ঢাকা, সোমবার, ২৩ ভাদ্র ১৪৩২, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

জাতীয়

নির্বাচনী সংবাদ সংগ্রহে নিরাপত্তা চাইলেন সাংবাদিকরা, আশ্বাস উপদেষ্টার

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:২৮, সেপ্টেম্বর ৭, ২০২৫
নির্বাচনী সংবাদ সংগ্রহে নিরাপত্তা চাইলেন সাংবাদিকরা, আশ্বাস উপদেষ্টার নির্বাচন-পূর্ব, নির্বাচনকালীন ও নির্বাচন পরবর্তী সময়ে মিডিয়ার ভূমিকা বিষয়ে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের ‍উপদেষ্টা মাহফুজ আলম | ছবি: শাকিল আহমেদ

প্রতিবারই নির্বাচনের সময় সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হন সাংবাদিকরা। কোথাও কোথাও হামলার শিকারও হন।

এতে অবাধ তথ্য প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়, সুযোগ সৃষ্টি হয় কারচুপির। তাই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংবাদ সংগ্রহে সরকারের কাছে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা চেয়েছেন গণমাধ্যমকর্মীরা।

রোববার (৭ সেপ্টেম্বর) বিকেলে চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের সম্মেলন কক্ষে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় আয়োজিত নির্বাচন-পূর্ব, নির্বাচনকালীন ও নির্বাচন পরবর্তী সময়ে মিডিয়ার ভূমিকা বিষয়ে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় এই আহ্বান জানান সংবাদপত্র ও ইলেক্টনিক মিডিয়ার সম্পাদক, প্রকাশক ও সাংবাদিকরা।

মতবিনিময় সভায় অংশ নেওয়া সাংবাদিকরা বলেন, নির্বাচনের সময় গণমাধ্যমকর্মীদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এর পাশাপাশি নির্বাচনকেন্দ্রে সংবাদ কাভারেজের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের বিধি-নিষেধ সংশোধন করতে হবে। নির্বাচনের সময় সাংবাদিকদের কার্ডের যেন কোনো অপব্যবহার না হয়, সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সাংবাদিকরা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।


মতবিনিময় সভায় বক্তব্য রাখছেন বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম’র সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু

তাদের এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে নির্বাচনের সময় সাংবাদিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বে দিয়ে দেখার আশ্বাস দেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. মাহফুজ আলম। পাশাপাশি নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে কোনো অসংগতিপূর্ণ বিধি-নিষেধ থাকলে তা পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে বলেও আশ্বাস দেন তিনি।

তথ্য উপদেষ্টা বলেন, নির্বাচন পূর্ব সময়, নির্বাচনকালীন ও নির্বাচন পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে তথ্যের প্রবাহ নিশ্চিত করা। এই সরকার যেহেতু একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, সেহেতু নির্বাচনের সংবাদ প্রচারে কোনো গণমাধ্যমই বাধাগ্রস্ত হবে না। এবারই সব রকমের সত্য তুলে ধরার সুযোগ সাংবাদিকদের আছে।

তিনি আরও বলেন, নির্বাচনকে ঘিরে অনেক ধরনের আশঙ্কা, উত্তেজনা ও ষড়যন্ত্র আছে। এসব বিষয়ে সংবেদনশীলভাবে সংবাদ উপস্থাপন করা উচিত বলে আমি মনে করি। অধিকাংশ জনগণ গত ৩টি নির্বাচনে ভোট দিতে পারেনি। ফলে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা আছে, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে। তাই এবার যাতে তারা ভোট দিতে পারে এবং উৎসাহী হয়, এই ভরসা তৈরির ব্যবস্থা সরকারের পাশাপাশি সংবাদমাধ্যমকেও করতে হবে। তাহলে এবারের নির্বাচন অনেক উৎসবমুখর ও অংশগ্রহণমূলক হবে।

তথ্য উপদেষ্টা বলেন, নির্বাচনের পূর্বে, নির্বাচনের সময় ও নির্বাচনের পরের সময়টা পর্যন্ত গণমাধ্যমকে অনেক বেশি সতর্ক, সচেতন ও দায়িত্বশীল আচরণ ও ভূমিকা পালন করতে হবে। তাহলে গণমাধ্যমের প্রতি গত ১৫ বছরে যে অনাস্থা তৈরি হয়েছে, সেটি কেটে যাবে। আর গণমাধ্যম যদি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে না পারে, তাহলে আমরা মনে করি, বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা থেকে যাবে। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই অস্থিতিশীলতা থেকে গেলে পরবর্তী সরকারের জন্য আস্থা ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে।

সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনাদের কমিউনিটিকে নিজেদেরই ঠিক করতে হবে। আপনাদের নিজেদেরই স্বাধীন থাকতে হবে, জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হবে। আস্থার সংকট দূর হলে মব ভায়োলেন্স বা নিরাপত্তাহীনতা কমে আসবে। এ ছাড়া সাংবাদিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কথা বলব।

গুজব প্রতিরোধে ফ্যাক্ট চেকিং করা কেন্দ্রীয়ভাবে করা সম্ভব নয় জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, গণমাধ্যমকেই এই বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে।

মতবিনিময় সভায় প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের (পিআইবি) মহাপরিচালক (ডিজি) ফারুক ওয়াসিফ বলেন, অনেক সাংবাদিকের জন্যই এটা প্রথম নির্বাচন। তাই তাদের নির্বাচনী সংবাদ সংগ্রহে প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। তথ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে নির্বাচন কমিশনের সহায়তায় নির্বাচন বিষয়ক রিপোর্টিংয়ের প্রশিক্ষণ হবে। চাইলে নিজ নিজ হাউজেও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যায়। আমাদের সহযোগিতা লাগলে আমরা আছি। কিন্তু এটি করা প্রয়োজন। কারণ নির্বাচনের আইন আছে, কী করা যায়, কী করা যায় না। অবাধ তথ্য প্রবাহই হচ্ছে একমাত্র রক্ষাকবজ।

সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, নির্বাচন ঘোষিত সময়ে হবে। এই বার্তাটি মানুষের কাছে সফলভাবে দিতে পারলে অন্য সমস্যাগুলো কেটে যাবে। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ইতিহাসের সেরা নির্বাচন তিনি করতে চান। এই নির্বাচনে আমরা যেন তার সঙ্গী হই, সাথে থাকি।

বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক আবু তাহের বলেন, আজকের আলোচনাগুলো বিবেচনায় নিয়ে সরকার যে সিদ্ধান্ত নেবে, সেগুলো দ্রুত প্রয়োগ করার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে কমিটি করে দেওয়া উচিত। সেই কমিটিতে সাংবাদিকদের প্রতিনিধিরা থাকবেন, পেশাদার সংগঠনগুলোর নেতারা থাকবেন। তাহলে সময়ে সময়ে সরকার থেকে বুদ্ধি নেওয়া যাবে এবং সরকারকে বুদ্ধি দেওয়া যাবে।

দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদক আযম মীর শাহীদুল আহসান বলেন, নির্বাচনের অংশীদারদের মধ্যেই বড় ধরনের দূরত্ব আছে। এই বিষয়গুলো সম্পর্কে মিডিয়ার ভূমিকা প্রথমে আলোচনা করা দরকার।

ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সভাপতি শহিদুল ইসলাম বলেন, আমরা গণমাধ্যমের স্বচ্ছ ভূমিকা চাই। সেই স্বচ্ছ ভূমিকার জন্য কাজের পরিবেশ চাই।

সাংবাদিকদের বেতন, ইনক্রিমেন্ট ও বোনাসের জায়গায় কার্পণ্য হয়। এটা নির্বাচনের আগেই দেখার এবং প্রয়োজনে নীতিমালা করার অনুরোধ জানান মাই টিভির প্ল্যানিং এডিটর মাহবুব সৈকত।

ঢাকা মেইলের নির্বাহী সম্পাদক হারুন জামিল বলেন, গণমাধ্যমের সংকটটা হঠাৎ করে তৈরি হয়নি। গণমাধ্যমের অবকাঠামো নষ্ট করেছে চাটুকার শ্রেণি। সাংবাদিকতার বেসিক জায়গাটা নষ্ট হয়ে গেছে। সরকারের উচিত তথ্যের ঘাটতি পূরণ করা।

একুশে টেলিভিশনের চেয়ারম্যান আবদুস সালাম বলেন, মুক্ত গণমাধ্যমের যে বাতাস বাংলাদেশে বইছে, এটা আগে কখনো হয়নি। তারপরও এই স্বাধীনতা নিয়ে আমরা সন্দিহান। আমরা ঠিকমতো কাজ করছি না। সরকারের পক্ষ থেকে বার বার বলা হচ্ছে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হচ্ছে। তারপর বিভিন্ন গণমাধ্যম সেটিকে সন্দেহের চোখে দেখছে এবং ন্যারেটিভ তৈরি করছে। গণতন্ত্র চাইলে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন প্রয়োজন। এজন্য গণমাধ্যমের ভূমিকা পালন করতে হবে।

তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়ে নিউজ২৪-এর হেড অব নিউজ শরীফুল ইসলাম খান বলেন, আমরা স্তূতি করতে চাই না। আমরা সত্য বলতে চাই। সাংবাদিকতা সুনির্দিষ্ট একটি সময়ের জন্য নয়। সাংবাদিকতা একটি জীবনাচার। এটা প্রতিনিয়ত উন্নতি করতে হবে।

আলোচনায় আসা প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়ে ডিবিসি নিউজের সম্পাদক লোটন একরাম বলেন, নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী সংবাদ সংগ্রহে সাংবাদিকদের জন্য যে নীতিমালা করেছে, এটা একতরফা নীতিমালা। অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা না করেই এই নীতিমালা করা হয়েছে। আমাদের পরামর্শ যদি বাস্তবায়ন না হয়, তাহলে এই ধরনের আলোচনা অর্থহীন।

গুজব প্রতিরোধে সরকারের তরফ থেকে ফ্যাক্ট চেকিং টিম গঠনের আহ্বান জানিয়ে সাংবাদিক আমিরুল ইসলাম কাগজী বলেন, তা নাহলে সত্য ও মিথ্যা গুলিয়ে ফেলার শঙ্কা তৈরি হয়।

বৈশাখী টেলিভিশনের হেড অব নিউজ জিয়াউল কবির সুমন বলেন, নির্বাচন কমিশন যে নীতিমালা দিয়েছে, তাতে ভোটকেন্দ্রগুলোতে ঢুকতে হলে প্রিজাইডিং অফিসারের অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু অতীতে আমরা দেখেছি, প্রিজাইডিং অফিসাররা ভোট কারচুপি করেন। তাহলে তার অনুমতি নিয়ে সত্য তুলে ধরা কীভাবে সম্ভব? তাছাড়া ভোটকেন্দ্রের কক্ষে লাইভ করা যাবে না, ভোট গণনার সময় একবার কোনো সাংবাদিক ঢুকলে আর বের হতে পারবেন না। এসব নীতিমালা মেনে স্বাধীনভাবে নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহ সম্ভব নয়।

দৈনিক কালের কণ্ঠের যুগ্ম সম্পাদক সাঈদ খান বলেন, সাংবাদিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। সাংবাদিকরা শুধু নিরপেক্ষভাবে সব পক্ষের মার খায়। তাই নির্বাচনী সংবাদ সংগ্রহের জন্য সাংবাদিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।

মতবিনিময় সভায় আরও বক্তব্য রাখেন বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমের সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু, গ্রিন টিভির বার্তা প্রধান মাহমুদ হাসান, গাজী টিভির বার্তা প্রধান গাউসুল আযম বিপুল।

এসসি/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।