গাইবান্ধা থেকে ফিরে: দিনে কথা, রাতেই বিয়ে। মাত্র তিন ঘণ্টা আগে সুখিকে বিয়ের জন্য প্রস্তুত হতে বলা হয়।
সুখি এভাবেই তার বিয়ের বর্ণনা দেন। সে গাইবান্ধার সদর উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামের কাইয়ুম মিয়ার কন্যা। যদিও এখন আর এই পরিচয় নেই তার। এখন তার বড় পরিচয় হচ্ছে রশিদের স্ত্রী। স্থানীয়দের ভাষায়, রশিদের বউ।
সুখির বিয়েটা এভাবেই সম্পন্ন হয়। খানিকটা পুতুল খেলার মতো। সুখির মা মালেকা বেগমও মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে এ বিয়ের কথা জানতে পারেন।
মালেকা বেগম বাংলানিউজকে জানান, তারা স্বামী দুপুরে বাড়িতে এসে বলেন, সুখির বিয়ে ঠিক করে এলাম। স্বামীর এমন সিদ্ধান্তে এতো কম বয়সে বিয়ে নিয়ে কিছুটা আপত্তি তোলেন মালেকা বেগম। তখন তার স্বামী ধমক দিয়ে বলেছিলেন, ‘কথা দিয়ে এসেছি। লোকজন আসবে খাবার রেডি করো, বেশি কথা বলবা না’।
সন্ধ্যার দিকে লোকজন আসে গায়ে হলুদের জন্য। রাত ১১টার দিকে বিয়ে পড়ানোর কাজ শেষ হয়। বাল্যবিয়ে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ থাকলেও সুখির বিয়েটা বিনা বাধায় হয়ে যায়। এতো কম বয়সে তার বিয়ে হয়েছে যখন তার বিয়ে সম্পর্কে খুব বেশি বুঝতো না।
এমনকি প্রতিবাদ করার মতো সাহস তখনও তার হয়নি। ঠিক তেমনি একটি সময়ে সুখির বিয়ে হয়ে যায়। তখন তার বয়স ১২ বছর। বিয়ের প্রথম মাসেই গর্ভধারণ করে। আর ১০ মাসের মাথায় জন্ম দেয় মৃত সন্তানের। এখন নানা রকম শারীরিক সমস্যায় ভুগছে। কোনো কাজ ভালো লাগে না তার। জীবনটাই তার কাছে বোঝা বলে মনে হয়।
গত ১৩ নভেম্বর সুখির সঙ্গে কথা হয় তার বাবার বাড়িতেই। সুখি বাংলানিউজকে জানায়, তার বান্ধবীরা যখন দলবেধে স্কুলে যায়, তখন তার মনটা ছটফট করে স্কুলের বটতলায় গিয়ে গুটি খেলার জন্য। কিন্তু এখন তার সব পথ বন্ধ।
শরীর সায় না দিলেও ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই হাড়ি-পাতিল নিয়ে রান্নাঘরে ছুটতে হয়। বাড়ির ধানের কাজ থেকে শুরু করে গরু-ছাগলকে খাবার দেওয়া- সবই তাকে সামাল দিতে হয়।
শুধু কি সুখি, তার বড় বোন ফেন্সির গল্পও প্রায় একই রকম। তারও বিয়ে হয় তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময়। ফেন্সি এখন পুরোপুরি গৃহিণী। তবে বয়স গুণলে এখনও কিশোরীর তালিকায় পড়বে।
রামচন্দ্রপুর গ্রামের অন্যদের অবস্থাও সুখি-ফেন্সির মতোই। একই গ্রামের লাল মিয়ার কন্যা লায়লার বিয়ে হয়েছে ১৩ বছর বয়সে। মাত্র এক বছরের মাথায় সন্তান জন্ম দেয়। অপুষ্টিতে ভোগা সন্তানটি মারা যায় সাত মাসের মাথায়।
খালার বাড়ি কুড়িগ্রামে থাকতো আফরোজা খাতুন। তাকে বাড়িতে বেড়ানোর জন্য ডেকে এনে বিয়ে দেওয়া হয় মাত্র ১১ বছর বয়সে। আফরোজা খাতুন এখন এক সন্তানের জননী। দেখে বোঝার উপায় নেই, তার সন্তান না-কি অন্য কারো। গায়ে গতরেও তেমনটা বেড়ে ওঠেনি। তারপরও সে বাল্যবিয়ের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। দেখলে তাকেই এখনও শিশু মনে হবে।
বাল্যবিয়ে নিয়ে যখন চারদিকে যখন এতো কথা চলছে, তখনও এই গ্রামটিতে শিশু বিয়ের হিড়িক দেখা গেছে। গুণে গুণে ৬০টি বাড়ির পর মানতাশা আক্তার মিমকে পাওয়া গেলো যার নবম শ্রেণিতে ওঠার পর বিয়ে হয়েছে। এবার পিয়ারাপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে মিম।
মিম বাংলানিউজকে জানায়, সে এখনই বিয়েতে রাজি ছিলো না। কিন্তু তার বাবা শরীর খারাপ বলে তাকে আগে ভাগে বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চান। তাই সে রাজি হয়েছে। স্বামী স্বাস্থ্য বিভাগে চাকরি করেন। মানতাশার মা একজন শিক্ষিকা আর বাবা রেজিস্ট্রার অফিসের দলিল লেখক। তারাও বের হতে পারেননি গ্রামের এই চিরায়ত ছক থেকে।
ওই অঞ্চলে বাল্যবিয়ে পরবর্তী নারীর স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করছে ‘ইমেজ’। সংস্থাটির ফিল্ড ফ্যাসিলেটেটর সেলিনা আক্তার বাংলানিউজকে জানান, দেশে বাল্যবিয়ের হার ৬৪ শতাংশ হলেও রামচন্দ্রপুর গ্রামে এ হার ৯০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে।
গ্রামটিতে পরিবারের সংখ্যা এক হাজার ২৫৯টি পরিবার। গত ৫ বছরে ২১০ জন মেয়ের বাল্যবিয়ে হয়েছে, যাদের বয়স ১২ থেকে সতেরোর মধ্যে বলেও জানান তিনি।
বাল্যবিয়ে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলেও কিভাবে বিয়ে হচ্ছে? আর কেনই বা মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে? আর একবার বিয়ে হয়ে গেলেই সরকারের খাতায় তারা সাবালিকা হয়ে যাচ্ছে কিভাবে? জানতে চোখ রাখুন বাংলানিউজে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৮, ২০১৫
এসআই/এএসআর