ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

খুঁজেও মেলে না শঙ্খবতী-বরঙ্গী ধান

সুকুমার সরকার, সিনিয়র স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১১৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২২, ২০১৫
খুঁজেও মেলে না শঙ্খবতী-বরঙ্গী ধান ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: ‘তথাকথিত আধুনিকতার নামে আজ আমাদের দেশ থেকে বরঙ্গী ধানের মতো শঙ্খবতী, দাঁতকানি, কটকচূড়া, রানাশাইল, সওরাজ, রাজভোগ, গাঞ্জিয়া, চামারাসহ সুন্দর সুন্দর নামের সব ধান হারিয়ে গেছে বা হারিয়ে য‍াওয়ার পথে। এসব ধান শুধু নামেই সুন্দর নয়, স্বাদেও অনন্য।



এমন আক্ষেপ শুধু রিসার্চ ইনেসিয়েটিভ, বাংলাদেশ (রিইবি) প্রকল্প পরিচালক সুরাইয়া বেগমের একার নয়- দেশের প্রবীণ অনেকেরই রয়েছে এই আক্ষেপ।

সোমবার (২১ ডিসেম্বর) দুপুরে বাংলানিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রিইবি’র প্রকল্প পরিচালক সুরাইয়া বেগম বলেন, আমরা দিন দিন ধান বীজের ব্যাপারে পরনির্ভর হতে বাধ্য হচ্ছি। বিদেশ থেকে আমদানি করা ধান বীজ দিয়ে চাষাবাদ করছি। এসব ধান বীজের ওপর আমাদের কোনো অধিকার নেই। এমনকি আমাদের নিজস্ব পেটেন্ট অধিকার আর থাকছে না।  

আমাদের অখণ্ড বাংলায় এক সময় পনের হাজারেরও বেশি বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের দেশি জাতের ধানের সম্ভার ছিল। এসব ধানের বিশেষ মূল্যায়ন আজও হয়ে ওঠেনি। দেশি চালের ভাত-মুড়ি-মুরকি-খই-চিড়া বা পায়েসের স্বাদ প্রবীণদের মনের গহীনে গেঁথে আছে আজও। বাংলার ঘরে ঘরে বারো মাসে তেরো পার্বণে বিভিন্ন স্বাদের চাল দিয়ে তৈরি হতো মুখরোচক পিঠা থেকে শুরু করে পোলাও-বিরিয়ানি-খিচুড়ি- এভাবেই আক্ষেপ ঝরে পগে সুরাইয়া বেগমের কণ্ঠে।

ফেলনা ছিল না সেসব জাতের ধানের খড়ও। দেশের গবাদি পশুর প্রধান খাবার ছিল ধানের এই খড়। এসব খাবারে অরুচি ছিল না গবাদি পশুর। কিন্তু এখন ইরি-বোরো খড়ের সঙ্গে নানা অনুষঙ্গ মিশিয়ে তবেই গবাদি পশুর খাবার তৈরি করতে হয় বলেও জানান তিনি।

বাংলাদেশের নিজস্ব চাল দিয়ে বানানো হতো নানা পদের পিঠা। আমদানি করা চাল বা বিদেশি পেটেন্টের চাল দিয়ে পিঠা বানানো হলে তা মুখরোচক হয় না। দেশের ঐহিত্যবাহী চালের খাবার স্বাদের কাছে তা তুলনাযোগ্যই না – যোগ করেন আরইবি’র এই প্রকল্প পরিচালক।

তিনি বলেন, বরঙ্গী ধানের চাল দিয়ে মূলতঃ মুড়ি তৈরি করা হতো। যেমন দেখতে, তেমন তার স্বাদ। মুড়ির জন্যই বরঙ্গী ধানের আবাদ করতেন সবাই। এখন মুড়ি বানাতে চালের সঙ্গে ইউরিয়া মেশাতে হয়। নইলে মুড়ির রূপ নেয় না- চাল ভাজার আকার হয়।

বর্তমানে আমাদের চাষাবাদ রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও পুরোপুরি সেচ নির্ভর হয়ে পড়েছে বলেও মত দেন সুরাইয়া বেগম। চাষাবাদে বিপুল পরিমাণ খরচ বেড়ে গেছে। বিদেশি বীজের ধান আবাদ করার ফলে আমাদের জমির উর্বরতা শক্তি দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। ব্যবহার করতে হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত সার ও কীটনাশক।

অথচ আমাদের দেশি জাতের আবাদে সার-কীটনাশক-জলসেচের এতো প্রয়োজন হতো না। বর্ষাকালে পানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ধানগাছ ১২/১৪ হাত বেড়ে ধানের ছড়া বের হতো। এখন সেসব ধান খুঁজে পাওয়া দায়। বর্তমানের ধান গাছ এভাবে বাড়তে পারে না বলেও জানান তিনি।

সুরাইয়া বেগম আরও বলেন, কৃষকের আবাদে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় তারা ফসল বিক্রি করে খরচ কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। অনেকেই কৃষিকাজ বাদ দিয়ে শহরমুখী হচ্ছেন। গ্রামে কৃষকরা ফসলের দাম পাচ্ছেন না। মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা সিংহভাগ মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছেন। ঢাকায় এসে তারা হয় রিকশাচালক না হয় রাজমিস্ত্রির সহযোগী হচ্ছেন। তাই আমরা বলে থাকি, কৃষকের চোখে পানি আর মাটির কান্না। ’

তিনি বলেন, কৃষকদের বাঁচাতে হলে রাষ্ট্রের ভূমিকা রয়েছে। যেমন, কিছু জেলে আছেন যারা শুধু ইলিশ মাছ শিকার করেন। সরকার ইলিশ শিকার নিষিদ্ধের তিনমাস যেমন খাদ্য সহায়তা দিয়ে থাকেন। তেমনি প্রান্তিক কৃষকদেরও সাহায্য দিতে হবে।

সুরাইয়া বেগম কৃষকদের নানা দুরাবস্থা তুলে ধরে বলেন, দিন দিন কৃষি জমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। প্রতিবছর ১ শতাংশ হারে চাষের জমি কমে যাচ্ছে।

কৃষকদের বাঁচাতে কয়েকটি প্রস্তাবনা তুলে ধরেন এই প্রকল্প পরিচালক। সেগুলো হলো, কৃষি উপকরণ কেনার সময় রশিদ প্রদান, সরকার নির্ধারিত খাজনা আদায় ও কৃষকদের অসুবিধা শুনে তা দূর করতে কৃষি কর্মকর্তাদের নিয়মিতভাবে কৃষকদের সঙ্গে বৈঠক করা।

কৃষকদের প্রতি পরামর্শ দিয়ে সুরাইয়া বেগম বলেন, সমবায় গঠন করে নিজেদের মধ্যে বৈঠক করে সর্বসম্মতভাবে সমস্যাগুলো দূর করতে পারে কৃষকরা। বীজের ওপর নিজেদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য কমিউনিটি বীজ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, কেননা হাইব্রিড বীজ সংরক্ষণ করা যায় না।

বিষমুক্ত সবজি চাষ করতে রাসায়নিক সার বাদ দিয়ে জৈব সারসহ ভার্মিকম্পোজ- কেচো দিয়ে তৈরি সারের ওপর জোর দেন তিনি। দেশের অনেক কৃষক ভার্মিকম্পোজ করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন বলেও জানান সুরাইয়া বেগম।

একই সঙ্গে তিনি বলেন, অধিক উৎপাদনশীল ধানের আবাদ করে কৃষিতে আমরা বিপ্লব ঘটিয়েছে। এটা ঠিক যে হালে উদ্ভাবিত ধানের চাষ করে কৃষক বেশি ফসলতা পাচ্ছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানি হচ্ছে। আসছে বৈদেশিক মুদ্রা।

তিনি আরও বলেন, কৃষি বলতে এখন আর শুধু ধান-পাট চাষ নয়। এখন কৃষক দেখছে কি করে চাষাবাদ থেকে বেশি টাকা আয় করা যায়। তাই তারা এখন শাক-সবজি, ফল-মূল ও মাছ চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশ সময়: ০১০২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর  ২২, ২০১৫
এসএস/এমজেএফ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।