সিলেটের পর্যটনকেন্দ্রগুলোয় পাথরচুরি কার্যত মহামারির রূপ নিয়েছে। ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর আর জাফলংয়ের বালু–পাথর দখলের তাণ্ডব যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে, ঠিক তখনই নতুন করে ক্ষতের দাগ পড়ছে জৈন্তাপুরের ভারত সীমান্তঘেঁষা রাংপানিতে।
সিলেটের জৈন্তাপুর সীমান্তঘেঁষা রাংপানির মতোই আশপাশের নদীঘেঁষা শ্রীপুর কোয়ারি, আদর্শগ্রাম, খড়মপুর ও বাংলাবাজার ঘাট থেকেও অব্যাহত রয়েছে পাথর উত্তোলন। ৫ আগস্টের আগে থেকে শুরু হওয়া এই লুটপাট এখনো থামেনি।
সরেজমিনে দেখা যায়, শ্রীপুর এলাকা দিয়ে পাথর উত্তোলনকারীরা যাতায়াত করছে রাংপানির মধ্য দিয়েই। সেই পথেই রয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ক্যাম্প, ওপারে ভারতের সীমানা। চিকেন নেকের মতো দুর্গম এই পথেই দাপটের সঙ্গে চলছে পাথর লুট। সাংবাদিকদের উপস্থিতি টের পেয়ে নদীপথে নৌকাযোগে টহল আসা বিজিবির সদস্যরা হুইসেল বাজালে কিছুক্ষণের জন্য পাথরখেকোরা আড়ালে যায়, তারপর আবার শুরু হয় লুটপাটের মহোৎসব। বড় বড় গর্ত করে তুলে নেওয়া হচ্ছে বিশাল পাথরও।
স্থানীয়দের অভিযোগ, গত বছরের ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত শ্রীপুরের রাংপানিসহ চারটি পাথর কোয়ারিতে লুটপাট চালাতেন উপজেলা আওয়ামী লীগের ৩ নম্বর সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক রাজা। এ কাজে তাকে সহযোগিতা করতেন পলাতক উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত আলীর ভাই ও জৈন্তাপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৭ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য ইসমাইল আলী। আরও কয়েকজন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাও এতে জড়িত ছিলেন। তবে পরিস্থিতি পাল্টে যাওয়ার পর এসব নেতা আত্মগোপনে চলে যান। এর পর শ্রীপুর কোয়ারির নিয়ন্ত্রণে আসেন জৈন্তাপুর উপজেলা বিএনপির সহ-সভাপতি আব্দুল আহাদ, যিনি আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক রাজার ভগ্নিপতি।
তারা আরও জানান, জৈন্তাপুর উপজেলা বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি আব্দুল আহাদ ৫ আগস্টের পর থেকে শ্রীপুর পাথর কোয়ারির ‘কিং’ হিসেবে নিয়ন্ত্রণ নেন। এর আগে এই কোয়ারির নিয়ন্ত্রণে ছিলেন তার শ্যালক উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক রাজা। বর্তমানে রাজা পলাতক। তার সঙ্গে মানিকও আত্মগোপনে রয়েছেন। স্থানীয়দের অভিযোগ, রাজা ও মানিকের নেতৃত্বেই কোয়ারিতে লুটপাট চলত। কার্যত তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, কথা বলতেও সাহস পেত না।
অভিযোগ প্রসঙ্গে আব্দুল আহাদ বলেন, আব্দুর রাজ্জাক রাজা আমার আত্মীয়, তবে তিনি এখন পলাতক। বর্তমানে শ্রীপুর পাথর কোয়ারির সভাপতি আমিই। সবাই আমাকে ভোট দিয়ে এ দায়িত্ব দিয়েছে। কমিটিতে সেক্রেটারি হিসেবে আছেন ইউনিয়ন বিএনপি নেতা রফিক আহমদ।
তিনি আরও জানান, আদর্শগ্রাম পাথর কোয়ারির সভাপতি ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা মানিক এবং সেক্রেটারি কয়েছসহ আরও অনেকে, যারা বর্তমানে আত্মগোপনে আছেন। ওই এলাকায় যুবদল নেতা শাহজাহান সক্রিয় আছেন, পাশাপাশি নেপথ্যে রয়েছেন আব্দুর রাজ্জাক রাজাও।
নিজেকে পাথর লুটে জড়িত নয় দাবি করে আব্দুল আহাদ বলেন, রাংপানির পাথর লুটে জড়িত নজরুল, সাবেক চেয়ারম্যান আলমগীর, শংকর ঘাটের সোহেল এবং কুইট্টারঘাটের শ্রমিক নেতা মহসীন। শংকর ঘাট পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করছে সোহেল। আর কুইট্টারঘাট নিয়ন্ত্রণ করছেন জেলা শ্রমিক ফেডারেশনের নেতা, জেলা ট্রাক–পিকআপ–কাভার্ড ভ্যান সমিতির নেতা এবং বিএনপি রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত মো. মহসীন।
নিজেকে নির্দোষ দাবি করে তিনি আরও বলেন, আমি সব সময়ই পাথর লুটের ব্যাপারে জিরো টলারেন্সে আছি। করমপুর কোয়ারির কমিটিতে রয়েছেন উপজেলা যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক প্রার্থী দিলদার হোসেন এবং ইউনিয়ন জামায়াতের আমীর নুরুল ইসলাম। আমরা কেউই কখনো পাথর উত্তোলনে জড়িত নই, বরং সব সময় বিরোধী অবস্থান নিয়েছি।
পাথর লুটে নিজের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে ২ নম্বর জৈন্তাপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও বিএনপির সহসভাপতি আলমগীর হোসেন বলেন, কোয়ারি পাথরের সঙ্গে আমি নেই। আহাদ সাহেব কোয়ারির সভাপতি হিসেবে আছেন। আমার শুধু একটি ক্রাশার মিল ছিল।
তার দাবি, প্রশাসন সুযোগ না দিলে পাথর তোলার কোনো সুযোগই নেই। তিনি বলেন, যাতায়াতের রাস্তা একটাই, এখানে বিজিবি ক্যাম্প ও পুলিশ রয়েছে। প্রশাসন ইঙ্গিত দিলেই শ্রমিকরা পাথর তুলতে যায়। খাসিয়া পল্লীর লোকেরাও গর্ত করে পাথর বিক্রি করে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
ইউনিয়ন জামায়াতের আমীর নুরুল ইসলামও অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, একসময় ব্যবসা ছিল, এখন নেই। কেউ প্রমাণ দিতে পারলে শাস্তি মাথা পেতে নেবো।
যুবদল নেতা দিলদার হোসেনও প্রতিহিংসাবশত তার নাম টানা হচ্ছে বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, মানুষ যদি আমার কথা বলে, তাহলে ইচ্ছে মতো আমার বিরুদ্ধে নিউজ করেন। আমি তামাবিলে কয়লা-পাথরের ব্যবসা করি। পাথর লুটের বিষয়ে আমি জিরো টলারেন্সে নীতি মেনে চলি।
আব্দুর রাজ্জাক রাজা ও আওয়ামী লীগ নেতা মানিক পলাতক থাকায় তাদের বক্তব্য নেওয়া যায়নি।
গত রোববার বাংলানিউজে ‘রাংপানির পাথরও খাচ্ছে পাথরখেকোরা’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনের পর নড়েচড়ে বসেছে উপজেলা প্রশাসন। সংবাদ প্রকাশের পরপরই অবৈধ পাথর ও বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়।
জৈন্তাপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ফারজানা আক্তার লাবনী বাংলানিউজকে জানান, সোমবার রাংপানি এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৩৫ ট্রাক বালু ও একটি ক্রাশার মিল থেকে সাড়ে ৯ হাজার ঘনফুট পাথর জব্দ করা হয়। পরে জব্দকৃত বালুগুলো তাৎক্ষণিক নিলামে বিক্রি করে ৯০ হাজার টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও জানান, এরই ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবারও (১৯ আগস্ট) রাংপানি এলাকায় অভিযান চালানো হয়। এদিন ২০ হাজার ঘনফুট পাথর ও ২৮ হাজার ঘনফুট বালু জব্দ করা হয়েছে। একইসঙ্গে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নিয়মিত মামলা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. আনোয়ার উজ জামান বাংলানিউজকে বলেন, রাংপানি পর্যটনকেন্দ্রে পাথর লুটপাটের বিষয়ে আমরা অবগত। এ ঘটনায় শিগগিরই অভিযান চালানো হবে।
এনইউ/এমজে