ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

মুক্তিযুদ্ধের বুলেটিন ইশতেহার-জয়বাংলা-বঙ্গবাণী

শফিক ছোটন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৩, ২০১৫
মুক্তিযুদ্ধের বুলেটিন ইশতেহার-জয়বাংলা-বঙ্গবাণী ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

নওগাঁ: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রণাঙ্গনের খবর তুলে এনে ইশতেহার, জয়বাংলা ও বঙ্গবাণী নামে তিনটি স্বাধীনতার বুলেটিন প্রকাশ করেছিলেন নওগাঁর বেশ কয়েকজন যুবক।

উদ্দেশ্য ছিল, স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রম, রণাঙ্গনের খবরাখবর, মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন অঞ্চলে বিজয়ের সংবাদ, শরণার্থী শিবিরের দুর্দশাসহ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক নানা তথ্য প্রকাশের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ জনগণকে উৎসাহিত করা।



কাগজগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের জয়গান লিখেছেন এক ঝাঁক তরুণ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বুলেট তাদের লেখনি থামাতে পারেনি। কাগজগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের তাজা খবর প্রকাশ করে সেগুলো পৌঁছে দিতেন মুক্তিযোদ্ধা আর মুক্তিকামী বাঙালির হাতে-হাতে।

কিন্তু এসব এখন কেবলই স্মৃতি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এসব কলমসৈনিক ও তাদের পরিবারের খবর রাখেননি কেউ। একে একে তারা হারিয়ে গেলেও তাদের সম্মাননায় করা হয়নি কিছুই।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক খবর সবার কাছে পৌঁছে দিতে পত্রিকাগুলো নিয়ে যাওয়া হতো যুদ্ধ শিবিরেও।

এসব কাগজ প্রকাশনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকেই এখন আর বেঁচে নেই। তবে স্থানীয়ভাবে সেই বুলেটিনগুলোর কিছু সংখ্যা সংরক্ষণে আছে এখনও।

মুক্তিযোদ্ধা এবিএম রফিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, বঙ্গবাণীর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৯৭১ সালের ২৩ মে। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মরহুম আব্দুল জলিল। প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক খন্দকার মকবুল হোসেন।

পত্রিকায় সম্পাদক মকবুল হোসেন ছদ্মনাম হিসেবে কে এম হোসেন ব্যবহার করেছিলেন। মুজিবনগর সরকারের দেওয়া পত্রিকাটির রেজিস্ট্রেশন নম্বর ছিল ১০।

সপ্তাহের প্রতি রোববার নিয়মিতভাবে ২৬টি সংখ্যা প্রকাশিত হওয়ার পর পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়।

তিনি আরো জানান, বঙ্গবাণী পত্রিকাটি নওগাঁ প্রেসের নামে ছাপা হলেও প্রকাশিত হতো পশ্চিমবঙ্গের বালুরঘাট সুনীতি প্রিন্টিং প্রেস থেকে। এর প্রতিটি কপির বিক্রয় মূল্য ছিলো ১৫ নয়া (পয়সা)।

মকবুল হোসেন নওগাঁর রানীনগর উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। বার্ধক্যজনিত কারণে ২০০১ সালে মারা যান তিনি।

নওগাঁ শহরের কৃষ্ণধন হাইস্কুলের (কেডি) সাইক্লোস্টাইল মেশিন (হাতে লেখা) থেকে ছাপানো হতো ইশতেহার পত্রিকাটি।

১৯৭১ সালের ১৫ মার্চ ছাপা হয় এর প্রথম সংখ্যা। মাত্র তিনটি সংখ্যা প্রকাশিত হওয়ার পর পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়।

মুক্তিযোদ্ধা এবিএম রফিকুল ইসলাম জানান, ইশতেহার পত্রিকাটিতে প্রকাশক ও সম্পাদক হিসেবে নির্দিষ্ট করে কারো নাম উল্লেখ করা হয়নি।

শহরের তরুণ আখতার আহম্মেদ সিদ্দিকী, শফিকুল ইসলাম খাঁন, জহুরুল ইসলাম ঈদুলসহ বেশ কয়েকজন এটি প্রকাশ করেছিলেন। তাদের মধ্যে আখতার আহমেদ ২০১৩ সালে মারা গেছেন।

মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল ইসলাম ঈদুল জানান, নওগাঁর স্বাধীনতাকামী মানুষকে উজ্জীবিত করতে একটি প্রিন্ট গণমাধ্যমের প্রয়োজন ছিলো অপরিসীম।

তাই আমরা কয়েকজন বন্ধু একত্রিত হয়ে ইশতেহার পত্রিকাটি প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিই। এটিই ছিলো এ অঞ্চলের ছাপা অক্ষরের প্রথম পত্রিকা।

এর প্রতিটি সংখ্যার শিরোনামে ছাপা হয়েছিল প্রখ্যাত কবি রঙ্গলালের বিখ্যাত কবিতার দু’টি চরণ (স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়!/ দাসত্ব শৃঙ্খল পায় কে পরিতে চায় হে, কে পরিতে চায়?)।

তিনি বলেন, সে সময় আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পত্রিকাটি শহর থেকে গ্রামে ও মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে বিলিয়েছি।

যুদ্ধ চলাকালে দেশে ও দেশের বাইরে জয়বাংলা নামে একাধিক পত্রিকা প্রকাশিত হলেও একই নামে একটি বুলেটিন ছিলো নওগাঁ জেলার মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রকাশিত বুলেটিন।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের আগেই এটি প্রথম প্রকাশ করা হয়। পত্রিকাটির সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন এমএ রহমতুল্লা ওরফে গুল হায়দার। নওগাঁ শহরের কাজিপাড়া থেকে জয়বাংলা পত্রিকাটির পর পর তিনটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। পরে এটি ভারতের কলকাতা থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হতো।

নওগাঁ সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার গোলাম সামদানী জানান, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বহির্বিশ্বে স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য জয়বাংলা পত্রিকাটির খবরগুলো ভারতের ইংরেজি দৈনিক পত্রিকায় ছাপানো হতো।

মুক্তিযুদ্ধের বুলেটিন হিসেবে নওগাঁ ও আশেপাশের এলাকায় জয়বাংলা ছিলো জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ।

তিনি আরো বলেন, বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে সবাইকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান সম্বলিত খবর থাকতো জয়বাংলার প্রতিটি সংখ্যায়।

এছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের অর্জন, ভারতের বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থী ক্যাম্পের খবর থাকতো পত্রিকাটিতে।

যতোদূর জানা যায়, এমএ রহমতুল্লা ওরফে গুল হায়দার ছিলেন একজন ব্যাংক কর্মকর্তা। চাকরির সুবাদে তিনি ১৯৭১ সালে নওগাঁয় আসেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি অন্য কোথাও চলে যান।

নওগাঁ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার হারুন অল রশিদ জানান, নওগাঁকে  পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত করতে বুলেটিনগুলো অপরিসীম ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, পরে সেই কাগজগুলো চালু রাখার জন্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৩, ২০১৫
এসআই/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।