ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

শুধু হাট নয়, হাসি-কান্নার মিলনমেলাও

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮২৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০১৫
শুধু হাট নয়, হাসি-কান্নার মিলনমেলাও ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ফেনী: এপার-ওপার, দুই পাশের মানুষের ভাষা এক। সংস্কৃতিও এক।

তবে দেশ ভিন্ন। মাঝখানে কাঁটাতারের বেড়া শুধু তাদের পৃথক নাগরিকত্ব নির্ধারণ করেছে।

এতোকাল কাঁটাতারের বেড়ার এপাশ-ওপাশ থেকেই লেনদেন হতো তাদের ভাব-বিনিময়, ভালো-মন্দের খবরাখবর আর দীর্ঘশ্বাস।

এখনো কাঁটাতারের বিভেদ রয়েছে। তবে এখন দুই পাড়ের মানুষেরা একে-অন্যের সঙ্গে মিশতে পারেন। চাইলে ছুঁয়েও দেখতে পারেন।

তবে এ শুধু মঙ্গলবারেই সম্ভব। তাই এপার আর ওপারের বাঙালিরা মিলনমেলার জন্য আশায় থাকেন মঙ্গলবারের।

ফেনীর ছাগলনাইয়া ও ভারতের ত্রিপুরার শ্রীনগর সীমান্ত এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, মঙ্গলবারের জন্য সাধারণ ও নিম্ন আয়ের মানুষের প্রতীক্ষা।

প্রতি মঙ্গলবারে এখানে জমে সীমান্ত হাট। বিকি-কিনি হয় দুই দেশের পণ্যের। সেইসঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয় দুই দেশে থাকা আত্মীয়-স্বজনের।

মূলত পণ্য বিনিময় ‍ও বিকি-কিনির জন্য এ হাট গড়ে উঠলেও এখন তা হয়ে উঠেছে হাজারো মানুষের পারিবারিক সাক্ষাৎ আর হাসি-কান্নার মিলনমেলা।

রথ দেখা ও কলা বেচার মতো দুই বাংলার অনেকেই তাই সীমান্তের হাটবারে আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করার অপেক্ষায় থাকেন।

ফেনীর ছাগলনাইয়া আর ভারতের শ্রীনগর সীমান্তে প্রতি মঙ্গলবারই বসছে এ হাট। দুই দেশের সীমান্তের ঠিক মাঝে তৈরি করা হয়েছে সীমান্ত হাটের কাঠামো। চারদিকে ধানখেত, মাঝে কয়েকটি আধাপাকা ঘর নিয়ে তৈরি এ হাট। একপাশে বাংলাদেশি বিক্রেতারা বসেন, অপরপাশে বসেন ভারতীয় বিক্রেতারা।

হাটের ৫ কিলোমিটার এলাকার মানুষদের ওই হাটে নিয়মিত কেনাকাটা করার অনুমতি রয়েছে। এজন্য শুরুতে ১০০ টাকার বিনিময়ে করা পাস বা পরিচয়পত্র  বিজিবি বা বিএসএফকে দেখিয়ে বাজারে প্রবেশ করতে হয় তাদের।

তবে ৫ কিলোমিটারের বাইরের বা দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা ক্রেতাদের ২০ টাকার বিনিময়ে টিকিট কেটে হাটে প্রবেশ করতে হয়।

সীমান্তের এ হাটে ভারতের ব্যবসায়ীরা বিক্রি করেন, প্রসাধনী, ক্রোকারিজ, কনফেকশনারি, মসলা, হলুদ, আদা, ধনিয়া, সরিষার তেল, জিরা, কিসমিস, গুঁড়াদুধ, হরলিক্স, নারীদের অলঙ্কার, পোশাক, কোদাল ইত্যাদি।

অন্যদিকে, বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা বিক্রি করেন শার্ট-প্যান্ট, নারকেল, প্রসাধনী, দুধ, খেজুর, বিস্কুট-চানাচুর,  সেমাই, গুড়, কোমল পানীয়, মাছ, গাজর, শুটকি, তেল,  মশারি, প্লাস্টিক সামগ্রী ও জুতা ইত্যাদি।

সপ্তাহে প্রতি মঙ্গলবারে এ হাটে সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত চলে বেচা-কেনা।

তবে এ বাজারে দোকানি হিসেবে দোকান বরাদ্দ পেয়েছেন দুই দেশের সীমান্তের ৩ কিলোমিটার এলাকায় বসবসাকারী বাসিন্দারা।

সম্প্রতি ফেনীর ওই সীমান্ত হাটে গিয়ে দেখা মেলে এমনই এক পরিবারের সঙ্গে। হাটে এসেছেন লিলি মজুমদার। দক্ষিণ ত্রিপুরার সাব্রুম শহরে তার বসবাস।

ফেনী শহরের মাস্টারপাড়ায় বসবাস করেন তার বোন কবিতা। কিন্তু বোনের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে পাসপোর্ট, ভিসাসহ আরো অনেক ঝক্কি। ফলে সীমান্ত হাট চালুর পর থেকে তারা ‍হাটে এসেই দেখা করেন।

সেখানে বোন ছাড়াও তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা হয় লিলির। লিলির সঙ্গে এসেছে মেয়ে সুচিত্রা মজুমদার।

একইভাবে হাটে এসেছেন হিমাংশু দাস। তিনি এসেছেন ত্রিপুরার শ্রীনগরের মুন বাজার থেকে। তার উদ্দেশ্য কাকাতো ভাই সমীরের সঙ্গে দেখা করা। সমীর বসবাস করেন ছাগলনাইয়া উপজেলার রাধানগর গ্রামে।

কাকাতো ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে পেরে দারুণ উচ্ছ্বসিত হিমাংশু। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘এ বাজার হইছে বলে আমরা আত্মীয়-স্বজনরে দেখতে পাই, জ্ঞাতি- গোষ্ঠী রক্ষা হয়। আমরা গরিব, আমাদের তো পাসপোর্ট- ভিসা দিয়ে দেখা করার সাধ্য নাই’।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফেনী সীমান্তের ওপারে ত্রিপুরা অংশে অনেকেরই আত্মীয়-স্বজন রয়েছেন। সীমান্ত হাট বসার পর থেকে হাটে আসার সুবাদে এখন কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই সহজে দেখা করতে পারছেন সেসব সাধারণ মানুষ।

তারা জানান, প্রতি মঙ্গলবার ফেনী ও ‍এর আশপাশের জেলাসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেকেই হাটে আসেন ভারতে থাকা আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করতে। তবে এ হাটে আসা দুই দেশের এই অধিকাংশ মানুষই নিম্ন আয়ের। ভিসা এবং পাসপোর্টের মাধ্যমে যাতায়াত ও আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ নেই তাদের। ফলে মঙ্গলবারের অপেক্ষায় থাকেন তারা।

ছাগলনাইয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কাজী শহীদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, শুধু কেনাকাটা নয়, দুই দেশের মানুষের যোগাযোগের কারণে শুরু থেকেই হাটটি মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এখন দূর-দূরান্ত থেকেও অনেকে এ হাটে আসছেন।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ২০১০ সালের একটি সমঝোতা চুক্তি অনুযায়ী ১০টি সীমান্ত হাট স্থাপনের কথা রয়েছে। এখন পর্যন্ত মোট ৪টি হাট চালু হয়েছে।

২০১৩ সালের ১২ জুন শ্রীনগর- ছাগলনাইয়ার এ সীমান্ত হাটের নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করা হয়। নির্মাণকাজ শেষে গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর ছাগলনাইয়ায় দুই দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে হাট চালুর বিষয়ে বৈঠক হয়। এ বছরের ১৩ জানুয়ারি মঙ্গলবার থেকে চালু হয় সীমান্ত হাটটি।

এ সীমান্ত হাটে উভয় দেশের ২৫টি করে ৫০টি দোকানে একজন ক্রেতা সর্ব্বোচ্চ ১০০ ডলার পর্যন্ত কেনা-কাটা করতে পারবেন।

বাংলাদেশ সময়: ০৯০০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০১৫
এসআর/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।