ঢাকা: কোনো ক্ষিপ্ততা নয়। বরং শান্ত সুবোধ মেজাজেই বড় বড় পা ফেলে হেলেদুলে হেঁটে চলছিলেন তিনি।
আর সেই রাজকীয় আমেজটা যে নিছকই বৃথা নয় তাই যেন প্রমাণ করছিলেন আম জনতা। হাত বাড়িয়ে দেওয়ার মতো শুঁড় তুলতেই সেখানে যে যার সামর্থ্য মতো টাকা গুজে দিচ্ছিলেন।
যথারীতি সুবোধ বালকের মতোই সেই শুঁড় দিয়ে আঙুলের মতো করে টাকা নিচ্ছে হাতি। আবার তা পিঠে আসীন মাহুতের হাতেও তুলে দিচ্ছে সযত্নে।
এ হাতিটার নাম ‘মহারাজ’। নামটা তো আর যেনতেন না! আর মহারাজের পিঠে চেপেছিলেন যিনি সেই মাহুতের চোখে মুখেও যেন ‘টিপু সুলতানের’ ভাব।
এভাবেই সূর্য উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে মহারাজের পা পড়লো সাভারে! তল্লাটের অলিগলি থেকে রাজপথ! সদম্ভে চলেফিরে ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই হাজার খানেক টাকা তুলে দিলেন মাহুতের থলেতে।
সকালে সবে মাত্র অনেকে খুলেছেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ঝাঁপি। দোকানের সামনে হাতি ঢুকছে। পিঠে থাকা মাহুত বলছেন ‘বকশিশ’। ব্যস। কারো কোনো আপত্তি নেই। যে যার মতো ৫ টাকা থেকে ১০/২০ টাকা তুলে দিচ্ছেন হাতির শুঁড়ে!
এভাবেই সাভারের দিনটাই শুরু হয় বাসিন্দাদের হাতি দর্শনে! পাহাড়ি বা গভীর জঙ্গল থেকে নয়। হাতির আগমন গাজীপুরের সফিপুর থেকে। আর প্রাণী জগতের অন্যতম স্থলচর স্তন্যপায়ীর ছবিকে মুঠোফোনে ধারনের মাধ্যমে অনেকের রাঙা প্রভাত রঙিন স্মৃতির আলোয় ঝলমলে করে তুলেছিলেন মহারাজ।
কিভাবে? ‘আবার কিভাবে! সাত সকালে হাতির দেখা পেলাম। দোকানে এসেই হাত বাড়িয়ে দেওয়ার মতো শুঁড় উঁচিয়ে এলো হাতি। দশটি টাকা দিলাম। তারপর হাতির সঙ্গে সেলফি তুললাম। ব্যস তুলে দিলাম ফেসবুকের দেয়ালে। তো স্মৃতিতে অক্ষয় হয়ে রইলো। ’ এভাবেই হাতি নিয়ে নিজের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন শিমুলতলার ব্যবসায়ী জিয়া উদ্দিন সরকার।
পাড়া-মহল্লার অলিগলি হয়ে এক পর্যায়ে হাতি নেমে এলো ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে। আশেপাশের টং দোকান থেকে পাড়ার মুদি মনোহারী দোকান হয়ে দরজা, রড সিমেন্টের দোকান। সব জায়গাতেই নিরীহ বেশে হাতির এ পদচারনায় যেন আনন্দই ছড়িয়ে যায় বাসিন্দাদের মনে। কৌতুহলে স্কুল পড়ুয়াদের অনেকেই পিছু নেয় হাতির। তবে সেটা আর কতক্ষণ। স্কুল কামাই হবে যে। কিছুদূর সঙ্গ দিয়ে শিশুরা যে যার পথ ধরে স্কুলের গন্তব্যে।
হাতির পিঠে মাহুতের বেশে যিনি বসেছিলেন তার রাজকীয় ভাবের কথা না বললেই নয়। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে উত্তর মেলে দশে এক। মানে দশবার কোনো প্রশ্ন করলে উত্তর মেলে মাত্র একবার!
নাম নয়ন। বাড়ি বগুড়ার শিবগঞ্জে। কাজের সময় কথা বলতেই যেন যত আপত্তি। গাবতলী যাইতেছি। পথে পথে তাই সবাইরে হাতি দেখাইতেছি। যে যার খুশি মতো ট্যাকা দ্যায়- এইটুকু বলেই নিজের কাজে মনোযোগী নয়ন। তাকানোর সময়টুকুও তার নেই।
শুঁড়ে তুলে আনা টাকা একের পর এক নিজের থলেতে গুজে দিচ্ছে হাতিটি আর নতুন কাউকে সামনে পেলেই মাহুতের মুখে একটি কথাই- ‘বখশিশ’। হোক তিনি পথচারী বা দোকানি।
মুখের কাছ থেকে বের হওয়া গজদন্ত দিয়েই বোঝা যায় পুরুষ হাতিটির মেজাজ মর্জি। বনে জঙ্গলে যার দলবেঁধে চলার স্বভাব সেই মহারাজ একা একা ঘুরছেন সঙ্গীহীন সাভারের পথে প্রান্তরে।
কে ভাবে ওদের কথা। অথচ বনের প্রিয় স্বজনদের ছেড়ে আজ ওরা লোকালয়ে। নিজেদের পরিণত করেছে আমাদের মতো মানুষদের আয় রোজগারের মাধ্যমে-হাতির শুঁড়ে দশ টাকা গুজে দিয়ে নিজের এই অনুভূতির কথা জানালেন অফিসমুখো বেসরকারি কর্মকর্তা রেদোয়ান ফয়েজ।
কেমন লাগছে। শুঁড় বাড়িয়ে হাতির টাকা নেওয়া? প্রশ্নটা মাটিতে পড়ার আগেই চায়ের দোকানদার রাম নারায়ন ঘোষ বাংলানিউজকে জানান, সাত সকালে গণেশের দেখা পেলাম। বিশটি টাকাও দিলাম। আশা করি দিনটি ভালোই যাবে।
ভাবুন তো ওদের কথা। আমাদের পরিবেশে খাপ খাইয়ে মানুষের রুটি-রুজির জন্য নিজেদের আত্মনিয়োগ করছে। এই ইট-কাঠের নগরে ওর খাবার দাবারের কি ব্যবস্থা? তা কি কেউ ভেবে দেখেছে- বন্য এই প্রাণীর প্রতি বেশ মমতা নিয়েই হাতির দর্শনের পর বাংলানিউজের কাছে নিজের এই অনুভূতি আর ভালোবাসার কথা জানালেন স্কুল ছাত্রী সাদিয়া তাবাসসুম।
তবে নিজেকে নিয়ে মানুষের কী ভাবনা- তাতে কূলার মতো দু’টো বিশাল কান থেকেও যেন কোনো বিকার নেই ‘মহারাজের’।
বাংলাদেশ সময়: ০৮২৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৬, ২০১৫
জেডএস