ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

‘বঙ্গবন্ধু বললেন, আজকের ফটো ভালো হবে’

ইকরাম উদ দৌলা, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২৩৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৫, ২০১৬
‘বঙ্গবন্ধু বললেন, আজকের ফটো ভালো হবে’ ছবি: শাকিল/বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঘটনা-১
ঢাকা: ‘বঙ্গবন্ধু সেদিন গণভবনে ক্যাবিনেট বৈঠক করছেন। সবার বক্তব্যের পর বঙ্গবন্ধু যখন কথা শুরু করলেন, আমি ফটো নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম।

ক্যামেরার শার্টারে ক্লিক করা মাত্র ফ্লাশের শব্দ হলো। সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু বক্তব্য থামিয়ে আমার দিকে তাকালেন। তখন পিনপতন নিরবতা। আমি তো ভয়েই অস্থির। মাথা নিচু করে দুরুদুরু বুকে আফসোস করছিলাম-‘কী করলাম? ক্লিক করে ফ্লাশের শব্দে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য থামিয়ে দিলাম। ’ এমন সময় হঠাৎ জাতির পিতা বলে উঠলেন- ‘পাভেল, আজকের ফটোটা ভালো হবে। ’

ঘটনা-২
‘সেদিন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ির ছাদে বসেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কামাল ভাই (শেখ কামাল) আমাকে নিয়ে গেলেন সেখানে। আমাকে দেখিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বললেন, ‘আমাদের আবাহনীর ফটোগ্রাফার। ’

জাতির পিতা উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, ‘আবাহনীর আবার নিজস্ব ফটোগ্রাফারও আছে নাকি?’ সেদিনই সেই বিশেষ ভঙ্গিমায় গেঞ্জি পরিহিত অবস্থায় পাইপ হাতে বঙ্গবন্ধুর ফটোটা তুলেছিলাম।

ঘটনা-৩
সেদিন ছিলো ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার প্রথম ঘটনা। একটি পত্রিকার হয়ে আমি গেলাম দিনাজপুর। সেখানে বিডিআর এর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কর্নেল সাহেব আমাকে অভয় দিলেন। বললেন- ‘আপনি বিডিআর এর পোশাক পরে সীমান্তের কাছাকাছি যাবেন’। কী যে উত্তেজনা। কিন্তু আমি বলেছিলাম, ‘প্রয়োজনে ফটো সাংবাদিক হিসেবে মরে যাবো, তবু বিডিআর এর পোশাক পরে যাবো না। এমন কথায় কর্নেল সাহেব বললেন, ‘ঠিক আছে আপনি যান আমরা ব্যাকআপ দেবো। ’ এরপর সেদিন ক্যামেরা নিয়ে ভীরু বুকে সীমান্তের একেবারে কাছে গেলাম। এদিকে বিএসএফ রাইফেল তাক করছে আর হুঁশিয়ারি দিচ্ছে, তবুও আমি এগোচ্ছি। এক পর্যায়ে আমি যখন ফটো  তুলছি, তারা রাইফেল মাটিতে বসিয়ে সেট করে ফেলেছে, আর আমার হাঁটু কাঁপতে শুরু করেছে। এভাবেই ফটো তুলে ফেললাম। কিন্তু যখন ফিরছি, পিঠ বেয়ে গাঁ শিরশির করা অনুভূতি নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। মনে হচ্ছিলো এই বুঝি গুলিটা পিঠে এসে বিঁধলো। ’

এভাবেই বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিচ্ছিলেন কালজয়ী ফটো সাংবাদিক পাভেল রহমান। দীর্ঘ ৪০ বছরের সাংবাদিক জীবনের এমন নানা রোমাঞ্চকর আর ইতিহাসখ্যাত ফটো তুলে যিনি আজ প্রায় সারা বিশ্বেই পরিচিত মুখ।

জীবনের নানা অভিজ্ঞাসম্পন্ন ঘটনাপ্রবাহের মধ্যদিয়ে অতিবাহিত হয়ে একটি গ্রন্থ তিনি রচনা করেছেন। যেখানে স্থান পেয়েছে বিশ্বব্যাপী সামদৃত ইতিহাস বিখ্যাত ৩২টির মতো ফটো এবং সেসব ফটোর প্রেক্ষাপট।

যা দেশের প্রকৃত ইতিহাস রচনায় রেফারেন্স হয়ে থাকবে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

গ্রন্থটির নাম ‘সাংবাদিকতা আমার ক্যামেরায়’। যেটির মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে শুক্রবার (১৫ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমির চিত্রশালায় ঘটনাগুলো তুলে ধরলেন পাভেল রহমান।

তিনি বলেন, ‘আমি সাঁতার জানি না, তবু সামুদ্রিক ঝড়ের ভয়াবহতার ফটো তুলেছি। তেমনি তুলেছি রাজপথে জীবনকে হারানোর সমূহ সম্ভাবনার মুখেও। ফটো তুলেছি নূর হোসেনের (‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ বুকে পিঠে লেখা সংবলিত ফটো), ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার।

পাভেল রহমান জানান, দীর্ঘ ২০ বছর ধরে অনেক পরিচর্যার  তিনি গ্রন্থটি প্রকাশ করেছেন। ভবিষ্যতে বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত বহু তৈজসপত্রের, বহু দ্রব্যের ফটো নিয়েও গ্রন্থ বের করার ইচ্ছা রয়েছে তার।

মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, পাভেল রহমানের গ্রন্থটি শিক্ষার্থী থেকে শুরু গবেষকরা ইতিহাস রচনায় রেফারেন্স হিসেবে নিতে পারবেন।

সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, এই গ্রন্থটির মাধ্যমে ইতিহাসের অনেক সত্য বেরিয়ে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাভেল রহমান পরিণত থাকলে, আমরা আরও ভালো কিছু ফটো ও সঠিক ইতিহাস পেতে পারতাম।

তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, প্রধানমন্ত্রী হয়েও বঙ্গবন্ধু যে কত সাদাসিধে মানুষ ছিলেন, তার উজ্জ্বল প্রমাণ পাভেল রহমানের সেই ছবিটি। যে ছবিতে বঙ্গবন্ধুকে বাড়ির ছাদে চেয়ারের ওপর পা ‍তুলে পাইপ হাতে গেঞ্জি পরিহিত অবস্থায় দেখা যায়। তাই পাভেল রহমানের মতন, ইতিহাস রচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অব্যাহত রাখতে ফটো সাংবাদিকদের আহ্বান জানান তিনি।

বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী বলেন, নূর হোসেনের সেই একটি ফটোই পুরো রাজনৈতিক পট পরিবর্তন করে দিয়েছিলো। ফটো দিয়ে অনেক কিছুই করা সম্ভব। পাভেল রহমানের মতো ফটো সাংবাদিক আবার কবে আসবেন (জন্ম নেবেন) কে জানে?

অনুষ্ঠানের অন্যদের মধ্যে সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী দীপু মণি, দৈনিক কালের কণ্ঠের সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, দৈনিক ইত্তেফাকের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক তাসমিমা হোসেন, নাট্যকার আফজাল হোসেন, গ্রন্থটির প্রকাশক মাওলা ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী আহমেদ মাহমুদুল হক প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

পাভেল রহমান ২৬ এপ্রিল ১৯৫৬ সালে রংপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্নের পর সাংবাদিকতার ওপর নিয়েছেন বিভিন্ন দেশী-বিদেশি প্রশিক্ষণ।

পেশাগত জীবনে সাপ্তাহিক জয়ধ্বনি, সাপ্তাহিক একতা, দৈনিক বাংলা, সাপ্তাহিক কিশোর বাংলা, সচিত্র সন্ধানী, দৈনিক জনপদ, দৈনিক সংবাদ, ডেইলি নিউ নেশন, দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকা, দৈনিক জনকণ্ঠসহ সনামধন্য পত্রিকায় কাজ করেছেন।

এছাড়া, অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি), জিএএমএ, আনন্দবাজার পত্রিকা, দ্য স্টেটসম্যান ও এশিয়া উইকে ফটো সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন পাভেল রহমান।

কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি জাতীয় স্বর্ণপদক ছাড়াও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন পুরস্কার লাভ করেছেন।

বাংলাদেশ সময়: ২২৩৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৫, ২০১৬
ইইউডি/টিআই/আরআই

** ১৫ মার্চ থেকেই যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়েছিলাম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।