ঢাকা: একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামালপুরের ৮ আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন প্রসিকিউশনের দ্বিতীয় সাক্ষী শহীদজায়া রওশন আরা মল্লিক।
রোববার (২২ নভেম্বর) চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ তিনি সাক্ষ্য দেন।
সাক্ষ্য গ্রহণে ছিলেন প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ। সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে সংক্ষিপ্ত জেরার পর মামলার কার্যক্রম আগামী ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত মুলতবি করা হয়েছে।
শহীদ নুরুল আমিন মল্লিকের স্ত্রী শহীদজায়া রওশন আরা (৬৮) বলেন, ১৯৬১ সালে ১৪ বছর বয়সে নুরুল আমিন মল্লিকের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। ১৯৭১ সালে নুরুল আমিন আওয়ামী লীগের রাজনীতির পাশাপাশি জামালপুর শহরের মেডিকেল রোডে ওষুধের ব্যবসা (ফার্মেসি) করতেন।
১৯৭১ সালের ৯ জুলাই রাতের খাবার শেষে জামালপুরের দয়াময়ী পাড়ার সিঅ্যান্ডবি রোডের বাসার দ্বিতীয় তলায় স্বামী-সন্তান নিয়ে ঘুমাতে যান। সে সময় তিনি অসুস্থ ছিলেন। রাত ১টায় তাকে ওষুধ খাওয়াতে বলে স্বামী নুরুল আমিন জেগে ছিলেন। ওষুধ খাইয়ে শুয়ে পড়ার ২০ থেকে ২৫ মিনিট পর দরজায়
ধাক্কার শব্দ শুনতে পান।
জোর ধাক্কায় এক পর্যায়ে দরজার ছিটকিনি পড়ে গেলে স্বশস্ত্র তিন রাজাকার ঘরে ঢুকে পড়ে। তাদের মধ্যে দু’জন তার স্বামী নারুল আমিন মল্লিককে টেনে-হিঁচড়ে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যায়। এ সময় অপর রাজাকারটি রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে থাকে।
ঘর থেকে বের করে নিয়ে যাওয়ার সময় নুরুল আমিনের সঙ্গে রাজাকারদের ধস্তাধস্তি হয়েছিল বলে সাক্ষ্যে উল্লেখ করেন রওশন আরা।
তিনি আরও বলেন, এরপর তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। তখন দেবর, ননদ, ভাতিজারা মুখে পানি ছিটিয়ে দিলে তার জ্ঞান ফিরে আসে। এরপর দ্বিতীয় তলা থেকে তাকে নিচে নিয়ে আসা হয়। তখন তিনি তার শ্বশুরকে চিৎকার করে বলতে শোনেন, ‘আশরাফ, শরীফ, মান্নান তোরা আমার কি সর্বনাশ করলি?’ ঘটনার রাতে কারফিউ থাকায় তারা কেউই ঘর থেকে বের হননি।
পরদিন (১০ জুলাই ১৯৭১) শহীদ নুরুল আমিন মল্লিককে ফিরে পেতে স্থানীয় শান্তি কমিটি ও বদর বাহিনীর নেতাদের সাথে যোগাযোগ করে তার পরিবারের সদস্যরা। শান্তি কমিটি ও বদর বাহিনীর নেতারা নুরুল আমিনকে ফিরিয়ে দিবেন বলে আশ্বাস দিয়েছিল। এ কথা সাক্ষি রওশন আরা তার শ্বশুর এবং ভাসুরের কাছে শুনেছিলেন।
স্থানীয় শান্তি কমিটির নেতা হিসেবে ইউসুফ মাস্টার, মক্তব কবিরাজ, শরীফ, শামসুল অ্যাডভোকেটের নাম সাক্ষ্যে উল্লেখ করেন তিনি।
সাক্ষি বলেন, “পরদিন অর্থাৎ ১১ জুলাই আমার স্বামীর মরদেহ ব্রহ্মপুত্রের চাপাতলা ঘাটে ভাসমান অবস্থায় পাওয়া যায়। আমার স্বামীর মুখে তখন কাপড় গোঁজা, দুই হাত এবং পা বাঁধা ছিল। গুলিবিদ্ধ শরীরে বেয়নেটের আঘাতও ছিল। ”
সাক্ষি রওশন আরা বর্তমানে সিরাজগঞ্জের বেলকুচি থানার খিদ্রমাটিয়া গ্রামে বসবাস করেন।
সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে সাক্ষিকে সংক্ষিপ্ত জেরা করেন আসামিপক্ষের তিন আইনজীবী আব্দুস সোবহান তরফদার, এসএম মিজানুর রহমান এবং কুতুবুদ্দিন আহমেদ।
আব্দুস সোবহান তরফদার পলাতক মো. আশরাফ হোসেন, অধ্যাপক শরীফ আহমেদ ওরফে শরীফ হোসেন ও মো. আব্দুল হান্নানের আইনজীবী, এসএম মিজানুর রহমান আসামি অ্যাডভোকেট শামসুল আলম ওরফে বদর ভাই ও এসএম ইউসুফ আলীর আইনজীবী এবং কুতুবুদ্দিন আহমেদ মো. আব্দুল বারী, মো. হারুন ও আবুল কাসেমের আইনজীবী।
এর আগে ২৬ অক্টোবর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামালপুরের আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। তাদের বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, আটক, অপহরণ, নির্যাতন, লুটপাট ও মরদেহ গুমের পাঁচটি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে।
বুধবার (১৮ নভেম্বর) আট আসামির বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের সূচনা বক্তব্য (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) উপস্থাপন ও সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। এ মামলার প্রথম সাক্ষি হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছেন সাংবাদিক আজিজুর রহমান ওরফে ডল (৫৬)।
মামলার ৮ আসামির মধ্যে দু’জন অ্যাডভোকেট শামসুল আলম ওরফে বদর ভাই এবং এস এম ইউসুফ আলী গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন। পলাতক বাকি ছয়জন হলেন- আলবদর বাহিনীর উদ্যোক্তা মো. আশরাফ হোসেন, অধ্যাপক শরীফ আহমেদ ওরফে শরীফ হোসেন, মো. আব্দুল হান্নান, মো. আব্দুল বারী, মো. হারুন ও মো. আবুল কাসেম।
তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি ও আত্মসমর্পণের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলেও তারা আত্মসমর্পণ করেননি এবং গ্রেফতার হননি।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ২২, ২০১৫
এমএইচপি/এটি