ঢাকা: মুদ্রাপাচার রোধ ও অবৈধ বাণিজ্য চিহ্নিত করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অধীনে গঠিত হচ্ছে শক্তিশালী ‘চোরাচালান রিরোধী ফোরাম’। সাম্প্রতিক সময়ে উদ্বেগজনক হারে মুদ্রাপাচার ও অবৈধ বাণিজ্য বেড়ে যাওয়ায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের নির্দেশে গঠিত হচ্ছে এই ফোরাম।
অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান বাংলানিউজকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, চোরাচালান ও মানিলন্ডারিং বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আমার নেতৃত্বে চোরাচালান বিরোধী একটি ফোরাম গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন। সব বিভাগীয় কমিশনার, বিজিবি, কোস্টগার্ড, পুলিশ, র্যাবসহ সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাকে নিয়ে এ ফোরাম গঠন করা হবে।
ফোরাম গঠনে সময় নষ্ট হবে ভেবে বিভাগীয় কমিশনারদের চিঠি দেওয়া হয়েছে, যাতে তারা ঢাকায় এলেই সভা করে সহজে ফোরামটি গঠন করা যায়- যোগ করেন এনবিআর চেয়ারম্যান।
মুদ্রা পাচার বিষয়ে চেয়ারম্যান বলেন, ইতোমধ্যে সরকার এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। চোরাচালান পুরোপুরি বন্ধে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আইন পরিবর্তন করা হয়েছে। দুদকের পাশাপাশি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, পুলিশ, বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইউনিট ইত্যাদিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বোর্ড, কাস্টমস, আয়কর বিভাগ ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। কীভাবে কাজ করবে তার কৌশল নির্ধারণ করছি। যারা অবৈধ মুদ্রাপাচার করছে তাদের অনুসন্ধান করছি।
মো. নজিবুর রহমান বলেন, অনুসন্ধানে অনেকের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে লেনদেনের আলামত খুঁজতে গিয়ে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছি।
উদাহরণ দিয়ে চেয়ারম্যান আরও বলেন, সারা পৃথিবীতে মুদ্রাপাচার রোধে রাজস্ব বোর্ডের সক্রিয়তা অনেক বেশি। সে ক্ষেত্রে আমাদের রাজস্ব বোর্ডও সুনামের সঙ্গে কাজ করবে।
শিগগিরই ফোরাম গঠনের পর কাজ শুরু হবে। ফোরামের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে চিরতরে চোরাচালান রোধ করতে চাই বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন নজিবুর রহমান।
ইতোমধ্যে ব্যাপক পরিমাণ মুদ্রা আটক করা হয়েছে। কাস্টমসসহ এনবিআরের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান চোরাচালান রোধে অন্যান্য যেকোন সময়ের চেয়ে বেশি সক্রিয় বলেও দাবি করেন তিনি।
সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিবছর দেশ থেকে ১৬০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থপাচার হয়। যেখান আমদানি-রপ্তানির ওভার ইনভয়েস-আন্ডার ইনভয়েসে পণ্যের দাম কম-বেশি দেখিয়ে পাচার হয় ৬০ শতাংশ অর্থ।
‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড ২০১৪’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪ সালের শেষে বাংলাদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ৫০ কোটি ৬০ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা চার হাজার ৩০০ কোটি টাকা রয়েছে। যেখানে ২০১৩ সালে প্রায় তিন হাজার ১৬০ কোটি টাকা ছিল।
সম্প্রতি (৯ ডিসেম্বর) ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) এর প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অর্থপাচারের তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পাচার হয়েছে ৫ হাজার ৫৮৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার বা ৪ লাখ ৩৫ হাজার ৮৪১ কোটি টাকা। এরমধ্যে শুধু ২০১৩ সালে পাচার হয়েছে ৯৬৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার (৭৫ হাজার ৩৯৫ কোটি), যা ২০১২ সালের চেয়ে ৩৪ শতাংশ বেশি।
২০১৩ সালের পাচার হওয়া অর্থ চলতি অর্থবছরের বাজেটের চার ভাগের এক ভাগ। আর এ অর্থ দিয়ে তিনটি পদ্মাসেতু নির্মাণ করা যেত বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়।
পাচার হওয়া অর্থের ৮০ শতাংশ পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিং এর মাধ্যমে পাচার হয়েছে। বাকি অর্থ মানিলন্ডারিংয়ের মাধ্যমে পাচার হয়।
জিএফআই-এর প্রতিবেদনে উদ্বেগ জানিয়ে চেয়ারম্যান বলেন, মুদ্রাপাচার অনুসন্ধান করতে গিয়ে যত গভীরে যাচ্ছি তত কুৎসিত চেহারা দেখতে পাচ্ছি। ভয়-ভীতি, হুমকি-ধামকির ঊর্ধ্বে থেকে আমরা অনুসন্ধান করে যাচ্ছি। রিপোর্টটি নিয়ে কাজ করতে আমরা ‘ইঙ্গিত’ পেয়েছি। আমরা গভীরে গিয়ে কাজ করছি।
অর্থনীতিবিদ ড. মির্জা আজিজুল ইসলাম অর্থপাচার প্রসঙ্গে বাংলানিউজকে বলেন, রাজনৈতিক ছত্রছাত্রায় বেশিরভাগ অর্থপাচার হয়। এছাড়া আমদানি-রপ্তানির ফাঁক গলেও অর্থপাচার হয়।
সরকারের সদিচ্ছা আর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো সঠিকভাবে কাজ করলে অর্থপাচার রোধ করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে আইনের কঠোর প্রয়োগ থাকতে হবে বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশ সময়:০৮৪৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০১৬
আরইউ/এমজেএফ