নিঝুম দ্বীপ (হাতিয়া) থেকে: ভাটার টানে তীর থেকে সাগরের পানি অনেক দূর চলে যাওয়ায় নিজেদের ছেঁড়া জাল রিপেয়ারিংয়ের কাজে ব্যস্ত মোহম্মদ ইউসুফ, ফয়সাল ও রিটন।
জোয়ারের সময় তীর প্লাবিত করা পানির তোড়ে ভেসে আসা ছোট চিংড়ি ধরার জন্য বিশেষভাবে তৈরি ত্রিকোণ আকৃতির তিনটি হুসাজাল নিমগ্ন চিত্তে রিপেয়ার করছিল তারা।
সারি সারি খেজুর গাছের নিচে জাল বিছিয়ে রিপেয়ারিংয়ের ভঙ্গিমাটা দক্ষ শিল্পীর মত। এ যেন দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি পাড়ে ধ্যানমগ্ন তিন ঋষী।
তাদের চারপাশ ঘিরে আরো ১০/১২ জন দৌড়-ঝাঁপ করছে। ওরাও আছে জোয়ারের অপেক্ষায়। জোয়ার এলেই চিংড়ি শিকারে নেমে পড়বে। আপাতত ওরা গরুর রাখাল। চিংড়ি ধরা আর চরে ছেড়ে দেওয়া গরু-ছাগলগুলো দেখে-শুনে রাখার দায়িত্ব চেপেছে ওদের ওপর।
নিঝুম দ্বীপের এসব বাসিন্দার এ ছাড়া নেই অন্য কেনো ভূবন! স্কুলে যাওয়ার ঝামেলা ওদের নেই। এতো আদরের সন্তান ওরা নয় যে, চোখের আড়াল হলেই বাবা-বা চিন্তায় পেরেশান হয়ে উঠবেন। ওদের সবার বয়স ৮ থেকে ১২ বছরের মধ্যে।
সোমবার (১৮ জানুয়ারি) নিঝুম দ্বীপের নামার বাজার পয়েন্টে সাগর দেখতে গিয়ে পূর্ব-দক্ষিণ কোণে দেড় কিলোমিটার দূরে দেখা হয় ওদের সাথে। তখন বেলা সাড়ে ১১টা। সাগরে তখন ভাটা।
সফর সঙ্গীদের থেকে দলছুট হয়ে ধূ ধূ বালুচরে দেড় কিলোমিটার হেঁটে ইউসুফ, ফয়সাল ও রিটনদের কাছে পৌঁছুতেই ওদের মিষ্টি আবদার ‘মগু অ্যাটা হটু তোলেন’ (আমাদের একটা ফটো তোলেন)।
ডিজিটালাইজেশনের এই যুগে শহরের আড়াই বছরের শিশুরা মোবাইলে ডাটা কানেকশন দিয়ে ইউটিউবে নিজের পছন্দের গান শুনলেও, নিঝুম দ্বীপের ১০/১২ বছর বয়সী শিশুরা ক্যামেরা বা স্মার্ট ফোন দেখার সুযোগ পায় কদাচিৎ।
তাই ভ্রমণ পিপাসু মানুষ বা দেশি-বিদেশি পর্যটকদের হাতে হঠাৎ ক্যামেরা বা স্মার্ট ফোন দেখলে কোনো সংকোচ ছাড়াই বলে ফেলে, ‘মগু অ্যাটা হটু তোলেন’।
এমন মিষ্টি আবদারে পাথর গলে যেতে বাধ্য! আমি তো মাটির মানুষ। ছবি তোলার জন্য দাঁড়াতে বলতেই ইউসুফ, ফয়সাল, রিটন, জসিম, আরিফ, আনোয়ার উঁচু আইলের উপর সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে পড়ল। কিন্তু সীমা, লাইজু, তানিয়া, শারমীন ও লাকি লাজুক লতার মত দিল ভোঁ-দৌড়। কিছুতেই তারা ছবি তুলবে না।
এটা ওদের পর্দানশীল মা-খালাদের নিষেধাজ্ঞা হতে পারে। কারণ, গত দুই দিনে হাতিয়া এবং এর আশপাশের জনবসতিপূর্ণ দ্বীপ-উপদ্বীপে যত মা-খালাদের দেখেছি, তাদের কাউকেই বোরকা-হিজাব ছাড়া দেখিনি!
কিন্তু বঙ্গোপসাগরের বুক ফুঁড়ে জেগে ওঠা মূল ভূ-খণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তি থেকে যোজন যোজন দূরে নিঝুম দ্বীপে নিখাদ মাটির সন্তান হয়ে বেঁচে থাকা ফিরোজা রংয়ের টি-শার্ট পরা ফয়সাল ছবি তোলার সময় যে পোজটা দিল তা রীতিমত পেশাদার মডেলের মতই।
পা’দুটি পরিমাণ মত ফাঁক করে, কোমরে হাত দিয়ে যে ভঙ্গিমায় সে ছবি তোলার জন্য দাঁড়াল, তা অবাক করার মত। আর গেঞ্জি ইন করে লুঙ্গি পরা জসিম নব্বই ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে দাঁড়িয়ে যে হাসিটা দিয়েছে, তা না দেখলে বিশ্বাস করানো খুবই কঠিন।
ফটো সেশন শেষে ২০ মিনিটের আলোচনায় জানা গেলে, এরা কেউ স্কুলে যায় না। বলতে গেল স্কুলে যাওয়ার সুযোগ এদের নেই। প্রতিদিন জোয়ারের পানিতে হুসাজাল দিয়ে মাছ ধরে এক-দেড় শ’ টাকা রোজগার হয় এদের। উপার্জিত টাকা বাবা-মা’র হাতে তুলে দিয়ে সংসার চালানোয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ওরা।
ভাটার সময় নিজেদের গরু-ছাগল-মহিষ চরে চড়িয়ে বেড়ায়। বেগতিক বান এলে গৃহ-পালিত গরু-ছাগল-মহিষের সাথে এদেরকেও ভেসে যেতে হয় দরিয়ায়।
বাংদেশ সময়: ১৬৫১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০১৯
এজেড/জেডএম
** ঘাসিয়ার চরে মানুষের বসত
** ‘জানালার কাছে ডেকে গেছে এক পাখির মতন সকাল’