দিনাজপুর: স্বাধীনতার পর দীর্ঘ ৪৪ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো জীর্ণদশা থেকে মুক্তি পায়নি অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকা দিনাজপুরের সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি চিরিরবন্দর বধ্যভূমি।
জেলার সবর্বহৎ এ বধ্যভূমিতে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে অন্তত ৫ শতাধিক মুক্তিকামী বাংলাদেশিকে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদাররা।
এখানে হত্যা শিকার মুক্তিকামীদের প্রায় ৩ শতাধিক জনের মৃতদেহ পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কাকড়া নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। বাকিদের কাউকে মাটিচাপা ও কাউকে ফেলে রাখা হতো।
এছাড়া মুক্তিকামী মানুষকে ধরে এখানে এনে নির্যাতন করা হতো। অনেককে হত্যা করে ফেলে রাখতো পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এদেশীয় দোসররা।
উপজেলার থানা ও স্টেশন থেকে প্রায় ৫০ মিটার দূরে অবস্থিত কাকড়া নদীর উপর ব্রিটিশ সরকারের নির্মিত লোহার রেল ব্রিজের পূর্বকোণে এ বধ্যভূমির অবস্থান।
স্থানীয় কাটাপাড়া গ্রামের মৃত মকবুল হোসেনের স্ত্রী রেজিয়া বেগম (৭০) বাংলানিউজকে জানান, যুদ্ধের আগে ওই স্থানে সিরিশ বাবু নামে এক ব্যক্তির রাইস মিল ছিল। পাক হানাদাররা মিলের ম্যানেজার উদিরাম বাবুকে হত্যার পর মালিক সিরিশ বাবু ভারতে পালিয়ে যান।
এরপর থেকে ওই স্থানে এনে সাধারণ মানুষ হত্যা শুরু করে পাক হানাদাররা। যুদ্ধের সময় প্রতিনিয়তই তারা বিভিন্ন স্থান থেকে বাঙালিদের ধরে এনে হত্যা করতো। পরে কাউকে চাপামাটি বা আশপাশের কুয়াতে ফেলে দিতো। আবার কাউকে পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কাকড়া নদীতে ভাসিয়ে দিতো।
ওই স্থানে যুদ্ধকালীন অন্তত ৫ শতাধিক বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
স্থানীয় বাসিন্দা আজগর আলী (৭৬) জানান, ওই স্থানে পাকবাহিনী অনেককে হত্যা করেছে। তখন কাকড়া নদীর স্রোত ছিল। হত্যার পর তারা মৃতদেহ স্রোতে ভাসিয়ে দিতো। নদীতে তাকালেই লাল রক্ত দেখা যেতো। এখনো সেদিকে তাকালে ভয়ঙ্কর সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে তার।
মুক্তিযুদ্ধকালীন ৭নং সেক্টরের অধীনে ডেপুটি কমান্ডার হিসেবে নেতৃত্ব দানকারী ও বর্তমান উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সহকারী কমান্ডার মাহবুবুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, মুক্তিযুদ্ধকালীন চিরিরবন্দর এলাকা ছিল রাজাকার, আরবদর, আল-সামস ও শান্তি কমিটির শক্ত ঘাঁটি।
এ এলাকার রাণীরবন্দর, দাগড়বাড়ী, বিন্যাকুড়ি, নখইড় কামার পাড়াসহ আব্দুলপুর মাদ্রাসা সংলগ্ন ইছামতি নদীর পাশ ও বিভিন্ন স্থানে হাজার হাজার মুক্তিকামী বাঙালিকে হত্যা করেছে পাকবাহিনী ও তাদের সদস্যরা। কিন্তু এদের মধ্যে কাকড়া নদীর রেল ব্রিজের পূর্বে অবস্থিত সিরিশ বাবুর মিলেই বেশি মানুষ হত্যা করেছে তারা।
এ কাজে তাদের সহযোগিতা করেছেন স্থানীয় রাজাকার ও পিস কমিটির সদস্যরা।
তিনি বলেন, যুদ্ধের একপর্যায়ে আমরা ৭নং সেক্টর থেকে এ এলাকার পাকবাহিনীর ক্যাম্প, তৎকালীন থানা ও বর্তমান থানায় ৭১’র ১৩ ডিসেম্বর হামলা করে দখলে নেই। এরপর প্রতিরোধের মুখে চিরিরবন্দর থেকে একে একে পালিয়ে যায় হানাদার বাহিনী। এরআগে থানায় হামলা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল। সে সময় শহীদ হন নজিবর রহমান নামে এক মুক্তিযোদ্ধা।
এ স্থানে যেসব বীর বাঙালি ও মুক্তিকামী জনতা জীবন দিয়েছেন তাদের স্মৃতি রক্ষার্থে ও সম্মানে প্রযোজনীয় পদক্ষেপ নিতে তিনি সরকারের প্রতি জোর দাবি জানান।
এ ব্যাপারে চিরিরবন্দর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মমিনুল ইসলাম জানান, ৪৪ বছর পর এই প্রথম চিরিরবন্দরে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিতে একটি স্মৃতিস্তম্ভ করা হয়েছে। সব শহীদের নাম স্মৃতিস্তম্ভে দেওয়া সম্ভব না হওয়ায় মাত্র ২১ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম দেওয়া হবে।
তিনি জানান, সিরিশ বাবুর মিলে শহীদদের তালিকা রয়েছে। তবে সবার নাম সেখানে নেই। বাদ পড়েছেন অনেকেই। মুক্তিযুদ্ধের সময় সিরিশ বাবুর মিলে যারা শহীদ হয়েছিলেন তাদের জন্য আগামীতে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির কথা রয়েছে বলেও তিনি জানান।
এদিকে, চিরিরবন্দরের ওই বধ্যভূমির শহীদদের তালিকা তৈরি করে তাদের যোগ্য মর্যার্দা দেওয়ার দাবি স্থানীয়দের। তাদের দাবি, জীর্ণদশা থেকে মুক্তি পাক এ বধ্যভূমি, সংরক্ষণ করা হোক এখানকার স্মৃতিচিহ্ন ও ইতিহাস।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৫১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২০, ২০১৬
এসআর