গাজীপুর: টঙ্গীর তুরাগ তীরে শুক্রবার (৮ জানুযারি) বাদ ফজর আম বয়ানের মধ্যে দিয়ে শুরু হচ্ছে এবারের ৫১তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম দফা। ইতোমধ্যে শীত ও যানজট উপেক্ষা করে লাখ লাখ মুসল্লি বাস, ট্রাক, পিক-আপ, লঞ্চ ও ট্রেনে করে আসছেন ইজতেমার ময়দানে।
বিদেশি মুসল্লিরাও আসছেন। তাদের অনেকেই গত কয়েকদিন আগেই এসে পৌঁছেছেন ময়দানে নিজ নিজ কামরায়। ১ম ধাপে আখেরি মোনাজাতের দিন পর্যন্ত মুসল্লিদের এ আগমন অব্যাহত থাকবে। ১০ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এবারের প্রথম দফার ইজতেমা।
বৃহস্পতিবার সকাল থেকে টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানে থেকে দেখা গেছে রাতের কনকনে শীত ও কুয়াশা উপেক্ষা করে বিভিন্ন জেলার হাজার হাজার মুসল্লি বাস, ট্রেন, ট্রাক, পিকআপ ও লঞ্চে করে টঙ্গীর ইজতেমাস্থলে পৌঁছাচ্ছেন। তাদের কাঁধে ও মাথায় প্রয়োজনীয় মালামালের ব্যাগ, বস্তা, লাগেজ ও কাপড়ের গাট্টি।
পটুয়াখালী থেকে আসা মুসল্লি আবদুল কাশেম আলী জানান, ‘ইজতেমায় তিন দিনের জামায়াত ও আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে বাস রিজার্ভ করে ৫২ জনের একটি দল ইজতেমার ময়দানে এসে পৌঁছেছেন। পথে কোন সমস্যা হয়নি। ইবাদত বন্দেগি ও আখেরি মোনাজাত শেষে ফের বাস নিয়ে এক সাথে সবাই বাড়ি ফিরে যাবো। আল্লাহ নৈকট্য লাভের আসায় এখানে আসা। ’
বিশ্ব ইজতেমার মুরুব্বি গিয়াস উদ্দিন জানান, বিশ্ব ইজতেমার ময়দান সম্পূর্ণ প্রস্তুত। মুসল্লিরা যে যেভাবে পারছেন ময়দানে আসছেন। গত কয়েক দিন ধরেই দেশী-বিদেশি মুসল্লিরা ময়দানে এসে যার যায় খিত্তা ও কামরায় অবস্থান নিচ্ছেন। বিদেশি মুসল্লিরা ইজতেমা ময়দানের উত্তর-পশ্চিম পাশে তুরাগ তীরে তাঁদের তাবুতে অবস্থান নিচ্ছেন। এছাড়া ১৭ জেলার লাখ লাখ মুসল্লি এসে ময়দানে নির্ধারিত খিত্তায় অবস্থান নিয়েছেন। সভাপতিহীন বিশ্ব ইজতেমার এতো বড় আয়োজন প্রতি বছরই অত্যন্ত সু-শৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন করা হয়। এজন্য আমাদের তরফে কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়। পুরো ইজতেমা ময়দানকে মুরুব্বিদের পরামর্শে সাজানো হয়। ময়দানে জেলাওয়ারি মুসুল্লিদের অবস্থান, রান্না-বান্না করার স্থান, টয়লেট, অজুখানা, গোসল খানা সবই সুনির্দিষ্ট করা থাকে।
বিদেশি নিবাসের পূর্বপাশে আখেরি দোয়া মঞ্চ ও ময়দানের পশ্চিমে বয়ান মঞ্চ থেকে দক্ষিণে তুরাগ তীরে বয়ান ও নামাজের মঞ্চ স্থাপন করা হয়েছে। তুরাগ তীরে ভাসমান সেতুনির্মাণ, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির লাইন সংযোগসহ সকল কাজ শেষ হয়ে গেছে।
২৭ খিত্তায় ১৭ জেলার মুসল্লি
এবারের ইজতেমায় মোট দুই দফায় ৩২টি জেলার মুসল্লিরা অংশ নেবেন। প্রথম দফায় ঢাকা জেলাসহ ১৭টি এবং দ্বিতীয় দফায় ঢাকা জেলাসহ ১৬টি জেলা অংশ নেবে ইজতেমায়। ঢাকা জেলার মুসল্লিরা ইজতেমার দুই পর্বেই অংশ নেবেন। প্রথম দফার ইজতেমার অংশ নিতে ইতোমধ্যেই ১৭ জেলার মুসল্লিদের জন্য ময়দানকে ২৭টি খিত্তায় ভাগ করা হয়েছে।
যানবাহন চলাচল ও পার্কিং
টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমার ৮ থেকে ১০ জানুয়ারি প্রথম ধাপ ও ১৫ থেকে ১৭ জানুয়ারি দ্বিতীয় ধাপ উপলক্ষে মুসল্লিদের নিরাপদ যাতায়াত এবং সুষ্ঠুভাবে যানবাহন চলাচলের সুবিধার্থে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে পুলিশ বিভাগ।
৯ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৬টা হতে ১০ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৬টা এবং ১৬ জানুয়ারি সন্ধ্যা হতে ১৭ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত আশুলিয়া ব্রিজ হতে আব্দুল্লাহপুর হয়ে প্রগতি সরণি এবং টঙ্গী ব্রিজ হয়ে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত সকল প্রকার যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। তবে বিমানযাত্রী ও ক্রু বহনকারী যানবাহন, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ও এ্যাম্বুলেন্স চলতে পারবে এই পথে। এছাড়া ঘোড়াশাল কালীগঞ্জ-পূবাইল হয়ে আগত যানবাহন টঙ্গী রেলওয়ে স্টেশনের পূর্ব মরকুন ( কে-২ ফ্যাক্টরি) পর্যন্ত চলাচল করতে পারবে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক থেকে ঘোড়াশাল হয়ে সাধারণ যানবাহনসমূহ ওই রাস্তা এড়িয়ে কাচপুর/যাত্রাবাড়ি সড়কে চলাচল করতে পারবে। ইজতেমায় গমনেচ্ছু মুসল্লি এবং উত্তরার অধিবাসী, বিমানযাত্রী ওবিমান ক্রু বহনকারী যানবাহন, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ও নিরাপত্তাবাহিনীর গাড়ি বা এ্যান্বুলেন্স ব্যতীত সকল প্রকার যানবাহন চালকদের বিমানবন্দর সড়কের পরিবর্তে বিকল্প হিসেবে মিরপুর-সাভার সড়ক ব্যবহার করতে হবে। ঢাকা মহানগর থেকে যে সকল মুসল্লি পায়ে হেঁটে ইজতেমাস্থলে যাবেন তাদের হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর গোল চক্কর- আজমপুর- আব্দুল্লাহপুর হয়ে টঙ্গী ব্রীজ পরিহার করে তুরাগ নদীর উপর নির্মিত বেইলি ব্রীজ অথবা কামারপাড়া ব্রীজ দিয়ে ইজতেমা মাঠে যাতায়াতের জন্য বলা হয়েছে।
মুসল্লি বহনকারী গাড়ি পার্কিং
গাজীপুর জেলার যানবাহনকে টঙ্গীর কাদেরিয়া টেক্সটাইল মিল কম্পাউন্ড, মেঘনা টেক্সটাইল মিলের পাশে রাস্তার উভয় পাশে, শফিউদ্দিন সরকার একাডেমি মাঠ, শফিউদ্দিন সরকার একাডেমি সংলগ্ন ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পশ্চিম পাশে টিআইসি মাঠ, ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজ মাঠ, জয়দেবপুর চৌরাস্তা (তেলিপাড়া) ট্রাকস্ট্যান্ড, চান্দনা হাই স্কুল মাঠ, টঙ্গীর কে-২ (নেভী) সিগারেট ফ্যাক্টরি সংলগ্ন খোলা স্থানে পার্কিং করতে হবে। ঢাকা মহানগর এলাকা থেকে আগত যানবাহনকে- গাউছুল আজম এভিনিউয়ে পার্কিং করতে হবে (১৩নং সেক্টর রোডের পূর্ব প্রান্ত হতে পশ্চিম প্রান্ত হয়ে গরীবে নেওয়াজ রোড), ঢাকা বিভাগের যানবাহনকে- সোনারগাঁও জনপথ চৌরাস্তা হতে দিয়াবাড়ি খালপাড় পর্যন্ত, সিলেট বিভাগের যানবাহনকে উত্তরার ১২ নং সেক্টরের শাহ মখদুম এভিনিউ, খুলনা বিভাগের যানবাহনকে- উত্তরার ১৫ এবং ১৮ নং সেক্টরের খালি জায়গা, রংপুর বিভাগের যানবাহনকে- কামারপাড়া সংলগ্ন মাঠ, ও ১০ নং সেক্টরের খালি জায়গা, রাজশাহী বিভাগের যানবাহনকে প্রত্যাশা হাউজিং, বরিশাল বিভাগের যানবাহনকে-ধউর ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় (আশা বিশ্ববিদ্যালয়ের খালি জায়গা এবং ১৫ এবং ১৮ নং সেক্টরের খালি জায়গা এবং ঢাকা জেলার যানবাহনকে আশুলিয়া কলেজ মাঠ এবং আশুলিয়া হাইস্কুল মাঠে পার্কিং করতে হবে।
তবে মহাখালী ক্রসিং থেকে টঙ্গী হয়ে গাজীপুর চৌরাস্তার পর্যন্ত রাস্তার দুইপাশে, আব্দুল্লাহপুর থেকে বাইপাইল পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে, প্রগতি সরণিস্থ মধ্য বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রগতি সরণিস্থ রাস্তার দুই পাশে যানবাহন পার্কিং করা যাবে না।
স্বাস্থ্যবিভাগের নানা উদ্যোগ ও ছুটি বাতিল
বিশ্ব ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের সার্বক্ষণিক চিকিৎসা সেবা দিতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে স্বাস্থ্যবিভাগ। ৭ জানুয়ারি থেকে ইজতেমা চলাকালীন পর্যন্ত জেলার কর্মরত স্বাস্থ্য বিভাগের সকল চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে ৫০ শয্যা বিশিষ্ট টঙ্গী সরকারি হাসপাতালকে ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়েছে। এ ছাড়া জরুরি চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে হৃদরোগ বিভাগ, অর্থোপ্যাডিক ও ট্রমা সেন্টার এবং অ্যাজমা ও বক্ষব্যাধি ইউনিট খোলা হয়েছে। হাসপাতালে ১৪টি এ্যাম্বুলেন্স স্ট্যান্ডবাই থাকবে। ইজতেমা মাঠ সংলগ্ন মুন্নু গেইট, বাটা গেইট, এটলাস হোন্ডা গেইট এবং বিদেশি নিবাস এলাকায় চারটি ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্প স্থাপন করে মুসল্লিদের চিকিৎসা দেয়া হবে। ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতে ১৫টি স্যানিটেশন টিম এবার ইজতেমা মাঠের আশপাশ এলাকার হোটেল ও রেস্তোরা যেন মান সম্মত খাবার পরিবেশন করে সে লক্ষ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে। এছাড়া ইজতেমা শুরুর আগের দিন ৭ জানুয়ারি থেকে ইজতেমা চলাকালীন জেলার কর্মরত স্বাস্থ্য বিভাগের সকল চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। এদিকে মুন্নু নগরসহ ইজতেমা ময়দানের আশে-পাশের এলাকায় সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠন মুসল্লিদের স্বাস্থ্য সেবা দিতে ফ্রি-মেডিক্যাল ক্যাম্প স্থাপন করছে।
কার খিত্তা কোথায়
ইজতেমার প্রথম ধাপে আগত ১৭টি জেলার মুসল্লিরা বিভিন্ন খিত্তায় অবস্থান নেবেন। এর মধ্যে ঢাকা জেলা ১ থেকে ৬ নং খিত্তায়, শেরপুর ৭ নং খিত্তা, নারায়ণগঞ্জ ৮ ও ১১ নং খিত্তা, নীলফামারী ৯ নং খিত্তা, সিরাজগঞ্জ ১০ নং খিত্তা, নাটোর ১২ নং খিত্তা, গাইবান্ধা ১৩ নং খিত্তা, লক্ষীপুর ১৪ ও ১৫ নং খিত্তা, সিলেট ১৬ ও ১৭ নং খিত্তা, চট্রগ্রাম ১৮ ও ১৯ নং খিত্তা, নড়াইল ২০ নং খিত্তা, মাদারীপুর ২১ নং খিত্তা, ভোলা ২২ ও ২৩ নং খিত্তা, মাগুড়া ২৪ নং খিত্তা, পটুয়াখালী ২৫ নং খিত্তা, ঝালকাঠি ২৬ নং খিত্তা এবং পঞ্চগড় জেলার মুসল্লিরা ২৭ নং খিত্তায় অবস্থান নেবেন।
এছাড়া ১৫ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া ইজতেমার দ্বিতীয় ধাপে ঢাকা জেলার মুসল্লিরা ১ থেকে ৭ নং খিত্তা, ঝিনাইদহ ৮ নং খিত্তা, জামালপুর ৯ ও ১১ নং খিত্তা, ফরিদপুর ১০ নং খিত্তা, নেত্রকোনা ১২ ও ১৩ নং খিত্তা, নরসিংদী ১৪ ও ১৫ নং খিত্তা, কুমিল্লা ১৬ ও ১৮ নং খিত্তা, কুড়িগ্রাম ১৭ নং খিত্তা, রাজশাহী ১৯ ও ২০ নং খিত্তা, ফেনী ২১ নং খিত্তা, ঠাকুরগাঁও ২২ নং খিত্তা, সুনামগঞ্জ ২৩ নং খিত্তা, বগুড়া ২৪ ও ২৫ নং খিত্তা, খুলনা ২৬ ও ২৭ নং খিত্তা, চুয়াডাঙ্গা ২৮ নং খিত্তা এবং পিরোজপুর জেলার মুসল্লিরা ২৯ নং খিত্তায় অবস্থান নেবেন।
ঢাকা জেলার মুসল্লিরা ইজতেমার দুই ধাপেই অংশ নিতে পারবেন।
বাংলাদেশ সময়: ০১১৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৭, ২০১৬
আরআই
** ইজতেমাস্থলে আরেক মুসল্লির মৃত্যু
** সরাইলে ইজতেমার বাস খাদে পড়ে নিহত ১
** ইজতেমাস্থলে মুসল্লির মৃত্যু
** ইজতেমার মাঠে আসতে শুরু করেছেন মুসল্লিরা