দিনাজপুর থেকে: দিনাজপুর শহরের বাহাদুর বাজার, টিঅ্যান্ডটি সড়ক, পৌরসভার মোড়, রেলওয়ে স্টেশন, চাওলিয়াপট্টি, রামনগর, রেলবাজার, পুলহাট, নিউটাউন এলাকা দিয়ে গেলে কানে আসে নারী কিংবা পুরুষের আহ্বান- ‘পাতা লাগে পাতা...দাম কম...’।
এসব এলাকার সড়কের ধারে কাঁঠাল পাতা বিক্রি করেন প্রায় ২৫/৩০ জন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নারী এবং বয়স্ক পুরুষ।
সকাল ১০টা থেকে রাত ১১টা অবধি চলে সড়কের ধারে বসে ছাগলের জন্য কাঁঠাল পাতা বিক্রি। এই পেশা আঁকড়ে ধরে কেউ কেউ সাত থেকে আট সদস্যের সংসার চালাচ্ছেন, কেউ আবার লেখাপড়া শেখাচ্ছেন ছেলে মেয়েকে। কাঁঠাল পাতায় লেখা ওইসব পরিবারের ভাগ্যলিখন।
উত্তরাঞ্চলের অন্যান্য জেলার চেয়ে দিনাজপুরে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ছাগল পালন করার হার তুলনামূলক বেশি।
চাউলিয়া পট্টির খয়রাত হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, তার তিনটি রামছাগল আছে। তাই প্রতিদিনই কাঁঠাল পাতা কিনতে আসেন তিনি। ঈদুল আজহায় দুটি ছাগল ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন খয়রাত। পরে ৬ হাজার টাকা দিয়ে ফের তিনটি ছাগলের বাচ্চা কিনেছেন। আগামী ঈদে আবার সেগুলো বিক্রি করবেন। এভাবে দিনাজপুরের অনেকেই বারতি আয় করে থাকেন।
ছাগলের প্রিয় খাবার কাঁঠাল পাতা। আর তাই ছাগল মালিকরা প্রতিদিনই এসব এলাকা থেকে কাঁঠাল পাতা কেনেন। সবচেয়ে বেশি ব্যবসায়ী দেখা যায় বাহাদুর বাজার-টিঅ্যান্ডটি সড়কে।
স্থানীয়দের কাছে এটি ‘কাঁঠাল পাতার হাট’ নামে পরিচিত। ছোট ৪/৫টি পাতার ডাল একত্রে বেধে তৈরি হয় ‘আঁটি’, দাম ৫ টাকা। আর চারটি আঁটি একসঙ্গে বাঁধলে হয় ‘বোঝা’। তখন দাম ধরা হয় ২০ টাকা-‘নির্ধারিত মূল্য’। ক্রেতারা দাম জানেন বলে তাদের আর দরদাম করার ঝামেলা থাকে না।
কয় বোঝা বা আঁটি দরকার বিক্রেতাকে জানালে তারাই রিকশা বা অটো রিকশায় পাতা তুলে দেন। সম্পর্ক ভালো থাকলে এক বোঝা কিনে একটি আঁটি ‘ফ্রি’ তেও পাওয়া যায়!
পরিষ্কার করা কাঁঠাল পাতা দ্রুত বিক্রি হয়। তাই হাটে তোলার আগে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে নিয়ে আসেন বিক্রেতারা।
কাঁঠাল পাতা বিক্রেতাদের অধিকাংশই নারী। কেউ কেউ স্বামীর সঙ্গে এবং কেউ কেউ স্বতন্ত্র ব্যবসা করছেন। স্বতন্ত্র নারী ব্যবসায়ীরা সমাজে বঞ্চিত কিংবা নির্যাতনের শিকার।
মানছুরা তার স্বামী আব্দুল মান্নানের (৬০) সঙ্গে ব্যবসা করেন। বিক্রি বাড়াতে তারা আলাদা আলাদা বসেন। কাঁঠাল পাতা বিক্রি করে তারা তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন, ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। ছেলে মঞ্জুরুল ইসলাম বর্তমানে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিম্নপদে চাকরি করেন। অবসর সময়ে মা-বাবাকে ব্যবসায় সাহায্যও করেন।
মঞ্জুর জানান, দিনাজপুর শহরের বা এর আশেপাশের কাঁঠাল বাগান মালিকরা খবর দিলে তারা দিয়ে বাগান চুক্তি করেন। কখনও নিজেরাই বাগানের খোঁজে বের হন তারা। ১২ থেকে ১৫টি গাছের একটি বাগান ১ হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত দাম দেন তারা। এরপর সেখান থেকে পাতা ভেঙ্গে এনে শহরে বিক্রি করেন।
দিনাজপুর রেলওয়ে স্টেশনে কাঁঠাল পাতা বিক্রি করেন মো. শামিম (৬৫)। তিনি জানান, গাছে কাঁঠাল ধরলে সেসময় মালিককরা বাগান বিক্রি করেন না। তখন পাতার সংকট দেখা দেয়, বিক্রিও হয় চড়া দামে। আবার ঈদুল আজহায় পাতার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বিক্রি ও লাভ দুই-ই বেড়ে যায়।
টিঅ্যান্ডটি সড়কের কাঁঠাল পাতা ব্যবসায়ী জাবেদ বাংলানিউজকে জানান, তিনি প্রায় ৪০ বছর যাবৎ একই জায়গায় কাঁঠাল পাতা বিক্রি করছেন। তার দুই স্ত্রী। স্ত্রীরাও তার সঙ্গে কাঁঠাল পাতা বিক্রি করেন। তাদের পাঁচ ছেলে-মেয়ে। তাদের লেখাপড়া বিয়ে সবই তারা করেছেন, কাঁঠাল পাতা বিক্রি করে।
একই এলাকার পাতা ব্যবসায়ী রেহেনা, আলো, রেশমা, অমেলা আর মেরী।
সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা বলতে গেলে ছাফ জানিয়ে দেন-তাদের কোনো লাভ হয় না, ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া যায় না। সরকার কোনো সাহায্য-সহযোগিতা করে না। সমাজের বিত্তবানরা তাদের কোনো খোঁজ নেয় না। শুধু শুধু সাংবাদিকের সঙ্গে ‘প্যাঁচাল’ পাড়তে তারা আগ্রহী না।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৫, ২০১৫
এমআই/এটি
** রামসাগর এখন মাদকসেবীদের অভয়ারণ্য!
** কান্তজিউ মন্দিরে মাসব্যাপী রাসমেলা শুরু বুধবার