ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ফিরে: নাম ইকবাল হোসেন, পিতা কাহার হোসেন, গ্রাম সিঙ্গারবিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিজয়নগর উপজেলার সবচেয়ে বড় মাদক চোরাকারবারি তিনি।
একাধিকবার নিজ জেলা ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে আটক হয়েছে ইকবালের মাদকের চালান, গাড়ি ও কাভার্ড ভ্যান। নিজেও গ্রেফতার হয়েছেন। তারপরও ডজনখানেক মামলার এ প্রধান আসামি কেমন করে যেনো কোনো এক অজানা শক্তির বলে ঠিকই বাইরে চলে আসেন। আবারো শুরু করেন চোরাইপথে ভারত থেকে মাদক এনে ঢাকায় পৌঁছানোর কাজ।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার পুলিশ ও প্রশাসন এখন বিরক্ত ও অসহায় এই ‘মাদক সম্রাট’ এর কাছে।
বাংলানিউজের অনুসন্ধানে অভিযোগ পাওয়া গেছে, ইকবালের পাশে আছেন স্থানীয় ক্ষমতাধর রাজনৈতিক নেতারা। আর সবার ওপরে আছেন ঢাকার এক প্রভাবশালী ও বহুল আলোচিত নেতা। তার দাপটেই ইকবালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না প্রশাসন। ফলে অসাধু কর্মকর্তারাও সামিল হন মাদক পাচার চক্রে।
সবার ভাষ্য অনুসারে, ইকবাল হোসেনই এ জেলার ‘মাদকের গডফাদার’।
কেবল ইকবালই নন, জেলার বিজয়নগর, আখাউড়া ও কসবা উপজেলায় এমন ‘মাদক সম্রাট’ এর সংখ্যা ডজনখানেক। অভিযোগ রয়েছে, তাদের পৃষ্ঠপোষক রাজনীতিকেরও অভাব নেই। উপজেলা ও থানা প্রশাসন নাকি সেসব নেতাদের হুকুমেই চলে। তিন উপজেলা ও থানার কর্মকর্তাদের বদলি ও কর্মকাল নির্ধারণ করেন এসব নেতারা। কেন্দ্রীয় নেতা ও প্রশাসনিক উর্ধ্বতনরাও নাকি অসহায় এ চক্রের কাছে। কেউ কোনো উচ্চবাচ্য করলেই নাকি আসে বদলি করার হুমকি!
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, সীমান্তবর্তী এই তিন উপজেলার অনেক রাজনৈতিক নেতাকর্মীই মাদক ব্যবসায় জড়িত। রাজনীতির আড়ালে তাদের সবারই মূল উদ্দেশ্য মাদক ব্যবসা।
অনুসন্ধানে অভিযোগ পাওয়া গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মাদকের এ ভয়াবহতা শুরু হয়েছিল সাবেক সচিব ও সংসদ সদস্য মুশফিকুর রহমানের সময় থেকে। তার সময়ে আখাউড়া থানার ওসি বদল হয়েছিলেন ৫ বছরে ৩৪ বার। তার লোকেরা ১৫ লাখ টাকার বিনিময়ে ছয়মাসের জন্য ওসি বদল করতেন। ওসিরা তাদের বিনিয়োগ তুলে দ্রুত লাভের মুখ দেখতে মাদককে ওভারলুক করা শুরু করেন। বর্তমানেও সে অবস্থা বিদ্যমান আছে।
তবে কেউই বিষয়টি নিয়ে সরাসরি মুখ খুলতে চান না। প্রশাসনিক কর্মকর্তারাও এসব প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে ভয় পান।
জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মঈনুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, বড় বর্ডার। কসবার উল্টো দিকে ভারতের আখাউড়ার বিশালগড়ে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে গাঁজার চাষ হয়। ফেনসিডিলের অবৈধ কারখানাও আছে। আমাদের সাবেক পুলিশ সুপার নিজে গিয়ে দেখে এসেছিলেন।
সেখান দিয়েই বেশি মাদক প্রবেশ করে। কথা হলো, সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া আছে। তারপরও কিভাবে সীমানা পার হয়ে মাদক দেশে প্রবেশ করে? বিজিবি থেকে আমাদের সীমান্তে না যেতে বলা আছে। তাই সীমান্ত ঠিক না করে পুলিশ আর মাদকের লোকদের দোষ দিয়ে কোনো লাভ নেই।
তিনি বলেন, সীমান্তে এলাকার প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। বেশি লাভের জন্য তারা মাদকের ব্যবসা করেন। নারীরাও বোরকার ভেতরে ৫০ বোতল, ১০০ বোতল ফেনসিডিল বহন করেন। আমরা জানি কারা মাদক ব্যবসা করেন, পাচার করেন।
ওসি মঈনুর রহমান স্বয়ং অভিযোগ তুললেন, আখাউড়া, কসবা, বিজয়নগরের প্রায় সব স্থানীয় রাজনীতিবিদই মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করেন। এসব বিষয়ে কথা বললে তারা আমাদের বদলি করার হুমকি দেন। তাদের ভাষায়, তারা তাদের প্রয়োজনে আমাদের নিয়ে এসেছেন। আজ আমি কথা বলছি, কাল হয়তো আমারই বদলি হয়ে যাবে।
এখানকার সংসদ সদস্য আইনমন্ত্রী একজন ভালো লোক হওয়ায় তাকে সবাই নিজেদের মতো করে ব্যবহার করে যাচ্ছেন বলেও অভিযোগ করেন ডিবি’র ওসি মঈনুর রহমান।
জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তা দেওয়ান মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান জেলার মাদক পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেন, আমি কম সময় হলো এখানে এসেছি। তবে যে কয়েকদিন হলো, তাতে বুঝেছি, এখানে কাজ করার অনেক সুযোগ রয়েছে। এখানে এসেই বুঝেছি, যারা মাদকের গডফাদার হিসেবে কাজ করেন, তারা নিজেদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরের লোক মনে করেন।
তিনি অভিযোগ করেন, আমাদের কাজ করার ক্ষেত্রে কিছু প্রতিবন্ধকতা হলো, আমরা হলাম (মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর) ‘ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার’। আমদের অস্ত্র নেই, লোকবল নেই, টাকা নেই, রিকোভারি ছাড়া মামলা করার সুযোগ নেই। এ অবস্থায় যেখানে প্রায় সবাই কোনো না কোনো ভাবে মাদক চক্রের সঙ্গে জড়িত, তাদের সঙ্গে লড়াই করা কঠিন। আমাদের মধ্যেও হয়তো ঘাঁপটি মেরে আছেন কিছু অসাধু কর্মী! সব মিলিয়ে মাদকের এই রুট ও চক্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা কঠিন।
তবে পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে দেওয়ান মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান বলেন, ব্যবসাটা যেহেতু স্থানীয়রা করেন এবং সবাই যেহেতু ক্ষমতাধর, তাই মাদক নির্মূলে তাদেরই বড় ভূমিকা নিতে হবে।
বিজিবি-১২ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল নজরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, মাদকের ব্যবসাটা করেন স্থানীয় মানুষ। ক্ষমতার নানা হিসাব-নিকাশ হয় এই ব্যবসাকে কেন্দ্র করে। এই মানুষগুলো আগে ঠিক হোক, সব বাহিনী ঠিক হোক, সবাই ঠিক হলে এটা বন্ধ হবে। নিজে ঠিক না হলে, নিজের কাজটা নিজে না করলে কেবল মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে মাদক বন্ধ করা যাবে না।
তিনি বলেন, আমি বিজিবিকে বলে দিয়েছি, কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ এলে সোজা শাস্তিসহ বাড়ি চলে যেতে হবে। আমাদের মূল কাজ হলো, সীমান্তে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তারপরও আমরা মাদক নির্মূল নিয়ে কাজ করি। শেষ বিন্দু দিয়ে চেষ্টা করি। তবে বিষয়টা হলো ঠিক হতে হবে সব পর্যায়ের স্থানীয়দের। তারপর সব বাহিনীর। এরপরই মাদক প্রতিরোধ করা যাবে।
জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মিজানুর রহমান বলেন, পরিসংখ্যান দেখলে মনে হয়, আগের চেয়ে পরিস্থিতির বোধ হয় উন্নতি হয়েছে। কিন্তু আদতে তা কমেনি, বরং বেড়েছে। এক সময় বলা হতো ফেনসিডিল কমেছে, গাঁজা বেড়েছে। কিন্তু প্লাস্টিকের বোতল আসার পর ফেনসিডিল পাচার বেড়েছে।
এসপি বলেন, আমি একটু ডিফারেন্ট ওয়েতে পাচারকারীদের সুপথে আনার চেষ্টা করছি। নিজেই অভিযানে যাচ্ছি। মাদকের ঘাঁটি ভেঙে দিচ্ছি। কখনো আইনের মধ্যে থেকে কাজ করছি, কখনো বাইরে থেকে। আমাকে অনেক রাজনৈতিক নেতারাই বলেছেন, মাদকের বিষয়টা ছাড় দিতে। আমি তাদেরকে না করে দিয়েছি। এখন পর্যন্ত তারা আমার বিপক্ষে কোনো অবস্থান নেননি।
জেলা পুলিশের এই সর্বোচ্চ কর্মকর্তাও অভিযোগ করে বলেন, আমি জানি এ কাজে অনেক স্থানীয় প্রভাবশালীই জড়িত। জড়িত আছেন আর্ন্তজাতিক মাফিয়ারাও। আর্ন্তজাতিক এই চক্র খুবই শক্তিশালী ও ক্ষমতাধর। প্রটেনশিয়াল প্রায় সবাই জড়িত। আসলে আমরা সবাই বিষয়টি নিয়ে ব্লাইন্ড গেম খেলি। সবাই যখন মাদক নির্মূলে একমত হতে পারবো, তখনই মাদক নির্মূল করা যাবে।
** আখাউড়ার মাদকচিত্র-২: টোকেন বা লাইনম্যানে ম্যানেজ প্রশাসন!
** আখাউড়ার মাদক আখড়ায়-১: ওপার থেকে আসে, এপারের ঘরে ঘরে বিকোয়
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৭, ২০১৫
আরএম/এএসআর