নারায়ণগঞ্জ থেকে: ২নং বাবুরাইলের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রউফ সড়কের কয়েকটি গলি পেরিয়ে পাঁচতলার ভবনটি। নিচতলার ডানপাশের দু’টি ঘরের দরজার একটি নারায়ণগঞ্জের পাঁচ খুনের নৃশংসতার সাক্ষী।
পাঁচতলা ভবনের যে ঘরটিতে নারকীয় এই হত্যাকাণ্ড তার ওপরের তলাগুলোতে অন্তত ১০টি পরিবারের বসবাস। নিচতলায় নিহতদের পরিবার ছাড়া আর কেউ থাকেন না। ভবনের প্রতিটি তলায় কথা হয়েছে পরিবারগুলোর সঙ্গে। তাদের ভাষ্য, ‘কোনো কিছুই আঁচ করতে পারিনি’।
তারা বলছেন, খুনের শব্দ এমনকি খুনের শিকার হওয়া পাঁচজনের রক্তও বাইরে গড়ায়নি।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও ভবনটির বাসিন্দাদের মতে, চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ড পুরোপুরি ‘সাইলেন্ট কিলিং মিশন’। যেখানে শুধু মিশনের লোকেরা ছাড়া ঘটনার সময় কেউ কিছুই বুঝতে পারেননি। দিন-রাত ভবনটির সিঁড়ি বেয়ে বাসিন্দারা ওপরে-নিচে ওঠা-নামা করলেও কাউকে কিছু বুঝতে দেননি হত্যাকারীরা।
রোববার (১৭ জানুয়ারি) সকালে বাসাটির সামনে গিয়ে দেখা যায়, পুলিশ তদন্তের স্বার্থে বাসা সিলগালা করে রেখেছে। দরজার সামনে অবস্থান করে দেখা গেছে, বাসাটির দরজার ওপরে ও নিচে কয়েক ইঞ্চি ফাঁকা। ভেতর থেকে বাইরে শব্দ আসার মতো অবস্থা থাকলেও ঘটনার সময় পাশের বাসার বাসিন্দাদের কেউ কিছুই বুঝতে পারেননি।
যে ভবনে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ওই ভবনে ভাড়া থাকা কয়েকটি পরিবার ও বাড়ির মালিকের সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজের।
দ্বিতীয় তলায় পরিবারসহ ভাড়ায় থাকা পরিবারের কর্তা মো. শামীম বাংলানিউজকে বলেন, ‘কখন হত্যাকাণ্ড ঘটেছে আমরা কিছুই বুঝতে পারিনি। তালা ভাঙার পর জানতে পারি, ওই পরিবারের ৫ জন খুন হয়েছে’।
খুন হওয়া পরিবারটির সঙ্গে যোগাযোগ নেই জানিয়ে বলেন, ‘মাস দুয়েক আগে তারা নিচতলায় উঠেছেন। তাই পরিচিতও হয়ে উঠিনি। বাসা থেকেও তারা তেমন একটা বের হতেন না…’।
প্রায় একই কথা বললেন দ্বিতীয় তলায় থাকা আরেকটি পরিবারের সদস্য সোনালী আক্তার। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘নিচতলায় এতো বড় ঘটনা ঘটলো, অথচ কোনো শব্দ আমরা পাইনি। নিচতলা থেকে ওপরে উঠার সময়ও কিছু বোঝা যায়নি। এ বিল্ডিংয়ের অনেকেইতো ওপরে উঠেছেন, নিচে নেমেছেন। কিন্তু কখন এতো বড় হত্যাকাণ্ড ঘটে গেলো কেউ বুঝতে পারেননি’।
তৃতীয় তলায় গিয়ে কথা হয় রাশিদা বেগমের সঙ্গে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘তালা ভাঙার আগে পর্যন্ত আমরা জানতে পারিনি এখানে কি ঘটেছিলো’।
চারতলায় উঠে কথা হয় বাড়িওয়ালা মো. ইসমাইল হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমি জেনেছি, তারা কয়েকটা বাসা পাল্টিয়ে আমার এখানে উঠেছেন।
তিনি বলেন, ‘যারা টাকা পান, তারা নাকি ওই পরিবারকে (নিহতদের) তাড়া করতেন। আমাদের বাসায় ওঠার আগে তারা আরও দুই-তিন বাসা মুভ করছেন। এর আগে তারা ঢাকায় কলাবাগান নাকি কোথায় থাকতেন। ওখান থেকে নারায়ণগঞ্জের কোথায় জানি ছিলেন, এরপর এখানে ওঠেন’।
নিহতের পরিবার আর্থিক সংকটে ছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শফিকুলের পরিবার আমার বিল্ডিংয়ে উঠেছেন গত অক্টোবরে। বাসায় ওঠার সময় কন্ডিশন দিছিলাম যে, ৫ তারিখে ভাড়া দিতে হইবে। এরপর তারা একমাসও ঠিক সময়ে বাসা ভাড়া দিতে পারেননি। মাসের ১৩ বা ১৪ তারিখে দিতেন। দেরিতে ভাড়া দেওয়ায় আমি তাদের বলেছি, বাসা ভাড়া দিতে দেরি হলে আপনারা অন্য জায়গায় বাসা দেখেন। তারাও চলে যাবেন বলছিলেন..’
শনিবার (১৬ জানুয়ারি) শহরের ২ নম্বর বাবুরাইল এলাকার ওই বাসায় একই পরিবারের পাঁচজনকে হত্যা করা হয়।
নিহতরা হলেন তাসলিমা বেগম (৪০), তার ছেলে শান্ত (১০), মেয়ে সুমাইয়া (৫), ভাই মোরশেদুল (২৫) ও তাসলিমার জা লামিয়া (২৫)।
ইসমাইল হোসেনের পাঁচতলা বাড়ির নিচতলার পূর্বদিকের ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতেন তাসলিমা ও তার স্বামী শফিকুল ইসলামের পরিবার। ঘটনার সময় শফিকুল বাসায় ছিলেন না।
রোবাবার ঘটনাস্থলে গিয়ে আরও দেখা যায়, সিলগালা করা ফ্ল্যাটটিতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ছাড়া আর কাউকে ভিড়তে দেওয়া হচ্ছে না। নিহতদের স্বজনদেরও ঘটনাস্থলে দেখা যায়নি।
পুলিশের প্রাথমিক সন্দেহে পরিচিতরা
একই পরিবারের পাঁচজনকে হত্যার সঙ্গে নিহতদের পরিচিত কেউ জড়িত থাকতে পারেন বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে পুলিশ।
রোববার বেলা ১১টার পর পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি এস এম মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, বাড়ির যে ফ্ল্যাটে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, সেখান থেকে রান্না করা খাবার, খাবারের পাত্র ও প্যাকেট জব্দ করা হয়েছে। সেগুলো রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। এতে বিষ বা চেতনানাশক আছে কি-না, তা পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।
পুলিশের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, পরীক্ষায় যদি বিষ বা চেতনানাশকের উপস্থিতি পাওয়া যায় এবং হত্যাকারীদের হাতের ছাপ উদ্ধার করা যায়, তাহলে তদন্তে বেশ খানিকটা অগ্রগতি হবে।
মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান বলেন, নিহতদের পরিচিত কেউ এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকতে পারেন বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে পুলিশ।
নিহত পাঁচজনের মধ্যে দু’জন শিশু রয়েছে। এ প্রসঙ্গে পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি বলেন, শিশুরা সম্ভবত হত্যাকারীদের চিনে ফেলেছে। তাই হয়তো তাদের হত্যা করা হয়েছে বলে পুলিশ ধারণা করছে।
সম্ভাব্য খুনিদের লিংক ধরছে র্যাব
হত্যাকাণ্ডের ‘সম্ভাব্য খুনিদের লিংক ধরার চেষ্টা চলছে’ বলে জানিয়েছেন র্যাবের মহা-পরিচালক (ডিজি) বেনজীর আহমেদ।
রোববার বেলা ১১টায় তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন। ঘটনাস্থল থেকে বের হয়ে সোয়া ১১টায় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি।
র্যাবের ডিজি বলেন, ‘৫ জনের গলাতেই ছুরিকাঘাতের চিহ্ন ছিলো। তাদের ৩ জনের মাথায় আঘাতের চিহ্ন ছিলো। তবে রক্তপাতের মাত্রা বেশি ছিলো না’।
‘এ থেকে সম্ভাব্য কারণগুলো বিশ্লেষণ করে তদন্ত কর্মকর্তারা কাজ করছেন। সম্ভাব্য খুনিদের লিংক ধরার চেষ্টা চলছে’ বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
ভোতা অস্ত্রের আঘাতে মৃত্যু
শনিবার রাত থেকে রোববার দুপুর পর্যন্ত গলা কেটে ৫ খুন করা হয়েছে এমনটা জানা গেলেও বিকেলে ময়নাতদন্ত শেষে চিকিৎসকরা জানান, ভোতা অস্ত্রের আঘাতেই তাদের মৃত্যু হয়েছে।
এ ঘটনার তিন সদস্যের ময়না তদন্ত কমিটির প্রধান নারায়ণগঞ্জ ১০০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের আরএমও ডা. আসাদুজ্জামান জানান, নিহতদের কারো গলাকাটা হয়নি। তবে তাদের গলায় ও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাতের চিহ্ন আছে। এছাড়াও তাদের মাথায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, মাথায় আঘাতের ফলে অতিরিক্ত রক্তক্ষণের তাদের মৃত্যু হয়েছে। তাদের শরীরে হাতের ছাপ পাওয়া গেছে।
তিনি আরো বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, একদিন আগে তাদের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু প্রাথমিক অবস্থায় কোনো ধরনের চেতনানাশক কোনো কিছু পাওয়া যায়নি।
টাকা নিয়ে বিরোধে হুমকি, দাবি তাসলিমার মায়ের
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত পাঁচখুনের ঘটনায় নিহত তাসলিমার মা মোর্শেদা বেগম হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়ে রাতেই নারায়ণগঞ্জে ছুটে আসেন। তিনি দাবি করেন, ঢাকার কিছু লোকের হুমকির কারণে তারা (তাসলিমার পরিবার) নারায়ণগঞ্জে চলে আসেন। সুদের টাকার জন্য হুমকি দেওয়া হচ্ছিলো বলেও জানান তিনি।
মোর্শেদা বেগম জানান, তার মেয়ে তাসলিমার সঙ্গে ১৩ বছর আগে শফিকুল ইসলামের বিয়ে হয়। বিয়ের পর তারা ঢাকার ধানমণ্ডিতে বসবাস করতেন। ওই সময়ে বিভিন্ন কারণে বাহাদুর, বাদশা, বাদলসহ ৮/১০ জনের কাছ থেকে বিভিন্ন পরিমাণ টাকা সুদে ঋণ নেন শফিকুল। তারা ধানমণ্ডিতেই থাকেন। ঢাকায় যে বাড়িতে শফিকুল ভাড়া থাকতেন ওই বাড়ির একজনের কাছ থেকেও টাকা সুদে নেওয়া হয়। এর মধ্যে উল্লেখিতরা শফিকুলকে টাকার জন্য চাপ দিতেন, কখনও কখনও হুমকিও দিতেন।
নিহত তাসলিমার মা দাবি করেন, ‘টাকা পরিশোধ করতে না পারায় তিনমাস আগে শফিকুল পরিবার নিয়ে নারায়ণগঞ্জ চলে আসেন। পরে প্রতি সপ্তাহে বিশেষ করে বৃহস্পতিবার রাতে নারায়ণগঞ্জের বাসায় আসতেন। আবার শনিবার সকালে চলে যেতেন। শফিকুল ঢাকায় একটি কোম্পানির গাড়িচালক। নারায়ণগঞ্জ আসার পরেও ফোন করে টাকার জন্য চাপ দিতেন পাওনাদাররা’।
তবে শফিকুল কতো টাকা ঋণি ছিলেন সে বিষয়ে কিছু বলতে পারেননি মোর্শেদা বেগম।
নজরদারিতে সম্ভাব্যরা
একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত বলে সন্দেহভাজন ও সম্ভাব্যদের ওপর নজরদারি রেখেছে। নিহতের পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদে ইতোমধ্যে কিছু সন্দেহভাজনের নাম সংগ্রহ করেছে। তবে তদন্তের স্বার্থে তাদের পরিচয় ও অবস্থানের কোনো তথ্য এখনই প্রকাশ করছে না পুলিশ।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক কর্মকর্তা বলেন, শিগগিরই ঘটনায় জড়িতদের আইনের হাতে সোপর্দ করার চেষ্টা চলছে।
** নিহতদের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর
** গলাকেটে নয়, আঘাতেই মৃত্যু
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৭, ২০১৬
এডিএ/এ্সএ/এএসআর