ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

আখাউড়ার মাদক আখড়ায়

ওপার থেকে আসে, এপারের ঘরে ঘরে বিকোয়

রহমান মাসুদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০১৫
ওপার থেকে আসে, এপারের ঘরে ঘরে বিকোয় ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

আখাউড়া সীমান্ত থেকে ফিরে: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দরের সীমানা যেখানে শেষ, সেখানেই ২০২৩ নম্বর সীমান্ত পিলার। এ পিলারের ওপারে ভারতীয় চেকপোস্ট থেকে শুরু সেভেন সিস্টারের অন্যতম ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলার সীমানা।

ভারতীয় চেকপোস্টের পেছন দিয়ে ভাটির দেশ বাংলাদেশের সীমান্তে প্রবেশ করেছে একটি খাল। তার পানি কালো, দুর্গন্ধময়।

খালের কালো পানিতে চোখে পড়ে ফেনসিডিল ও নানা ব্র্যান্ডের মদের বোতল। এটি মাদকে সয়লাব আখাউড়া সীমান্ত এলাকার একটি নমুনামাত্র।  

ওপারের ইন্দিরা গান্ধী মেমোরিয়াল হাসপাতাল ও আগরতলা শহরের বর্জ্য নেমে আসছে এপারের ভূখণ্ডে। এ নালার দুই পাশেই বাংলাদেশি কাস্টমস, ইমিগ্রেশন, পুলিশ, বিজিবি ও আমদানি-রফতানিকারকদের অফিস।  

আখাউড়া শহরের দিকে একটু এগিয়ে ডানে মোড় নিলে বিস্তীর্ণ গ্রামীণ জনপদ। রাস্তার দুই পাশে সারি সারি লিচু, জলপাই আর পেয়ারার বাগান।

ভারতীয় কাটাতারের বেড়ার বাধা পার হয়ে এপারে ঢোকে মাদক আর এসব বাগান, পায়ে হাঁটা পথ বা খাল পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশে। বাংলাদেশি ভূখণ্ডের ঘরে ঘরে এরপর চলে সর্বনাশা নেশাদ্রব্য সেবন বা বিকি-কিনির আসর। সীমান্ত ঘেঁষা এলাকার এই আখড়াগুলোতে বাইরে থেকে যারা আসেন তারা হয় মাদক সেবনে অথবা কিনতেই আসেন।  

বহনকারী অটোরিকশাচালক মজনু মিয়া পর্যন্ত তাই জানতে চান, ‘কি মাল খাবেন?’ কি কি পাওয়া যাবে, জানতে চাইলে তার সরল উত্তর, ‘সব। ফেন্সি, বোতল, বিয়ার, হুইস্কি, সব’। কোথায় পাওয়া যায়?- প্রশ্নের জবাব দিলেন, ‘এখানকার প্রায় সব বাড়িতেই পাওয়া যায়’।

তবে এমন একটা বাড়িতে নিয়ে চলার কথা বলতেই বেঁকে বসলেন রিকশাচালক মজনু মিয়া। জানালেন, এমন কোনো বাড়ি তিনি চেনেন না। কিছুক্ষণ পর বললেন, ‘চলেন, আনারপুর (আনোয়ারপুর) যাই। ওখানে পাবেন’।
 
কিছুক্ষণ পরেই একটু ফাঁকার দিকে মোড় নিয়ে কাঁচা সড়কে প্রবেশ করলো মজনু মিয়ার অটোরিকশা। পাশেই আনোয়ারপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। একশ’ গজের মতো গিয়ে রিকশাচালক মজনু মিয়া জানালেন, এটা এখানকার মাদক প্রবেশের সবচেয়ে বড় রুট।
 
রিকশা থেকে নেমে কিছুদূর যেতেই ছুটে আসেন কয়েকজন যুবক। সবার হাতে দা-কাঁচির মতো ঘর-গৃহস্থালির অস্ত্র। খালি গায়ের লোকগুলো জানতে চান, কই যাবো, কোথা থেকে এসেছি?

তাদের জানালাম, ‘বিদেশে থাকি। দেশ ঘুরতে বেরিয়েছি। বর্ডার দেখার উদ্দেশ্যে এখানে আসা। ফুর্তি-মজা আর কি!’ তারা বিশ্বাস করলেন বলে মনো হলো না। বললেন, ‘পিলারের বাইরে যাবেন না। ওপার থেকে দূরবিন দিয়ে বিএসএফ দেখে। প্যান্ট পরা লোক দেখলে গুলি চালাবে। এখানে মোবাইল ও ক্যামেরা বের করাও নিষেধ’!

সীমান্তের ২০২১ নম্বর পিলার। পিলার ঘেঁষেই শেষ বাংলাদেশের লিচু বাগান। এরপর নো ম্যান্স ল্যান্ড জুড়ে ছাড়া-ছাড়া ঝোপ-জঙ্গল, সটি বন আর বিস্তীর্ণ গো-চারণ ভূমি। জঙ্গলের আড়ালে বসে আছেন কয়েকজন। কেউ কেউ গরু চরাচ্ছেন। কিছুটা দূরের সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ায় আটকে আছে সবার নজর। সীমান্তের দিকে চলে গেছে পায়ে চলা পথের চিহ্ন।

৫০০ গজ দূরেই সীমান্ত ঘেঁষে আগরতলা বিমানবন্দরের সীমানা প্রাচীর।
 
পশ্চিম দিকে হাঁটাপথ ধরতেই একজন এসে হাজির। বললেন, ‘ফাঁকা দিয়ে কেনো যাচ্ছেন? বাগানের মধ্যে দিয়ে যান’। তার কথা মতো কয়েকটি লিচু বাগান পার হয়ে গেলাম বিমানবন্দরের সীমানার কাছে। এমনই একটি বাগানে কাজ করছিলেন ফজলুর রহমান। বয়স ৮০ ছুঁই ছুঁই। তিনি জানতে চাইলেন, ‘বাবা কোথা থেকে আসছেন? আপনি কি ডিপার্টমেন্টের লোক, নাকি গোয়েন্দা’?

জানালাম, ‘বেড়াতে এসেছি’।
 
বলে চললেন, ‘ঘোরেন। কেউ কিছু বলবে না। ওরা, যারা আপনাকে ভয় দেখাচ্ছিল, ওরা সবাই মাদক চোরাচালানি। নিজেদের বিপদ মনে করলে কেউ নতুন এলেই তাদের জুঁজুঁর(!) ভয় দেখায়’।
 
ফজলুর রহমান বলেন, ‘ওরা সবাই ভাব ধরে ক্ষেত বা বাগানে কাজ করছে, আসলে ওপার থেকে মাল আসার অপেক্ষায় আছে। বললাম, ‘কারা ওরা’? জানালেন, ‘এরা সীমান্তের এপারেরই লোক। সবার বাড়ি আনোয়ারপুর। ওপারের গ্রাম রামপুরের চোরাকারবারিদের মাধ্যমে মদ, গাঁজা, ফেনসিডিল, বিয়ার নিয়ে আসে’।
 
ফজলুর রহমান বলে চলছেন, ৬২ এর দাঙ্গার পর আমরা সবাই রামপুর থেকে এপারে এসে আনোয়ারপুর গ্রামের পত্তন করি। এটা ছিল রামপুর দক্ষিণপাড়া। ধর্মের ভিত্তিতেই নতুন গ্রামের নাম দেওয়া হয় আনোয়ারপুর।
 
এবার ফেরার পালা। আনোয়ারপুর থেকে রিকশা চলতে থাকে সোজা দক্ষিণে। দুই পাশে জলা শুকিয়ে গেছে। আমনের ক্ষেতে সোনালী আভা। মাইল তিনেক আসার পর রিকশা এসে পৌঁছে আখাউড়া বাইপাসে। বাইপাসের পাশে একটি দোকান। বামদিকে একটি পাকা গ্রাম্য সড়ক প্রবেশ করেছে।

আখাউড়া পৌর এলাকার বাইরে এই জনপদের নাম নারায়ণপুর। গ্রাম হলেও পুরো গ্রামই উপশহরের আদলে সাজানো গোছানো। তবে, দেশের অন্য গ্রামগুলোর মতোই সবুজ, সুন্দর এই গ্রাম। বর্ষার পানি নেমে যাওয়ায় ছেলে-মেয়েরা কাঁদা সেঁচে মাছ ধরছে।

আখাউড়া থানা কমপ্লেক্স থেকে গ্রামটি এক কিলোমিটারের মধ্যেই। আগেই জেনেছি, গ্রামটির ঘরে ঘরে নাকি মাদক বিক্রির হাট বসে! নারায়ণপুরে গিয়ে কয়েকজনের কাছে জানতে চাইলাম, ‘বিয়ার পাওয়া যাবে কোথায়? কেউই মুখ খোলেন না’।

একজন স্থানীয় সাংবাদিকের পরিচয় দিলাম। তার বাড়ি এই নারায়ণপুরে। এবার একজন এগিয়ে এলেন। নাম লিটন। তিনিই একটি বাড়িতে নিয়ে গেলেন। বাড়ির মালিক ডালিম।
 
বাড়িতে প্রবেশ করতেই একটি নতুন ইটের লম্বাটে ঘর। ঘরের দুই পাশে কাঠের বেঞ্চি। লিটন বেঞ্চিতে বসতে বলে জানতে চাইলেন কি নেবো? বিয়ার বলতেই একটু পরে ২টা রেড ইন্ডিয়ান ব্র্যান্ডের বিয়ার নিয়ে এলেন।

ঠান্ডা এবং ভেজা বিয়ারগুলো। তবে ফ্রিজিং করা না, বোঝা যায়। লিটন জানান, এগুলোর দাম প্রতি পিস ৩০০ টাকা। জানতে চাইলাম, আর কি আছে! এবার বাড়ির মালিক ডালিম বেরিয়ে এসেছেন। তিনি জানান, ম্যকডোনাল্ড, অফিসার্স চয়েজ, স্যিগনেচার রেড, ভ্যাট ৬৯, ব্ল্যাক ডগ, ব্লেন্ডারস পাইড ও রাম আছে। আছে ফেনসিডিল, ইয়াবা সবই। তবে নতুন আকর্ষণ ফেনসিডিলের বিকল্প এসকফ সিরাফ।

ম্যাকডোনাল্ড ও অফিসার চয়েজের দাম ৬৫০ টাকা। স্যিগনেচার ১৬০০ টাকা, ফেনসিডিল ৫০০ টাকা আর এসকফ ২৫০ টাকা। সবগুলোর স্যাম্পলই ডালিম নিয়ে এসেছেন দেখানোর জন্য।

হাতে নিয়ে ছবি তুললেও কারো কোন মাথাব্যথা নেই। ভেজা কেনো প্রশ্ন ছোঁড়ার পর উত্তর দিলেন ডালিম, ‘প্রশাসনের লোক আসে। তাই মাটির নিচে পুঁতে রাখতে হয়। আবার কখনো পুকুরের মধ্যে বস্তায়’।

এ সময় আসেন সাতজন যুবক। আলাপ শুনে বুঝলাম, প্রায় প্রতিদিনই তারা মাদক সেবনের জন্য এখানে আসেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহর থেকে।
 
লিটন আরও জানালেন, এখানকার মাদক আখড়াগুলোয় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, ভৈরব, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, কুমিল্লা, ফেনী, চট্টগ্রাম থেকে প্রতিদিনই শত শত মানুষ আসেন। বেশিরভাগই ফেনসিডিল খেতে আসেন। মাঝে কাঁটাতারের বেড়ার কারণে কমেছিল ফেনসিডিলের সরবরাহ। এখন সেটা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। কাঁটাতারের বেড়া হওয়ার পর ফেনসিডিল ভরা বস্তা ওপার থেকে ছুঁড়তে গেলে অনেক বোতল ভেঙে যেতো। এখন প্লাস্টিকের বোতল হওয়ায় সে বিড়ম্বনা নেই।  
 
লিটন বলেই চলেছেন, যখন কাঁটাতারের বেড়া ছিল না, তখন প্রায় সবাই এ ব্যবসা করতেন। এখন একশ্রেণীর ব্যবসায়ীদের হাতে ব্যবসার সিন্ডিকেট। এমপি, মন্ত্রী, পৌরসভার মেয়র, ছাত্রনেতা, বিজিবি, পুলিশ আর বিএসএফকে ম্যানেজ করেই ব্যবসা করতে হয়। বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে ওইসব বড় ভাইয়েরা বোতলের অর্ডার দেন। আমাদের তা পৌঁছে দিতে হয়।

তবে কাঁটাতারের বেড়া হওয়ায় এখন পুরো ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে ভারতীয়দের হাতে।
 
তিনি জানান, আখাউড়া উত্তর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল হান্নান স্বপন ও আখাউড়া দক্ষিণ ইউনিয়নের নুরপুর গ্রামের হান্নান মেম্বার সীমান্তের বড় মাদক কারবারী। সীমান্তের ইটনা পয়েন্ট (মনিয়ান্দ ইউনিয়ন), জয়নগর, কুড়িপাইকা, আনোয়ারপুর, বুনবুন, হীরাপুর, কল্যাণপুর, সিঙ্গারবিল, নলগড়িয়া, বিষ্ণুপুর হয়েই দেশে মাদক ঢোকে।
 
মোড়ের দোকানে দাঁড়ানো ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার মেয়রের গাড়ি। মেয়র ভারত যাবেন, তাই তার গাড়ি নিয়েই এখানে এসেছেন তার সাঙ্গপাঙ্গর দল। ডালিমকে দেখা গেল, গাড়িতে বিয়ার রাখছেন।
 
আখাউড়া শহরের দিকের রাস্তায় সামান্য কিছু দূর যেতেই আখাউড়া থানা। রিকশা ছেড়ে দিয়ে থানায় প্রবেশ করতেই দেখা গেলো সেন্ট্রি পোস্টের পাশে ফেনসিডিলের বিকল্প এসকফের বোতল পড়ে আছে। একটা নয়, কিছু দূর পরপরই কয়েকটা।
 
থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোশারফ হোসেন তরফদারের কাছে বিষয়টি তেমন গুরুত্ববহ মনে হলো না। বরং বিষয়টি তুলতেই তিনি কেমন যেনো বিরক্তি প্রকাশ করলেন। বললেন, ‘খালি বোতল ফেলে দেওয়া হবে না তো আলমারিতে তুলে রাখতে হবে নাকি’!
 
তবে ওসির দাবি, তার থানার মাদক পরিস্থিতি এখন শূন্যের কোঠায়। কোথাও কোনো মাদক নেই। প্রশাসন এ বিষয়ে জিরো টলারেন্স দেখাচ্ছে। এরপরই তিনি মোবাইলে কোনো এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন, কোনো এক বন্ধুকে বদলির তদবির সংক্রান্ত। কথা শুনে মনে হলো, ওই বন্ধুর মাধ্যমেই বদলি হয়ে সপ্তাহখানেক আগে আখাউড়ায় এসেছেন তিনি।
 
হোটেলে ফিরে কয়েকজন স্থানীয়ের সঙ্গে চায়ের আড্ডায় জানা গেল, এখানে যারা আসেন তাদের বেশিরভাই মাদক খেতে আসেন। রেল যোগাযোগ ভালো হওয়ায় বিনা টিকিটে মাদক সেবনের এতো বড় স্পট আর এই তল্লাটে নেই। আবার রেলকে ব্যবহার করে দেশের বিভিন্ন স্থানে মাদক বহনেও সুবিধা ব্যাপক। রেল পুলিশের সহযোগিতায়ই চলে এসব কারবার।
 
বাংলাদেশ সময়: ১০৫০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০১৫
আরএম/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।