ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

বোরো চাষে ব্যস্ত কৃষক

মাহবুবুর রহমান মুন্না, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০১৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০১৫
বোরো চাষে ব্যস্ত কৃষক ছবি: মানজারুল ইসলাম/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

খুলনা: জেঁকে বসেছে শীত। ঘন কুয়াশায় ঘর থেকে বের হওয়াই যেন দায়।

তবে শীতের ঘন কুয়াশাকে উপেক্ষা করে জমিতে বোরো ধান চাষে ব্যস্ত সময় পার করছেন খুলনার কৃষকরা। জমিতে পানি সেচ দিয়ে হাল চাষ করছেন কেউ কেউ। মই ও কোদাল দিয়ে জমির উঁচু-নিচু সমান করে বীজতলা তৈরি করছেন অনেকে। কেউ বা ফেলছেন বীজ। আগাম যারা বীজতলা করেছিলেন তাদের চারা বড় হতে শুরু করেছে। সেগুলোর পরিচর্যায়ও ব্যস্ত রয়েছেন কেউ কেউ।

ধানের বীজ বপনকালে কথা হয় জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগর গ্রামের কৃষক আব্দুল্লাহর সাথে। তিনি জানান, ৫ বিঘা জমিতে বোরো ধান রোপণ করবেন তিনি। এ জন্য দুটি বীজতলা তৈরি করেছেন। একটিতে বীজ বপন করা হয়েছে, চারাও বড় হয়ে উঠেছে। বাকিটিতে এখন বীজ বপন করছেন।

শোভনা এলাকার চাষি নিখিল দাস বাংলানিউজকে জানান, ৪ বিঘা জমিতে বোরো ধান রোপণের জন্য পরিমাণ মাফিক বীজ বপন করেছেন। চারা গাছ অনেকটা তৈরি হয়ে গেছে, এখন জমি তৈরি হলেই রোপণ কাজ শুরু হবে। এজন্য ব্যস্ত সময় পার করতে হচ্ছে তাকে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খুলনার উপ-পরিচালক আব্দুল লতিফ বাংলানিউজকে জানান, চলতি বোরো মওসুমে জেলার ৯ উপজেলা ও মেট্রোপলিটন থানা এলাকায় ৫০ হাজার ৬শ’ ২৭ হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে হাইব্রিড জাতের বোরো ১৭ হাজার ৬শ’ ২৮ হেক্টর জমিতে এবং উন্নত ফলনশীল (উফশী) জাতের ৩২ হাজার ৭শ’ ৯৩ হেক্টর জমিতে। স্থানীয় জাতের বোরো চাষ হবে প্রায় ২শ’ ৬ হেক্টর জমিতে।

আব্দুল লতিফ বলেন, বোরো চাষের ক্ষেত্রে খুলনা জেলার কৃষকদের ব্যাপক প্রস্তুতি রয়েছে। এ জন্য উন্নত জাতের বীজ, সারের সরবরাহ এবং সেচ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে কৃষি বিভাগেরও ব্যাপক উদ্যোগ রয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কৃষি বিভাগ সব সময় কৃষকদের পাশে থাকবে।

বোরো ধানের চাষ পদ্ধতি: কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও কৃষিবিদদের মতে বোরো ধানের চাষ পদ্ধতি ও ফলন বাড়ানোর উপায় নিচে উল্লেখ করা হলো।

জমি তৈরি: জমিতে প্রয়োজন মতো পানি দিয়ে মাটির প্রকারভেদে ২-৩টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি থকথকে কাদাময় করতে হবে। জমি উঁচু-নিচু থাকলে মই ও কোদাল দিয়ে সমান করে নিতে হবে।

রোপণ সময়: মধ্য ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সময় হলো বোরো ধানের চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। তবে দেশের উত্তরাঞ্চলে ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু করে জানুয়ারি পর্যন্ত রোপণ করলে ধানের ফলনের কোনো তারতম্য হয় না।

চারার বয়স: চারার বাড়তির ওপর ভিত্তি করে ৩০ থেকে ৪৫ দিন বয়সের চারা রোপণ করতে হবে। সাধারণত চারার বয়স ২৫ থেকে ৩০ দিন হলে ফলন বেশি হয়। উত্তরাঞ্চলে চারার বয়স ৫০ থেকে ৫৫ দিন হলেও তেমন ক্ষতি নেই। এর চেয়ে বেশি বয়সের চারা লাগানো উচিত নয়। বেশি বয়সের চারা রোপণ করা হলে প্রতি একদিন বেশি বয়সের জন্য ধানের ফলন হেক্টর প্রতি ২৫ থেকে ৩০ কেজি কম হয়।

রোপণ পদ্ধতি: প্রতি গোছায় ২ থেকে ৩টি চারা ২০ থেকে ২৫ সেন্টিমিটার দূরত্বের সারিতে ১৫ থেকে ২০ সেন্টিমিটার দূরে দূরে লাগাতে হবে। অল্প গভীরে চারা রোপণ করলে কুশির সংখ্যা বেশি হয়; কিন্তু ফলনশীল কুশির সংখ্যা কমে যায়। আবার অধিক গভীরে রোপণ করলে কুশির সংখ্যা কম হয়, তবে প্রতিটি কুশিই ফলনশীল ছড়ার জন্ম দেয়। এ কারণে ৭ থেকে ১০ সেন্টিমিটার গভীরতায় চারা লাগানো উত্তম।

জাত নির্বাচন: বোরো মৌসুমে বেশ কয়েকটি জাত যেমন, বিআর-৩, বিআর-১৪, বিআর-১৬, ব্রিধান-২৮, ব্রিধান-২৯ সারা দেশে কৃষকদের কাছে জনপ্রিয়। এছাড়া এ মৌসুমে ব্রিধান-৪৫, ব্রিধান-৪৭, বিনাধান-৮, ব্রি-হাইব্রিড ধান-১, ব্রি-হাইব্রিড ধান-২ ও ব্রি-হাইব্রিড ধান-৩ জাতগুলোও চাষ করা যেতে পারে। বোরো মৌসুমে সুগন্ধী ধান হিসেবে ব্রিধান-৫০ চাষ করা যায়। দেশে বর্তমানে বোরো মৌসুমে শতকরা ৯৫ ভাগেরও বেশি জমিতে উফশী ধানের প্রচলন রয়েছে। বোরো মৌসুমে দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত জমিতে ব্রিধান-৪৭ চাষ করা যায়। এর ফলন ব্রিধান-২৮ থেকে হেক্টরপ্রতি এক টন বেশি এবং জীবনকাল মাত্র ১৪০ থেকে ১৫০ দিন।

সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ: শেষ চাষের সময় একরপ্রতি ৫০ কেজি টিএসপি, ৪৮ কেজি এমওপি, ২৪ কেজি জিপসাম ও চার কেজি দস্তা সার মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। একরপ্রতি ১০৮ কেজি ইউরিয়া সার তিন কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া সারের প্রথম কিস্তি চারা রোপণের ১৫ থেকে ২০ দিন পর, দ্বিতীয় কিস্তি ধানের গোছায় ৪ থেকে ৫টি কুশি আসা অবস্থায় এবং শেষ কিস্তি কাইচ থোড় আসার ৫ থেকে ৭ দিন আগে প্রয়োগ করতে হবে।

ভালো ফলনের জন্য জমি তৈরিকালে একরপ্রতি এক থেকে দেড় টন জৈব সার ব্যবহার করতে হবে। সারের পরিমাণ জমির উর্বরতা ও কৃষি পরিবেশ অঞ্চলের ওপর ভিত্তি করে কম বা বেশি হতে পারে। দানাদার ইউরিয়ার চেয়ে গুঁটি ইউরিয়া ব্যবহার করলে শতকরা ৩৫ থেকে ৪০ ভাগ উইরিয়া সার কম লাগে এবং গুঁটি ইউরিয়া প্রয়োগকৃত জমিতে ধানের ফলন শতকরা ২০ থেকে ২৫ ভাগ বেশি হয়।

বোরো ধানের জমিতে চারা রোপণের ৫ থেকে ৭ দিন পর চারটি চারার মাঝখানে ০.৯ গ্রাম ওজনের তিনটি বা ২.৭ গ্রাম ওজনের একটি গুঁটি ৭ থেকে ১০ সেন্টিমিটার মাটির গভীরে পুঁতে দিতে হবে। এ সময় জমিতে ২ থেকে ৩ সেন্টিমিটার পানি রাখতে হবে।

পানি ব্যবস্থাপনা: সঠিক সময়ে সেচ দিলে ১৫-২৫ ভাগ ফলন বাড়ে। চারা রোপণের পর থেকে কুশি গজানো পর্যন্ত ছিপছিপে পানি রাখলেই হবে। কাইচ থোড় আসার আগেই পানির পরিমাণ দ্বিগুণ করতে হবে। সার প্রয়োগের দুই-তিন দিন পর সেচ দিলে সারের কার্যকারিতা বাড়ে। কুশিস্তরে জমিতে পানি না রাখলে কুশি বাড়ে। ধান পাকার সময় ধান শক্ত হলেই জমি থেকে পানি সরিয়ে দিতে হবে।

আগাছা দমন: সার দেওয়ার আগে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, আগাছা ২০-২৫ শতাংশ ফলন কমিয়ে দেয়। কারণ আগাছা পুষ্টি শোষণ করে। সঠিক সময়ে আগাছা দমন করলে ২০-২৫ শতাংশ ফলন বাড়ে।

পোকা ও রোগ দমন: সময়মতো পোকা ও রোগ দমনের মাধ্যমে ধানের ফলন শতকরা ১৫ থেকে ২০ ভাগ বাড়ানো যায়। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ১৭৫টি ধানের ক্ষতিকর পোকা শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। এসব পোকার মধ্যে ২০ থেকে ৩০টি পোকা সচরাচর ধান ক্ষেতে দেখা যায় এবং আখ-ফসলের ক্ষতিসাধন করে। এসব পোকার মধ্যে মাজরা, পামরি, বাদামি গাছফড়িং এ তিনটি পোকা একক বা বাদামি গাছফড়িংয়ের সঙ্গে যৌথভাবে ধান-ফসলের মারাত্মক ক্ষতি করে থাকে।

এছাড়া ধানের অন্যান্য ক্ষতিকর পোকাগুলো হলো- পাতা মোড়ানো চুঙ্গি, সবুজ পাতা ফড়িং, গান্ধী, পাতামাছি, নলিমাছি, ঘাসফড়িং, ছাতরা পোকা, লেদা পোকা, থ্রিপস, শীষ কাটা লেদা পোকা ইত্যাদি। এসব পোকা দমনের জন্য হাতজাল, আলোর ফাঁদ ব্যবহার, জমিতে ডালপালা পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করা, গাছফড়িংয়ের আক্রমণ দেখা দিলে জমি থেকে পানি সরিয়ে দেওয়া এবং পোকার আক্রমণ বেশি হলে অনুমোদিত মাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগসহ সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পোকা দমন করতে হবে। দেশে ধানের এ পর্যন্ত ৩১টি রোগ শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। ধানের অধিক ক্ষতিকর রোগের মধ্যে টুংরো, পাতাপোড়া, ব্লাস্ট, খোলপোড়া ও খোলপচা ইত্যাদি লক্ষ্য করা যায়।

এসব রোগ দমনের জন্য প্রত্যায়িত পরিচ্ছন্ন বীজ ব্যবহার, বালাই সহনশীল জাতের চাষ, বীজ ও চারা শোধন এবং সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগসহ সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সময়মতো রোগ দমনের ব্যবস্থা নিতে হবে।

ধানে চিটা প্রতিরোধ: ধানের চিটার জন্য ফলন কম হয়। ধানে চিটা প্রতিরোধ করে ফলন বাড়ানো যায়। ধানগাছের জন্য অসহনীয় ঠাণ্ডা বা গরম, খরা, ঝড়, তুফান ইত্যাদির জন্য চিটা হয়। এ ছাড়া সেচের অভাব, সুষম সারের অভাব, পরাগায়ণে বিঘ্ন, পরিচর্যার অভাব ইত্যাদির জন্য চিটা হয়।

চিটা প্রতিরোধের জন্য ৪০-৫০ দিন বয়সের চারা পৌষ ও মাঘ মাসের মধ্যে রোপণ করা। কাইচথোড়, শীষ বের হওয়া ও ফুল ফোটার সময় সেচ দিতে হবে। জিঙ্ক ও বোরনের সর্বশেষ প্রযুক্তি চিলেটেড জিঙ্ক ও দ্রবণীয় বোরন প্রয়োগ করলে ধানে চিটা হয় না। ধানের চারা রোপণের ২০-২২ দিন পর প্রথমবার এবং ৪০-৪৫ দিন পর দ্বিতীয়বার এক লিটার পানিতে এক গ্রাম লিবরেল জিঙ্ক ও দুই গ্রাম লিবরেল বোরন একসাথে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।

ফসল কর্তন: জমিতে ধান পেকে গেলে বা ধান গাছ শুকিয়ে গেলে বিলম্ব না করে ধান কাটা উচিত। বিলম্ব করলে কিছু ধান ঝরে পড়তে পারে। শীষের অগ্রভাগে শতকরা ৮০ ভাগ ধানের চাল শক্ত ও স্বচ্ছ হলে ধান কাটার ব্যবস্থা নিতে হবে।

ফলন: ভালোভাবে যত্ন নিলে বোরো মৌসুমে একরপ্রতি তিন থেকে সাড়ে তিন টন ধান উৎপাদন করা সম্ভব।

বাংলাদেশ সময়: ০০১৮ ঘণ্টা,  ডিসেম্বর ১৯, ২০১৫
এমআরএম/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।