ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

আরামকোর আইপিও

সোনার ডিম পাড়া হাঁসের গলা কাটতে যাচ্ছে সৌদি আরব!

রাইসুল ইসলাম, অ্যাডিশনাল আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০১৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৬, ২০১৬
সোনার ডিম পাড়া হাঁসের গলা কাটতে যাচ্ছে সৌদি আরব! ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: বাজারে আসতে যাচ্ছে সৌদি আরবের সবচেয়ে বড় তেল কোম্পানি, সম্পদের দিক দিয়ে যাকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী কোম্পানি, সেই সৌদি ‍আরামকোর আইপিও।

আরামকোর আইপিও ছাড়ার এই খবরে নড়েচড়ে বসেছে বিশ্বের তাবৎ বড় বড় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান।

সাড়া পড়ে গেছে বিশ্বের বড় বড় শেয়ার বাজারগুলোতে।

সম্পদের দিক থেকে সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি আরামকো বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল কোম্পানি। প্রতিদিন এই প্রতিষ্ঠান উত্তোলন করে ৯৫ লাখ ব্যারেল তেল। যা বিশ্বের তেলের মোট চাহিদার এক দশমাংশ।  

রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানটি একই সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করে সৌদি আরবের স্থলভাগ ও সমুদ্র উপকূলে অবস্থিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুটি তেল ক্ষেত্রকেও।

সব মিলিয়ে আরামকোর মালিকানায় রয়েছে তেলের ২৬৫ বিলিয়ন ব্যারেল রিজার্ভ। যা দিয়ে আগামী ৮ বছর অনায়াসে সারা পৃথিবীর তেলের চাহিদা মেটানো সম্ভব।
 
আরামকো শুধু সবচেয়ে বেশি তেলই উত্তোলন করে না, একই সঙ্গে বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে সস্তায় তেল উত্তোলন করতে পারে প্রতিষ্ঠানটি। সৌদি আরবের রাজস্বের প্রায় সবটুকুরই যোগান দেয় তেল কোম্পানিটি।

তাই যখন এই প্রতিষ্ঠান শেয়ারবাজারে আসার ঘোষণা দেয় তখন তা শিরোনাম হয় বিশ্বের বড় বড় সংবাদমাধ্যমে। নড়েচড়ে বসেন অর্থনীতিবিদরা। হিসাব কষতে শুরু করেন বিশ্বের শীর্ষ বিনিয়োগকারীরা।

আরামকোর শেয়ার সতিই সত্যিই বাজারে আসলে নিঃসন্দেহে তা হবে বিশ্বের শেয়ারবাজারের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আইপিও। এ বছরের শুরুতে বর্তমান সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আব্দুল আজিজ আল সাউদের পুত্র ২৯ বছর বয়সী মোহাম্মদ বিন সালমান আল সাউদ’ই প্রথম আরামকোর শেয়ার বাজারে ছাড়ার ইঙ্গিত দেন। গত চার জানুয়ারি সৌদি রাজপরিবারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই সদস্য ইকোনোমিস্টকে জানান, তারা আরামকোর আইপিও বাজারে ছাড়ার চিন্তাভাবনা করছেন।

শুক্রবার এক প্রেস রিলিজের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটিও বিষয়টি কার্যত স্বীকার করে নেয়। পরে গত সোমবার আরামকোর চেয়ারম্যান খালিদ আল ফালিহ ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে বলেন, তাদের প্রতিষ্ঠান শেয়ারবাজারে যাওয়ার চিন্তাভাবনা করছেন। অবশ্য এ ব্যাপারে কোনো সময়সীমা সুস্পষ্ট করে জানাননি তিনি।

তবে আরামকোর শেয়ারবাজারে আসা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ধোঁয়াশার।   পাশাপাশি আরামকো তাদের মালিকানায় থাকা কোন কোন সম্পদের নিয়ন্ত্রণ শিথিল করবে তাও স্পষ্ট নয়।

কোম্পানিটি নিজেদের মূল সম্পদ অর্থাৎ তেলের রিজার্ভের আইপিও ছাড়বে নাকি অন্যান্য অংশীদারী প্রতিষ্ঠান যেমন রিফাইনারি কিংবা পেট্রোকেমিক্যাল প্লান্টের শেয়ার বাজারে ছাড়বে তা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন।

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যে সত্যিই শেয়ার বাজারে আসলে কোম্পানিটির আইপিওর দাম কতদূর পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।

এ ব্যাপারে এক বিশেষজ্ঞ বলেন, আরামকোর মূল্য ১ ট্রিলিয়ন থেকে ১০ ট্রিলিয়ন ডলার হতে পারে। যার মাধ্যমে এটি পৃথিবীর শেয়ারবাজারের ইতিহাসে সবচেয়ে সম্পদশালী কোম্পানিতে পরিণত হতে পারে।

পরিস্থিতি বিবেচনা করে সৌদি আরব অবশ্য কোম্পানির খুব ক্ষুদ্র একটি অংশকে শেয়ারবাজারে ছাড়তে পারে।

কিন্তু তারপরও আইপিওর মূল্যমানের দিক থেকে খুব সহজেই কোম্পানিটির শেয়ার এ যাবৎ বাজারে আসা বিশ্বের সবচেয়ে বড় আইপিওকেও অতিক্রম করতে পারবে।

২০১৪ সালে চীনা অনলাইন মার্কেট প্লেস আলিবাবা যখন শেয়ার বাজারে আসে  তখন এর আইপিও‘র মূল্য ছিলো ২৫ বিলিয়ন ডলার।

এছাড়া আরামকো কোন শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হবে তাও পরিষ্কার নয়। যদিও রিয়াদ স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হওয়াই প্রতিষ্ঠানটির প্রাথমিক উদ্দেশ্য বলে মনে করা হচ্ছে।   কিন্তু সৌদি স্টক এক্সচেঞ্জের ব্যাপ্তি সীমিত। এর মোট মূল্যমানই মাত্র ৪শ’ বিলিয়ন ডলার। সেক্ষেত্রে আরামকো একই সঙ্গে রিয়াদ ও ‍বিদেশি বৃহৎ শেয়ার বাজার যেমন লন্ডন কিংবা নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হতে পারে।

মূলত আরামকো ছিলো একটি বহুজাতিক মার্কিনী প্রতিষ্ঠান। চারটি মার্কিন তেল কোম্পানি মিলে তৈরি হয়েছিলো এই কোম্পানি।

কিন্তু গত শতাব্দীর ৭০ এর দশকের শুরুতে যখন তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাষ্ট্রীয়করণের হুজুগ তৈরি হয়েছিলো, সে সময়ই ১৯৭৩ সালে প্রথমে  কোম্পানিটির ২৫ শতাংশকে নিজেদের আয়ত্তে নেয় সৌদি সরকার। এরপর পর্যায়ক্রমে ১৯৮০ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠানটিই অধিগ্রহণ করে সৌদি আরব।

সৌদি আরবের সোনার ডিম পাড়া হাঁস হিসেবেই বিবেচনা করা হয় আরামকোকে।

যখন সৌদি সরকার নিজেই এই সোনার ডিম পাড়া হাঁসেরই গলা কাটতে যায়, তখন প্রশ্ন ওঠা শুরু হয় সৌদি আরবের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে।
 
ইতোমধ্যেই এই উদ্যোগের ব্যাপারে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে সৌদি আরবে।

অনেকে সাধুবাদ জানিয়ে বলছেন, এর ফলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই কোম্পানিটির আর্থিক বিষয়ে স্বচ্ছতা আসবে। যার মাধ্যমে আসলে সৌদি আরবের সামগ্রিক অর্থনীতিরই আধুনিকীকরণের রাস্তা পরিষ্কার হবে।

অবশ্য বেশ কিছুদিন থেকেই সৌদি সরকারও ব্যাপক বেসরকারিকরণের পথে এগুচ্ছে। এ বছরের মধ্যেই সৌদি আরবের বিমানবন্দর ও বিমানবন্দর সেবাকে বেসরকারি করণের কাজ সম্পন্নের ঘোষণা দিয়েছে সৌদি সরকার।

কিন্তু এর মধ্য দিয়ে সৌদি আরবের রাজপরিবারকেও জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে। কারণ যখন আরামকো শেয়ার বাজারে আসবে তখন এর হিসাব নিকাশ বিনিয়োগকারীদের অবহিত করতে হবে। অথচ এই কোম্পানির রাজস্ব আয়ের অর্থেই চলে সৌদি রাজপরিবারের সব ধরনের বিলাস ব্যসন।   এছাড়া কোম্পানির উপার্জিত অর্থ সৌদি আরবের অন্যান্য খাতেও খরচ হয়। প্রতিষ্ঠান শেয়ারবাজারে গেলে এ বিষয়গুলো সামনে চলে আসবে। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে ব্রাজিলিয়ান রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি পেট্রোবাসের কথা। শেয়ারবাজারে আসার পরপরই কোম্পানিটির বিশাল বিশাল দুর্নীতির বিষয়টি জনগণের ‍সামনে চলে আসে।

এত সব ঝুঁকি জানা সত্ত্বেও যখন সৌদি সরকার আরামকোর আইপিও বাজারে ছাড়ার ব্যাপারে আগ্রহী, তখন প্রশ্ন উঠে যায় দেশটির অর্থনীতির সামগ্রিক অবস্থান নিয়েই।  

বিশ্ববাজারে এমনিতেই তেলের দামের রেকর্ড পতন। সৌদি আরব রাষ্ট্রীয় খাতে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিয়ে থাকে। বিপুল এই ব্যয়ের সঙ্কুলান হয় দেশটির তেল সম্পদের আয় থেকে। তেলের দাম কমার কারণে তাদের রাজস্ব কমে গেছে আশঙ্কাজনক হারে। এ পরিস্থিতিতে আরামকোর শেয়ার বাজারে ছেড়ে তারা পরিস্থিতি সামাল দিতে চাচ্ছে। সৌদি আরবের সর্বশেষ ঘোষিত বাজেটেও বাজেট ঘাটতি দেখানো হয়েছে তার মোট জিডিপির ১৫ শতাংশ সমপরিমাণ।

তাই সৌদি সরকারের আরামকো শেয়ার বাজারে আনার পদক্ষেপে দেশটির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাকেই সামনে তুলে ধরে।

এছাড়া বিষয়টি বিশ্বের তেলের বাজারের ব্যাপারেও একটি সঙ্কেত। শেয়ারবাজারে সৌদি কোম্পানি আরামকোর নিবন্ধনের তোড়জোড়ের একটিই অর্থ।   খুব দ্রুতই বাড়ছে না তেলের দাম। বরং সামনে তা আরও কমতে পারে।

তবে বিনিয়োগকারীরা এখনও অপেক্ষা করছেন যে আসলে আরামকোর অফার কি হতে পারে।   কারণ সৌদি তেল কোম্পানি আরামকো এখনও যে কোনো বিচারেই বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কম খরচে তেল উৎপাদন করতে সক্ষম।

বাংলাদেশ সময়: ০০১৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৬, ২০১৬
আরআই


** নিমরের মৃত্যুদণ্ড, বিপজ্জনক খেলায় ইরান-সৌদি আরব
** মোদীর স্টাফ ৬৪, দেব গৌড়ার ছিলো ২ জন!
** হটমানি, ফেডারেল রিজার্ভ আর তেলে টালমাটাল বিশ্বের শেয়ারবাজার
** এখন শুরু মৃত্যু, প্রাণ বাঁচাতে মূত্রপান, তবুও নীরব!
** ‘চীনা ফ্লু’ আর ভূ-রাজনীতির খেলায় ঝুঁকিতে বিশ্ব অর্থনীতি!
** সোয়া বছরেই দিল্লির মসনদে গলদঘর্ম মোদি
 ** দেড় হাজার বছর আগেও সম্ভব ছিলো কৃত্রিম অঙ্গ প্রতিস্থাপন!

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।