার ধারণ করে। তখন কেবল ঢাকার হাসপাতালগুলো থেকে থেকে নয়, বরং সারা দেশ থেকেই সহিংসতায় হতাহতদের পাঠানো হতে থাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ফলে সেখানকার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নেয়।
সালেহ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, একের পর এক আহতদের আনা হচ্ছে। লাশ আসছে। আহতরা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। স্বজনদের কান্নাকাটি। এক কথায় ভয়াবহ পরিস্থিতি। আমরা ডাক্তার-নার্সরা দিন-রাত কাজ করে কূল-কিনারা পাচ্ছিলাম না। চব্বিশ ঘণ্টা হাসপাতালেই থাকতে হচ্ছিল।
হতাহতদের মধ্যে সেসময় যাদের হাসপাতালটিতে আনা হয়েছিল, তাদের বেশিরভাগই গুলিবিদ্ধ ছিল বলে জানান এই চিকিৎসক। তিনি বলেন, ‘পায়ের নখ থেকে মাথা পর্যন্ত সবখানে, এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে গুলি নিয়ে রোগী আসেনি। ’
‘কারো হাত নাই, কারো পা নাই, আঙুল নাই। পুরা বুক-পিটের ভেতর দিয়ে ফুসফুসে গিয়ে লেগেছে। চোখের সামনে মারা গেছে। কারো কারো পা পর্যন্ত কেটে পড়ে গেছে গুলির আঘাতে,’ বলছিলেন জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসা দেওয়া এই চিকিৎসক।
তখন হাসপাতালে পুলিশের কড়া পাহারা দেখা গিয়েছিল। আহতদের মধ্যে যারা চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, তাদের বিষয়েও তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছিল। ‘তখন আহতদের ফিঙ্গার প্রিন্ট নিয়ে একটা রেজিস্ট্রেশন করা হচ্ছিল, যা আগে আমরা কখনোই দেখিনি। এতে রোগীদের অনেকেই ভয়ে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যান,’ বলেন চিকিৎসক মাহমুদ।
ঢাকার বেসরকারি হাসপাতালগুলো থেকেও একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা জানা যায়। ঢাকার বনশ্রী এলাকায় অবস্থিত ফরাজী হাসপাতাল লিমিটেডের উপ-মহাব্যবস্থাপক রুবেল হোসাইন বলেন, আন্দোলন চলাকালে আমরা এক হাজারেরও বেশি আহত মানুষকে চিকিৎসা দিয়েছি। তাদের বেশিরভাগেই ছিল গুলিবিদ্ধ। ’
‘এর মধ্যে রাবার ও ছররা বুলেটে আহত যেন ছিল, তেমনি ছিল সরাসরি বুলেট। আহতদের কেউ কেউ এমন কথাও বলেছে যে একই বুলেট পরপর তিনজনের শরীর ভেদ হতে তারা দেখেছেন। ’
১৮ জুলাই সকালে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বাড্ডা-রামপুরা এলাকায় গুলি ছুড়তে শুরু করে। এতে অনেকেই হতাহত হন, যা আন্দোলনকারীদের আরও ক্ষুব্ধ করে তোলে। একপর্যায়ে আগুন দেওয়া হয় রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম বিটিভিতে।
সংঘর্ষে হতাহতদের একটি বড় অংশকেই তখন তাৎক্ষণিকভাবে নেওয়া হয় বনশ্রীর ফরাজী হাসপাতালে। কিন্তু হাসপাতালটির জরুরি বিভাগে তখন চিকিৎসক ছিলেন মাত্র একজন। ফলে পরিস্থিতি সামাল দিতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়েছিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। রুবেল হোসাইন বলেন, প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর গত এক যুগে আমরা আগে কখনো এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হইনি। ’
সংঘর্ষ-সহিংসতার মধ্যেই সারাদেশে ধর-পাকড় চালাতে শুরু করে পুলিশ। আহত আন্দোলনকারীদের ধরতে একপর্যায়ে বনশ্রীর এই হাসপাতালটিতেও অভিযান চালানোর ঘটনা ঘটেছিল।
‘২৩ থেকে ২৪শে জুলাই রাতে ২০ থেকে ২৫ জন সাদা পোশাকে আমাদের এখানে আসে। তারা কীভাবে খবর পেয়েছে যে আমাদের এখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহতরা ভর্তি। তারা পুরো হাসপাতালের প্রত্যেকটা ওয়ার্ড ও কেবিনে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু আমরা বলি যে কেউ ভর্তি নেই। বুঝায়ে-শুনায়ে ম্যানেজ করি,’ বলেন ফরাজী হাসপাতালের উপ-মহাব্যবস্থাপক।
পরে ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে ফোন দিয়ে হতাহতদের বিষয়ে তথ্য চাওয়া হয় বলেও জানান এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘তখন আমি নিজ থেকে বললাম, স্যার আসলে আমরা তো নাম-ডাটা এন্ট্রি করতে পারিনি। কারণ তখন এত বেশি আহত আসছে, তাদের কারো নাম জিজ্ঞাসা করার মতো পরিস্থিতি ছিল না। ’
জুলাই আন্দোলনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট ছিল উত্তরা। মধ্য জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সময়ের মধ্যে সেখানে দফায় দফায় সংঘর্ষ ও গুলিতে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে। সেসময় আহতদের মধ্যের বড় একটি অংশকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘তখন আমাদের কাছে একটি লাশ আসে, যার নাম-ঠিকানা পাওয়া যাচ্ছিল না। পরিচয় শনাক্ত করতে না পেরে একপর্যায়ে উত্তরা পশ্চিম থানায় যোগাযোগ করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তখন তারা বলেছিল, একটু অপেক্ষা করে দেখেন কেউ খোঁজ করতে আসে কি না। ’
কিন্তু সারা রাত অপেক্ষার পরেও কেউ ওই মরদেহের সন্ধান না করায় পরদিন সকালে দ্বিতীয় দফায় পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তারা। এই কর্মকর্তা জানান, পুলিশ জানিয়ে দেয় যে, তারা আসতে পারবে না। লাশ কী করা হবে— জানতে চাইলে পুলিশ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলে।
মরদেহটি দাফনের জন্য দাতব্য প্রতিষ্ঠান আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামকে খবর দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সেখানেও বাধে বিপত্তি। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, পুলিশি কাগজপত্র ছাড়া তারা মরদেহ দাফন করতে পারবে না। ফলে আবারও থানায় যোগাযোগ করেন হাসপাতালের কর্মকর্তারা।
‘তখন আমি একটা চিঠি লিখে আমাদের সিকিউরিটি ইনচার্জকে দিয়ে থানায় পাঠিয়েছিলাম, কিন্তু তারা সেটি নেয়নি। উল্টো এমনও বলেছে যে— আপনি চলে যান, না হলে বিপদে পড়বেন,’ বলেন হাসপাতালটির পরিচালক।
পুলিশি তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় আহত আন্দোলনকারীদের বড় অংশের মধ্যেই তখন হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার ব্যাপারে এক ধরনের ভয় এবং অনীহা দেখা করা যাচ্ছিল। পাশাপাশি আকস্মিকভাবে রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় অনেক হাসপাতালে চিকিৎসা পাওয়াও কঠিন হয়ে পড়েছিল।
ঠিক এমন পরিস্থিতিতে আহত আন্দোলনকারীদের চিকিৎসায় বাড়ির দরজা খুলে দেন ধানমন্ডির দুই তরুণ চিকিৎসক। ভবনের নিচতলার গ্যারেজ তখন পরিণত হয় অস্থায়ী হাসপাতালে। যাদের নেতৃত্বে তখন অস্থায়ী হাসপাতালটি গড়ে উঠেছিল, তাদেরই একজন চিকিৎসক হৃতিশা আক্তার মিথেন। তিনি বলছিলেন, কেন এবং কীভাবে সেসময় বাড়িতেই চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু করেছিলেন তারা।
‘বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি যে অনেক স্টুডেন্ট আহত অবস্থায় আছে। গা (শরীর) থেকে রক্ত ঝরছে, মানসিকভাবে ট্রমাটাইজড। তারা পানি, খাবার, আশ্রয় চাইছিল,’ বলছিলেন মিথেন। আহতদের এমন আকুতি দেখে নিচে নেমে গিয়ে বাড়ির দরজা খুলে দেন তিনি।
‘আসলে আমার যে পেশা, সেই দায়বদ্ধতা থেকে আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনি। আমার সঙ্গে আমাদের ভবনের আরেকটা ডাক্তার ছিলেন অর্থী আপু। আমরা দুজনে মিলেই চিকিৎসা দেওয়া শুরু করি। ’ পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে ভবনের গ্যারেজে চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু করেন তারা।
‘সেখানে দারোয়ান ও গার্ডদের ব্যবহৃত একটি বেড ছিল, যেটা একটু আড়ালে। সেজন্য সেখানে শুরু করি’ বলছিলেন তরুণ এই চিকিৎসক। শুরুতে নিজেদের কাছে যতটুকু ওষুধপত্র ছিল সেগুলো দিয়েই চিকিৎসা চালিয়ে যান মিথেনরা।
‘পরদিন সামনের একটি ফার্মেসি দোকান খুলিয়ে আমার মা প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র নিয়ে আসেন। এ ছাড়া আমাদের ভবনের অন্য বাসিন্দারাও অনেক সাহায্য করেন,’ বলেন তিনি। কিন্তু গ্যারেজে চিকিৎসা দেওয়ার এই খবর দ্রুতই আশেপাশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। একপর্যায়ে পুলিশও ঘটনাটি টের পেয়ে যায়। এরপর ওই গ্যারেজটি হয়ে ওঠে হামলা লক্ষ্যবস্তু।
‘আমাদের সিকিউরিটি গার্ডকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে, কারা এই দুজন চিকিৎসক যারা আহতদের চিকিৎসা দিচ্ছে। ১৯ জুলাই তো আমাদের গ্যারেজ লক্ষ্য করে টিয়ারশেল মারা হয়,’ বলেন মিথেন। কিন্তু তারপরও দমে যাননি তারা।
‘ওইটা (টিয়ারশেল নিক্ষেপের ঘটনা) ছিল একটা শকিং ট্রমা যে এইটা কী হইছে! তারপরে আই ওয়াজ লাইক- যা হওয়ার হবে,’ বলেন মিথেন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু সেসময় আহতদের যারা চিকিৎসা দিয়েছিলেন, জুলাই তাদের স্মৃতিতে এখনো প্রবলভাবে রয়ে গেছে।
বিবিসি বাংলা অবলম্বনে
আরএইচ