শেরপুর (বগুড়া) থেকে ফিরে: মহিদুল ইসলাম (ছদ্মনাম)। পেশায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী।
এরপর চুপিসারে কিছু কথা বলেন। এইতো সেদিনের কথা। শুক্রবার (৮ জানুয়ারি) রাত অনুমান ১১টা। উত্তরদিক থেকে মুখোশধারী ৪০-৫০ জন নারী-পুরুষ ভবানীপুর বাজারে আসে। দোকানের টেবিলের ওপর সঙ্গে থাকা অস্ত্রগুলো রাখে। এরপর তারা কয়েকটি দলে ভাগ হয়।
একদল বাজার এলাকায় পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির পোস্টার লাগায়। আরেকদল পার্টির গণ-রাজনৈতিক প্রচারপত্র (লিফলেট) দরজা ও সাটারের নিচ দিয়ে বাজারের প্রতিটি ঘরে রেখে দেয়। আরো দু’টি দলের মধ্যে একদল অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে রাখে। আরেকদল লোকজনের ওপর চোখ রাখে। এভাবে তারা প্রায় ঘণ্টাব্যাপী বাজারে অবস্থান নিয়ে কর্মকাণ্ড চালায়। তবে তারা কোনো সাধারণ মানুষের প্রতিপক্ষ নয়। তাই ভয়ের কোনো কারণ নেই। পরে ফাঁকা গুলি চালিয়ে বাজার থেকে পশ্চিম দিকে রানীরহাট সড়ক হয়ে চলে যায়।
এ অবস্থায় ওই ব্যবসায়ী এ প্রতিবেদককে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, আমরা কেমন আছি বুঝতে পারছেন তো? একই কথা বলেন রানীরহাট বাজার এলাকার কয়েকজন ব্যবসায়ী।
রোববার (১০ জানুয়ারি) উপজেলার সীমান্তবর্তী ভবানীপুর ও রানীরহাট বাজারে গিয়ে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা হলে এসব তথ্য ওঠে আসে।
সরেজমিনে জানা যায়, সীমান্তবর্তী বগুড়ার শেরপুর, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ ও রায়গঞ্জ এবং নাটোরের সিংড়া উপজেলার মিলনস্থল ভবানীপুর ও রানীরহাট বাজার ঘিরে কয়েক সপ্তাহধরে চরমপন্থীদের আনাগোনা শুরু হয়েছে।
বিশেষ করে শেরপুর উপজেলার দক্ষিণ-পশ্চিমের গ্রামগুলোতে চরমপন্থীদের আনাগোনা ক্রমেই বাড়ছে। কোথাও কোথাও তাদের পদচারণা চলছে গভীর রাত পর্যন্ত। তাদের আনাগোনায় প্রত্যন্ত গ্রামের লোকজন অনেকটাই শঙ্কিত। গত ৮-১০ দিন ধরে এসব চরমপন্থীরা নিজেদের উপস্থিতি জানাতে মাঝেমধ্যে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে বলে একাধিক ব্যক্তি জানান।
এরই ধারাবাহিকতায় গত শুক্রবার (৮ জানুয়ারি) চরমপন্থীরা সশস্ত্র উপস্থিতির মাধ্যমে তাদের জানান দিলো। তবে নিরাপত্তার কারণে স্থানীয়রা কেউ নাম পরিচয় প্রকাশে রাজি হননি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১০ সালের ৮ ডিসেম্বর তাড়াশ উপজেলার গুঁড়পিপুল গ্রামে পুলিশের সঙ্গে চরমপন্থীদের গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটে। এ সময় পুলিশ সিংড়ার বামিহাল ফাঁড়ি থেকে লুট হওয়া ১টি শাটারগান ও ১টি দেশীয় পাইগানসহ দুই চরমপন্থীকে গ্রেফতার করে।
গ্রেফতারদের একজন রাজশাহীর চারঘাটা থানার ও অপরজন দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জের বাসিন্দা। তারা এ অঞ্চলে বিভিন্ন ট্রেনিং প্রোগ্রাম নিয়ে কাজ করছিল। এ গ্রামটি রানীরহাট থেকে মাত্র ১০-১২ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। অপরদিকে এক বছর আগে একই উপজেলার পারিল গ্রামে চরমপন্থীরা দুই ব্যক্তিকে হত্যা করে।
সম্প্রতি শেরপুর উপজেলার বিশালপুর ও ভবানীপুর ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী রানীরহাট, পাঁচ দেউলি, সিমলা, গোয়াল বিশ্বা ও দোলল, তাড়াশের তালোম ও দেশী গ্রাম, রায়গঞ্জের ধামাইনগর এবং সিংড়ার সুকাশ ও ডাহিয়া ইউনিয়নের জামতৈলহাটসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে চরমপন্থী দলের সদস্যরা অবস্থান করছে বলে স্থানীয়রা জানান।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, ২০০৫ সালের আগস্ট মাসের শেষ দিকে সন্ধ্যায় ভবানীপুর বাজার ঘেরাও করে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির সশস্ত্র সদস্যরা এক সমাবেশ করে আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জামায়াতকে নিমূর্লের ঘোষণা দিয়েছিল। সে সময় কাজে সহযোগিতার জন্য তারা গ্রামবাসীকে নির্দেশও দেয়। এ সময় তারা পার্টির গণ-রাজনৈতিক বুলেটিন ‘গণযুদ্ধ’ বিক্রি করে।
জানা যায়, উপজেলার ভবানীপুর, বিশালপুর, মির্জাপুর ও কুসুম্বী ইউনিয়নের প্রত্যন্ত এলাকার গ্রামগুলো ওই তিনটি জেলার চারটি উপজেলার সীমান্তে অবস্থিত। চরমপন্থীরা বরাবরই এসব দুর্গম এলাকাকে তাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নেয়। এই এলাকাগুলো প্রত্যেক থানা পুলিশ স্টেশন থেকে দূরত্ব ২৫-৩০ কিলোমিটার। ফলে দুর্বৃত্তরা অপরাধ সংগঠিত করে নির্বিঘ্নে চলে যায়।
স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, এসব দুর্গম এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে চরমপন্থীরা তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতি বছর সর্বহারাদের নামে তারা বাড়ি বাড়ি লুটপাট চালায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, প্রয়োজনীয় জনবলের অভাব এবং যোগাযোগ অব্যবস্থার কারণে পুলিশ এই এলাকার আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ রাখতে বরাবরই ব্যর্থ হচ্ছে।
ভবানীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিএম মোস্তফা কামাল বাংলানিউজকে জানান, চরমপন্থীদের সশস্ত্র উপস্থিতির কারণে এলাকার জনগণ চরম আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। যদিও তারা সাধারণ মানুষের প্রতিপক্ষ নয় বলে বাজারের লোকজনদের বলে গেছে। এরপরও জনসাধারণের মাঝ থেকে ভীতি দূর হচ্ছে না।
তবে ঘটনার পর থেকে পুলিশ নড়েচড়ে উঠেছে। আগের তুলনায় তারা বেশ তৎপর হয়ে উঠেছে। ভবানীপুর বাজার ও আশেপাশের এলাকায় টহল পুলিশের কার্যক্রম জোরালো করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
বিশালপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাজাহান আলী সাজা বাংলানিউজকে জানান, চোর-ডাকাত, সর্বহারা বা চরমপন্থীসহ সব ধরনের অপরাধীরা সীমান্তবর্তী হওয়ার কারণে রানীরহাট বাজারকে ‘সেভজোন’ মনে করে অপরাধ কর্মকাণ্ড চালাতে চায়। ইতোমধ্যেই পাশের ভবানীপুর বাজারে এসব দলের নামে পোস্টারিং করার খবর পাওয়া গেছে। এতে জনগণ উদ্বিগ্ন।
তিনি আরো জানান, এই এলাকার নিরাপত্তা চিন্তা করে ১৯৯৩ সালে এখানে স্বতন্ত্র থানা স্থাপনে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে দাবি জানানো হয়। সে সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এখানে থানা স্থাপনের আশ্বাসও দিয়েছিলেন। কিন্তু দীর্ঘদিন চলে গেলেও এলাকাবাসীর সেই দাবি আজো পূরণ হয়নি। ফলে ভয় ও শঙ্কা মাথায় নিয়ে সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষদের জীবন কাটাতে হচ্ছে বলে এই জনপ্রতিনিধি জানান।
শেরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খান মো. এরফান বাংলানিউজকে জানান, চরমপন্থীদের উপস্থিতির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়েছে। তাদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে পুলিশ কাজ শুরু করেছে। সীমান্তবর্তী পাশের সংশ্লিষ্ট সব থানার দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের ঘটনাটি জানানো হয়েছে।
তিনি আরো জানান, এই ঘটনার পর থেকে ভবানীপুর ও রানীরহাট বাজার এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। টহল পুলিশের তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া অতিদ্রুত এলাকায় মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হবে বলে পুলিশের এই কর্মকর্তা জানান।
বাংলাদেশ সময়: ১০৫৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০১৬
এমবিএইচ/জেডএস