ঢাকা: ব্রিটিশ সংসদের সদস্য টিউলিপ সিদ্দিকের সঙ্গে স্পিকারের রাগারাগির খবর ইতোমধ্যে বেশ ছড়িয়েছে।
খবর বেরিয়েছে, শুক্রবার (৮ জানুয়ারি) হাউজ অব কমন্সে ইউনিভার্সেল ক্রেডিট ওয়েলফেয়ার রিফর্ম নিয়ে বিতর্ক চলছিল।
৭ মাসের সন্তানসম্ভবা টিউলিপ বিনয়ীভাবে দুঃখ জানান। কিন্তু তাকে কিছু বলার সুযোগও না দিয়ে এলিনর বলেন, অন্তঃস্বত্ত্বা হওয়ার অযুহাত দেখাবেন না। এ অযুহাত দেখিয়ে আপনি সব নারীকে ছোট করছেন।
এমন ঘটনায় আহত হয়েছেন অনেকেই। সেদেশের পত্রিকাগুলোও এলিনরের সমালোচনায় মুখর রয়েছে। নারী হয়ে নারীকে অপমানের চেষ্টায় অবাক হয়েছেন তারা, দুষছেন এলিনরকে। বৈষম্যমূলক মানসিকতার কারণেই তিনি টিউলিপের প্রতি চড়াও হয়েছেন বলে বলাবলি হচ্ছে।
বিনয়ী টিউলিপের মনের অবস্থা ভেবে অনেকেই কষ্টও পাচ্ছেন।
তবে ততটা কষ্ট হয়তো পাচ্ছেন না বাংলাদেশি কিছু সাংবাদিক। বাংলানিউজের এ প্রতিবেদকসহ যারা বাংলাদেশে টিউলিপের দেওয়া বক্তব্য মনোযোগে শুনেছেন।
কারণ টিউলিপই বলে গেছেন- ব্রিটেনের মতো সভ্য দেশেও কতটা বৈষম্য এবং গঞ্জণা সয়ে সয়ে এগুচ্ছেন তারা।
নিজের দেশে এসে নিজের মানুষ পেয়ে অকপট সারল্য পেয়ে বসেছিল তাকে- সম্প্রতি বাংলাদেশে কাটানো দিনগুলোতে টিউলিপের কথা ও আচরণে তা ধরা পড়ছিল। মনের কথা সাবলীলভাবে বলে দিচ্ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাতনী।
টিউলিপ বলছিলেন, ব্রিটেনে তাদরে প্রতি বৈষম্যের কথা। শ্বেতাঙ্গ নন, ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত বাংলাদেশি তিনি, তাও আবার মুসলিম তরুণী। শ্বেতাঙ্গ নন বলে, নারী বলে, মুসলিম বলে-তার প্রতিকূলতা আর চ্যালেঞ্জও পদে পদে।
বৈষম্যের শিকার যেন না হন, নির্বাচনের আগে শুভাকাঙ্খীরা টিউলিপের নাম বদলে ফেলার পরামর্শ দিলেন। ‘টিউলিপ সিদ্দিক’ নামটি বদলে স্বামীর (ক্রিস পার্সি) নাম থেকে ‘টিউলিপ পার্সি’ হিসেবে পরিচিত হতে বলেন তারা, রাজি হননি টিউলিপ। স্পষ্ট করেই বলে দিলেন, ‘আমি মুসলমান। জিতলে সত্যি পরিচয়েই জিতবো, পরিচয় লুকিয়ে জেতার দরকার নেই। ’
সততার মূল্য পেয়েছেন টিউলিপ, জিতেছেন গুরুত্বপূর্ণ আসনটিতে। তাই বাংলাদেশে এসে বলতে পারলেন, ‘আসলে মুসলমান হলে ভোট পাওয়া যায় না- এ কথাটি পুরোপুরি সত্য নয়। ’
২৩ ও ৩০ ডিসেম্বর রাজধানীতে পৃথক দু’টি অনুষ্ঠানে টিউলিপ বলছিলেন, বাংলাদেশের চেয়ে ব্রিটেনে নারীদের অবস্থা যে অনেক ভালো, তা নয়। ব্রিটিশ সংসদে ৬৫০ এমপি’র মধ্যে মাত্র ১৬০ জন নারী। আমি সেখানে বলেছি, সংসদে নারীর সংখ্যা বাড়াতে হবে। নারীদের সেখানে অনেক বৈষম্যে পড়তে হয়, গুরুত্ব কম পান তারা। গুরুত্বপূর্ণ কাজে তাদের প্রতি ভরসা করতে কম দেখা যায়। যা ঠিক নয়। অনেক যোগ্য নারী রয়েছেন, কিন্তু তারা কাজের বা যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ পান না।
প্রার্থী হিসেবে মিডিয়া কাভারেজ পেতেও বেগ পেতে হয়েছিল বলে জানান তিনি।
বলেন, সেখানে নারী সাংবাদিক অনেক কম ছিল, এখন কেউ কেউ আসছেন এ পেশায়। মিডিয়াগুলো নারী প্রার্থীদের কাভারেজ সেভাবে দিতে চাইত না, এখন সে অবস্থারও কিছুটা পরিবর্তন হচ্ছে।
বৈষম্য প্রসঙ্গে অতীত-বর্তমান তুলনায় টিউলিপ বলেন, ‘আগে আরও বেশি বৈষম্য ছিল। বাসা ভাড়া, স্কুলে ভর্তি-এসবে খুব বৈষম্য হত। এখন কিছুটা কমেছে। বাসাবাড়ি ভাড়া নিতে গিয়ে বাংলাদেশিরা সবচে বেশি ঝামেলা পোহান। পছন্দসই বাসা নিজ সামর্থ্যের মধ্যে পাওয়া খুব মুশকিল। চাকরি পেতেও সমস্যা। অবশ্য চাকরির বিষয়টি কেবল বৈষম্য থেকে নয়, সারাদেশের চাকরির বাজার মন্দা। তাই সবারই চাকরি পেতে কমবেশি সমস্যা হয়।
বাল্যবিবাহ, নারীদের আত্মবিশ্বাসের কমতির দিক থেকেও বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের সঙ্গে ব্রিটেনের পার্থক্য তেমন নেই বলে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানালেন।
টিউলিপ বলেন, আমি মেয়েদের সঙ্গে কথা বলেছি। ব্রিটেনের মেয়েরাও উপমহাদেশের মেয়েদের মতোই ভয় পায়। আত্মবিশ্বাস কম তাদেরও। তারাও বলে, এটি মা-বাবা-শিক্ষক অনুমতি দেবেন না। উন্নত দেশ হলেও সেদেশের সব মেয়ে দৃঢ়চেতা ও সাহসী নয়।
সব দেখে-শুনে বরং বাংলাদেশের নারীদের নিয়ে টিউলিপ অনেক আশাবাদী। বাংলাদেশের মেয়েরা এখন ক্রিকেট-ফুটবলেও আন্তর্জাতিক অবস্থান তৈরি করছে। দেশের বিভিন্ন শীর্ষস্থানে পৌঁছেছেন নারীরা- দেখে অনুপ্রাণিত হন টিউলিপ।
বলেন, ব্রিটেনে জন্ম ও বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি- বাংলাদেশে বরং ভালো, এদেশের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী। এটি নিয়ে আমি গর্বিত। আমার খালা (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) আমার ‘রোল মডেল’। শুধু মা-খালা নন, স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, এভারেস্টজয়ী ওয়াসফিয়া নাজরিন, ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিমকে দেখেও আমি অনুপ্রাণিত হই।
এমনিতেই নির্বাচনী ক্যাম্পেইন পরিশ্রমের, তার মধ্যে টিউলিপের প্রতিবন্ধকতা ছিল আরও বেশি।
সে অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, আমার আগে যিনি এ আসনে ছিলেন, তিনি বিখ্যাত অভিনেত্রী ছিলেন, দুইবারের অস্কারজয়ী। তাই আমাকেও জিজ্ঞেস করতো সবাই, তোমার পরিচয় কী? তুমি কি কখনো অভিনয় করেছো? আমি হেসে বলতাম, ‘বাংলাদেশের নাটকে অভিনয় করেছি। ’
‘আসলে বাংলাদেশিদের শারীরিক গড়নের কারণে তাদের কমবয়সী ও ছোট দেখায় বলে ভোটাররা আমার বয়স জানতে চাইতো। ’
এ ক’দিনে অনেক প্রশ্নের মাঝে বেফাঁস কোন মন্তব্য কেউ বের করতে পারে নি বুদ্ধিমতি টিউলিপের মুখ থেকে। কারও নামে বিষোদগার না করে, কেবল সত্য বলেও যে রাজনীতি করা যায়- সে দৃষ্টান্তই যেন রাখতে চান শেখ রেহানার কন্যা।
রাজনীতি করতে চেয়েছিলেন-করেছেন, এমপি হতে চেয়েছেন- হয়েছেন। কিন্তু তার জীবনে এখন সবচে বড় লক্ষ্য- নিজেকে ভালো ‘মা’ হিসেবে প্রমাণ করা- জানালেন তিনি।
বললেন, ‘আমার মেয়ে হবে, আমি মেয়েই চাই। যেকোন মূল্যে আমি একজন ভালো ‘মা’ হতে চাই। আমার মেয়ে যেন আমাকে কাছে পায়। তাকে আমি বাংলা শেখাবো, সিলেটি ভাষা শেখাবো। সে হবে আত্মবিশ্বাসী। মানুষের সেবা করবে সে। যে শিক্ষা মা-খালা আমাকে দিয়েছেন, আমার নানা যে আদর্শে ছিলেন, সেসব দেব মেয়েকে। ’
এভাবেই নিজের স্বপ্ন জানানো টিউলিপ শুক্রবার ‘অন্ত:স্বত্ত্বা’ বলে ‘অযুহাত’ দেখানোর অভিযোগ শুনলেন। কিন্তু অভিজ্ঞতা বলে, আক্ষেপের কিছু নেই। এসবে ভ্রুক্ষেপ করার মেয়ে নন টিউলিপ। নিজের সম্পর্কে তিনি বলেন, আমি ধৈর্য্যশীল, বিনয়ী, দৃঢ়চেতা, আত্মবিশ্বাসী ও নিরহঙ্কারী।
আর যে মেয়ের মাঝে এতসবের সংমিশ্রণ, কোন এলিনর লাইং তাকে দমাতে পারবে না বলে অভিজ্ঞরা আশা করছেন। তারা বলছেন, অনেক কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে আলোতে প্রস্ফুটিত টিউলিপ, ভালোভাবে ডিঙোবেন বাকি পথটুকুও।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৯, ২০১৬
এসকেএস/জেডএম